ভাষা ভাষা
ঘটনাটা আমার ছোটবেলার। আমরা যে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম সেখানে আমাদের পড়শি ছিলেন 'ক' বাবু। নিপাট ভালো মানুষ হলেও ভদ্রলোক ছিলেন একটু খামখেয়ালি ও বদমেজাজি। ব্যাংকের চাকরিরত 'ক' কাকু ছিলেন একদম নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি। সেই সময় গ্রাম বাংলা থেকে উঠে আসা অনেক মানুষের মতোই তাঁর ইংরেজিতে একটু ব্যথা ছিল। স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁর কর্মক্ষেত্রে বা সাধারণ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার সেরকম কোনও প্রয়োজন পড়ত না। মাঝেসাঝে লেখার পড়লেও, বলার একেবারেই প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু আমি তাকে দুবার ইংরেজি বলতে শুনেছিলাম। একবার কালীপুজোর রাতে, কিঞ্চিৎ সুরা পান করে কাকু বলা-কওয়া নেই, হঠাৎ "ইনজয়!! মাইকেল জ্যাকসন! ইউ ড্যান্স, আই ড্যান্স, আল ইন্ডিয়া ড্যান্স!" বলে নেচে উঠেছিলেন। দ্বিতীয়বার, কাকু ঝগড়া করছিলেন তার পিছনের বাড়ির মাসিমার সাথে। মাসিমা তার বাড়িতে পাতা পড়া নিয়ে একবার 'ক' কাকুকে "ছোটোলোক" ইত্যাদি বলেছেন। আর যায় কোথায়? 'ক' কাকু লুঙ্গি গুটিয়ে, পাঁচিলে চড়ে চিৎকার করতে থাকেন, " ইউ ছোটলোক, ইউর ফাদার স্মল মান, চৌদ্দ গুষ্টি স্মল ম্যান, ইডিয়ট,লোফার, রাস্কেল!!" অর্থাৎ বাঙালির সাথে ইংরেজির সম্পর্ক টা কিন্তু বেশ ইমোশনাল! রাগ হোক বা ফুরফুরে মস্তি, বাঙালি কিন্তু চরম মুহূর্তে সেই ভাসা-ভাসা ইংরেজিকেই ভরসা করে থাকেন।
এই অবধি পড়ে আপনি কি ভাবছেন আমি বাংলা ভাষাকে হেলা ছেদ্দা করে ইংরেজির জয়গান করছি? আজ্ঞে না মশাই, সেইরকম কোনো ইচ্ছে নেই আমার। তবে হালে বাংলা পক্ষের গলাবাজি কোনও কোনও ক্ষেত্রে একটু বেশিই অযৌক্তিক লাগছে। এই যেমন, পশ্চিমবঙ্গে সব পরীক্ষা শুধুমাত্র বাংলা ভাষাতে হওয়া দরকার - এমন দাবি আমি সমর্থন করি না। কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই আমার বাংলার বাইরে বিভিন্ন প্রদেশে কাটিয়েছি, তাই ভাষা নিয়ে জবরদস্তি আমার না-পসন্দ।
এই লেখায় নানা জায়গার ভাষাবিভ্রাটের কিছু মজাদার অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। ভাষার মূল লক্ষ্য শেষপর্যন্ত নিজের মনের ভাব একে অপরের সাথে ভাগ করে নেওয়া ছাড়া তো কিছু নয়। ২০২১ সালে সালে আমরা মিশর ঘুরতে যাই। সেখানে সবসময় আমাদের সাথে আমাদের ইংরেজি-জানা গাইড থাকায় কোন অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়নি। একদিন বাদে। সেদিন রাতে আমরা আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিলাম আর রাতের খাবার কিনতে দোভাষী ছাড়াই বাজারে চলে যাই। বললে বিশ্বাস করবেন না, নিজেকে বোবা মনে হচ্ছিল। কারণ কেউ সেখানে ইংরেজি জানে না। আর আমরা আরবি জানি না। কাউকে নিজেদের কথা এক বর্ণ বোঝাতে পারলাম না। অনেক দোকান ঘুরে ক্লান্ত হয়ে শেষে একটা দোকানে এলাম যেখানে কাঁচের বাক্সে বিভিন্ন ধরনের ভাজাভুজি রাখা ছিল। অতি কষ্টে চারজনের মত খাবার ইঙ্গিত করে দেখলাম এবং কোনওমতে দাম মেটালাম। ভাবলাম এই যাত্রায় উৎরে গেলাম। উৎরে গেছিলাম ঠিকই, কিন্তু যে পরিমাণ খাবার সে দিন কিনেছিলাম, তার ২০ শতাংশ খেয়েই আমরা কাহিল, আর বাকি ৮০ শতাংশ গেল ডাস্টবিনে। বিক্রেতা আমাদের 'সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ' নিজের মতো করে বুঝে প্রায় চারগুণ খাবার দিয়েছিল।
