যাঁকে বঞ্চিত করে নোবেল দেওয়া হয়েছিল কুরি-তনয়াকে

সদ্য তাঁর একশো চল্লিশতম জন্মদিন পালন করল গুগল, নিজের মতো করে, ডুডল বানিয়ে। গুগলের হোমপেজে প্রদর্শিত হল তাঁকে নিয়ে বানানো কার্টুন চিত্র। ডুডলের পরিচিতি অনুযায়ী মানুষটির নাম স্তেফানিয়া ম্যুরাচ্যেনান্যু, রোমানিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী। কিন্তু কে এই স্তেফানিয়া?
বেশ কিছুটা বেশি বয়সেই, ১৯২৪ সালে বেয়াল্লিশ বছর বয়সে পিএইচডি করবার পর স্তেফানিয়া বেশ কয়েক বছর গবেষণা করেন মারি কুরির কাছে। সেই মারি কুরি, যিনি তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কারের জন্য পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। ফ্রান্সে তখন তিনি তেজস্ক্রিয় রশ্মি সংক্রান্ত কাজকর্মের সবচেয়ে উঁচু মাথা।
তেজস্ক্রিয় রশ্মি নিয়েই গবেষণা করেছিলেন স্তেফানিয়া, তাঁর কাজই তৈরি করেছিল কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা নামে একটা আলাদা বিষয়ে। অথচ সে কাজের জন্য যেটুকু স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল তাঁর, পাননি সেটুকু। বিজ্ঞানের ইতিহাসে অগুনতি উপেক্ষিতাদের একজন হয়েই রয়ে গিয়েছেন স্তেফানিয়া। গুগল তাঁকে তাঁর জন্মদিনে স্মরণ করেছে, আর এই উপলক্ষ্যে অন্তত কিছু মানুষের কাছে তাঁর নামটুকু পৌঁছচ্ছে, এইটাই যা ভালো কথা।
স্তেফানিয়ার জন্ম বুখারেস্ট-এ ১৮৮২ সালের ১৮ই জুন। ছোটবেলার কথা তাঁর বিশেষ জানা যায় না, তবে এটুকু জানা যায় যে একটা গার্লস স্কুল থেকে তিনি হাই স্কুল-স্তরের শিক্ষা শেষ করেন। এবং এরপর ভরতি হন ইউনিভার্সিটি অফ বুখারেস্ট-এ, ১৯০৭ সালে। ওখান থেকে ১৯১০ সালে তিনি গ্র্যাজুয়েট হন। এরপর একটি মেয়েদের স্কুলে কয়েক বছর পড়াবার পর যখন বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল, তিনি রোমানিয়ার সরকারি বিজ্ঞান দপ্তর থেকে একটি স্কলারশিপ পেলেন; এবং চলে আসেন প্যারিসে। সেখানকার রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে তখন দায়িত্বে আছেন তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করে জগৎ-বিখ্যাত বিজ্ঞানী মেরি কুরি। তাঁর নাম সকলেরই জানা। তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম আর পোলোনিয়াম আবিষ্কার করবার ইতিমধ্যে তিনি পেয়েছেন নোবেল, আরও একটি নোবেল হস্তগত হবে তাঁর, বছর খানেক পরেই।
এখানে স্তেফানিয়ার গবেষণার বিষয় ছিল পোলোনিয়াম নামের তেজস্ক্রিয় মৌলের অর্ধজীবন কাল নির্ণয় করা। অর্ধজীবন (বা অর্ধায়ু, ইংরেজিতে half life) হল কোনো তেজস্ক্রিয় মৌলের ক্ষেত্রে সেই সময়কাল যেটুকু সময় পরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পদার্থের অর্ধেকটা পড়ে থাকে (বাকি অর্ধেকটা আলফা বা বিটা কণা হিসেবে বেরিয়ে যায়)। অনেক তেজস্ক্রিয় মৌলের অর্ধজীবন কাল সেকেন্ডের পাল্লায় থাকে, অনেক মৌলের ক্ষেত্রে আবার পরিমাপটা হাজার বছরেও পৌঁছে যায়।
আজ আমরা জানি পোলোনিয়ামের অর্ধজীবন কাল একশো আটত্রিশ দিন। কিন্তু পরীক্ষাটা করবার সময় স্তেফানিয়া দেখলেন, বারবার তাঁর ফলাফলে অর্ধজীবন কালের পরিমাপ আলাদা আলাদা হচ্ছে। অনেক অনুসন্ধান করে তিনি বুঝলেন, ব্যাপারটা আসলে ঘটছে ওই পোলোনিয়াম নমুনাকে যে ধাতব পদার্থের ওপরে রেখে পরীক্ষাটা করে হচ্ছে, সেই বস্তুর উপস্থিতির কারণেই। আরও অনুসন্ধান চালিয়ে স্তেফানিয়া সিদ্ধান্তে এলেন, ওই ধাতব বস্তুর ওপর পোলোনিয়াম থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় রশ্মি পড়ছে এবং ওর কিছু পরমাণুর সঙ্গে তারা বিক্রিয়া করে