ভাষা নিয়ে একটা আঞ্চলিক গর্ব বোধ করা ভালো ব্যাপার। যেকোনো জাতির মধ্যেই এই ব্যাপারটা লক্ষণীয়। কিন্তু এর ফলে বাকিদের কিছু অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন চেন্নাইয়ে থাকাকালীন বারবার দেখেছি অটোওয়ালারা জেনে বুঝে হিন্দি আর ইংরেজি বলতে চায় না। তারপর মহারাষ্ট্রে প্রায় বছর পাঁচেক থাকার পর জেনেছি পোস্তকে 'খস খস' বলে! তার আগে বহু দোকানে 'পোস্ত' বলতে গিয়ে পাস্তা থেকে টুথপেস্ট কী না পেয়েছি! এক মক্কেল তো পপি সিড শুনে আরেকটু হলেই পুলিশকে ফোন করতে যাচ্ছিল। আমার কর্মজীবনের একেবারে প্রথম দিকে ভাইজাগ স্টিল প্ল্যান্টে আমার এক তামিল সহকারী প্রায় ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল এক বিকেলে। হঠাৎ আঙ্গুল তুলে সে বলে,"মিত্রা স্নেক"! পিলে চমকে উঠেছিল। পরে বুঝেছিলাম ও আমাকে বলছিল বিকেলের জলখাবার (snack) খাওয়াতে! ওটা ওর উচ্চারণের মহিমা! তবে তার কিছু দিন পরে সত্যি আমার স্নেকের সাথে দেখা হয়, কিন্তু আমার সেসময়ের সঙ্গী তেলুগুভাষী শ্রমিকটি চিৎকার করতে থাকে "পামু! পামু!" আমি কিছুই বুঝিনি! ভাগ্যিস পামু আমাকে হামু দিয়ে যাননি সেইদিন! আবার আমার এক স্যার কেরালার একটি গ্রামের বাড়িতে শত চেষ্টা করেও চিকেন বা মুরগি বোঝাতে না পেরে ডিম দেখিয়ে বলেছিলেন, "ইসকি আম্মা"!
তবে ভাষা কিন্তু একটা বিচ্ছিন্ন জিনিস নয়। ভাষার সঙ্গেই যুক্ত হচ্ছে লোকাচার। পুরো দুনিয়া বাদ দিন, আমাদের দেশেই এক-এক জায়গার লোকাচার বা রীতিনীতি দেখলে মাথা ঘুরে যেতে বাধ্য। বাঙালি হিসেবে মহারাষ্ট্রে এসে যখন দেখি চানাচুরের উপর একটা ঝোল ঢেলে বনপাউরুটি মাখিয়ে লোকে রসিয়ে খাচ্ছে, বা চেন্নাইয়ে দেখি কী অনায়াসে লোকে একটা কলা পাতার উপর জলের মত সম্বার আর রসম সাবাড় করে দিচ্ছে - বিস্মিত হই। একটা মজার অভিজ্ঞতা বলি। ভালোবাসার শহর প্যারিস। বিদেশ হলেই আমরা বঙ্গসন্তানরা সম্ভ্রম ফ্যাক্টরটা কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে রাখি। একটি বাসস্টেশনে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক খবরের কাগজ পড়ছেন। আমি এসে ঠিক ঠাউর করতে পারছি না সেই প্ল্যাটফর্মের নম্বর কত। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে ইউরোপ বাস স্টেশনেও প্ল্যাটফর্ম থাকে। কাজেই আমি ভদ্রলোককে "এক্সকিউজ মি স্যার" বলে ডেকে প্ল্যাটফর্ম নম্বর জিজ্ঞাসা করলাম। জেঠু কাগজটা নামিয়ে আমাকে খর চোখে মেপে নিয়ে বললেন, " I will not tell you" ! এবার এটা যদি তাঁরভাষা না জানার জন্যে আমার উপর বিদ্বেষ হয়,তাহলে সত্যি সেইরকম ভাষাপ্রেম কাম্য নয়। একইভাবে বেলজিয়ামে একটা কফিশপে আমি "এক্সকিউজ মী ক্যান আই গেট আ কফি?" বলায় ক্যাপ্টেন হ্যাডকের আত্মীয় সেই দোকানি আমাকে মুখের উপর বলে দিল, "নো!" তারপর বললো, " ফার্স্ট সে হেলো, গুড মর্নিং, দেন আস্ক!" ব্যাপারটা একবার ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ভেবে দেখুন দেখি।