তৈরি করছে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। আইসোটোপ হল কোনো পরমাণুর এমন কিছু রূপ সেগুলোতে প্রোটন সংখ্যা একই হয় কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা হয় আলাদা।
এরপর আরও বছর কয়েক স্তেফানিয়া কাজ করেন কুরির ইনস্টিটিউটে, তারপর ভরতি হন সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই তিনি পিএইচডি করেন।
এর পর কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। স্তেফানিয়া ফিরে গেছেন তাঁর জন্মভূমিতে। এসে গেল ১৯৩৫ সাল। ঘোষণা করা হল যে মারি কুরির বড় মেয়ে আইরিন আর তাঁর স্বামী জোলিয়ট কুরি পাচ্ছেন সে বছরের নোবেল, কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্য। অথচ এটা খুব সত্যি কথা যে মারি কুরির ছাত্রী স্তেফানিয়াই এই ঘটনার কথা তাঁর থিসিজে লিখে ফেলেছিলেন এর অন্তত দশ বছর আগেই। কুরি-কন্যার স্বীকৃতির খবরে হতাশ হওয়ার পাশাপাশি স্তেফানিয়া আরও দুঃখ পেলেন যখন দেখলেন যে তাঁর নাম বা কাজের সামান্য উল্লেখও করেননি কুরি দম্পতি তাঁদের পেপারে।
আর ততদিনে স্তেফানিয়াও ফিরে গিয়েছেন তাঁর মাতৃভূমি রোমানিয়ায়, সেখানে তৈরি করেছেন সে দেশের প্রথম তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজের উপযুক্ত পরীক্ষাগার। ততদিনে তিনি কাজ করেছেন আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে, যেমন কৃত্রিম বৃষ্টিপাত বা ভূমিকম্প আর বৃষ্টিপাতের মধ্যে সম্পর্ক। কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে তিনি কেন আরও বেশি করে লেগে রইলেন না, সেটা একটা রহস্যময় ব্যাপার।
অবশ্য কুরি-কন্যার নোবেল পাওয়ার এক বছরেরও বেশি আগে, জুলাই ১৯৩৪-এ মারা গিয়েছিলেন মারি কুরি। তেজস্ক্রিয় রশ্মির মারণ আঘাতই প্রাণ কেড়েছিল তাঁর। সেই বছরেরই প্রথম দিকে জানুয়ারি মাসে অসুস্থ মারি কুরি দেখেন তাঁরই ইনস্টিটিউটে আবিষ্কৃত হচ্ছে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা তাঁরই মেয়ে-জামাইয়ের হাতে। অথচ এর অন্তত দশ বছর আগেই যে তাঁরই এক ছাত্রী কাজটা করার পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন, সে কথা তিনিও উল্লেখ করেননি কোথাও।
কুরি-কন্যার নোবেল পাওয়ার ন-বছর পর ১৯৪৪ সালে মৃত্যু হয় স্তেফানিয়ার। তাঁরও মৃত্যুর কারণ ক্যানসার, যার পিছনে মূল কারণ অবশ্যই তাঁর অতি মাত্রায় তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে নাড়াচাড়া করা। শিক্ষক-ছাত্রী অন্তত এই একটা ব্যাপারে শেষ অবধি এসে মিলেছিলেন এক বিন্দুতে।
***********************
নবীনানন্দ সেন।
এতাবৎ আমার অজানা অতি মূল্যবান তথ্য জানলাম। আলোকিত হলাম। ক্ষুব্ধ-ও হলাম শিক্ষকের অনৈতিকতার কথা জেনে। এ দেশে তো বটেই, বিশ্বজুড়ে এই অন্যায় অবিচার আজও চলেছে; ব্যতিক্রমী শিক্ষক সংখ্যায় নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় তা দেখেছি, এবং জেনেছি। এই সুলিখিত নিবন্ধের জন্য লেখিকা কে এবং "সিলি পয়েন্ট" কে ধন্যবাদ।
নবীনানন্দ সেন।
এতাবৎ আমার অজানা অতি মূল্যবান তথ্য জানলাম। আলোকিত হলাম। ক্ষুব্ধ-ও হলাম শিক্ষকের অনৈতিকতার কথা জেনে। এ দেশে তো বটেই, বিশ্বজুড়ে এই অন্যায় অবিচার আজও চলেছে; ব্যতিক্রমী শিক্ষক সংখ্যায় নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় তা দেখেছি, এবং জেনেছি। এই সুলিখিত নিবন্ধের জন্য লেখিকা কে এবং "সিলি পয়েন্ট" কে ধন্যবাদ।