আমাদের বাঙালিদের আরেকটি মজার গুণ আছে। আমরা যারা ইংরেজিতে অতটা মজবুত নই, আমদের কাছে হিন্দিটাই হল বিশ্বের ভাষা! ব্যাপারটা তাও ভারতবর্ষে চলে যায়, কিন্তু দেশের বাইরে এটা করলে কখনও কখনও চরম বিভ্রাট হতে পারে। কিছুদিন আগে এথেন্স শহরে আমি একটি অ্যাকসিডেন্ট হতে হতে বেঁচে যাই। ট্রেন এ ওঠার সময় অন্যমনস্ক হয়ে পা পিছলে ট্রেন আর প্ল্যাটফর্মের ফাঁকে প্রায় পড়ে যেতে যেতে একটুর জন্য রেহাই পাই। অল্প চোট লেগেছিল। প্যান্ট ছিঁড়ে কেটে যায় এবং স্বাভাবিক নিয়মেই কামরা জুড়ে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বলতেই হবে দারুণ সহযোগিতা করেন সহযাত্রী সকলেই। এক মহিলা আমাকে ধরে তার নিজের জায়গায় বসান। আমার সাথে ছিলেন আমার শ্বশুরমশাই। এই সবের মাঝে তিনি বেজায় ব্যোমকে গেছেন। কিন্তু সেই মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে হিন্দি বাংলা মিশ্রিত ভাষায় এই দুর্ঘটনার কারণ বর্ণনা না করলেই পারতেন। পায়ের ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে শুনতে পেলাম চেঁচিয়ে বলছেন উনি, " ইতনা ফাঁক হ্যায় কি গির গয়া!!" নিশ্চয়ই এই ফাঁকফোকরের চক্করে ভদ্রমহিলা কিছু মনে করেননি।
নিজের ভাষাকে ভালোবাসা বা তা নিয়ে গর্ব করা যে-কোনও জাতি কে সমৃদ্ধ করে বলেই আমার মনে হয়। তবে দেশপ্রেমের মতোই যদি ভাষাপ্রেম টক্সিক হয়ে যায় তাহলে সেটা কিন্তু সেই ভাষার প্রসার ব্যাহত করতে বাধ্য। একবার ভাবুন তো যদি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মিলান কুন্দেরা বা বর্হেস এর লেখা অনুবাদিত না হত তাহলে আমরা কতটা বঞ্চিত হতাম। বা এই যে রবি ঠাকুরের এই বিশ্বব্যাপী সুনাম, তা কি নবারুণ বা সন্দীপন পেতেন পারতেন না যদি সেইরকম ভালো অনুবাদ হত তাঁদের কাজের? বর্তমান যুগে আমরা সত্যি দেশ,কাল,সীমানার গণ্ডি মুছে এক অপরের যাবতীয় ভালো কিছু আত্মীকরণের মাধ্যমে একটা উৎকৃষ্ট, উন্নততর সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারি না কি? জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে রবি ঠাকুর যেটা লিখছেন সেটা এ ক্ষেত্রে ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলেই আমার ধারণা। রবি ঠাকুর লিখছেন, "বিশ্ব-মানবের প্রতি ভালোবাসা-বোধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যেমন কিনা প্রকৃত দেশপ্রেমের নিখুঁত স্ফুরণ ঘটতে পারে না, ঠিক তেমনি প্রগাঢ় দেশপ্রেমকে উপেক্ষা করে সত্যিকার মানবপ্রেম জাগরিত হতে পারে না।"
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নেশন প্রবন্ধে আরও লিখছেন, নেশন মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত, ইতিহাস থেকে জাত। তা কোন ভূখণ্ড, ভাষা ও ধর্মীয় ঐক্য গড়ে তোলার উপায় নয়। নেশন একটি সজীব সত্তা, যা অতীতের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং নিজেদের উত্তরাধিকারকে রক্ষা করে। তাই ভাষার আবির্ভাব যখন একে-অপরের সঙ্গে মনের ভাব আদান প্রদান করার জন্যই, তখন ভাষা নিয়ে জোরজবরদস্তির কোনও প্রয়োজন আছে কি? ভাষাকে ভালোবাসা যেন ভাষার মৌলবাদে পৌঁছে না যায়, সেটাই খেয়াল রাখার বিষয়।