ভালো খবর

হাতে গড়া নৌকো : চারটি গাছের নীচে এক রূপকথার ইস্কুল

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় July 22, 2020 at 8:20 am ভালো খবর

আলেক্সেই মারেসিয়েভের গল্প সারাক্ষণ তাড়া করত মিসেস জিখালিকে। গল্প নয় আসলে। জ্যান্ত রূপকথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়ার একজন যুদ্ধবৈমানিক ছিলেন মারসিয়েভ। বিমান দুর্ঘটনায় বাদ পড়ে দুটি পা-ই, তবু তিনি উড়াল দেন আকাশে। রূপকথা আসলে মশালের মতো। হাত থেকে হাতে, বুক থেকে বুকে পাচার হয়ে যায় নিষিদ্ধ ইস্তেহারের মতো। হার না মানা জেদের মশাল আফ্রিকার নোমুসা জিখালির হাতে তুলে দিয়েছিলেন রাশিয়ার মারেসিয়েভ। সেখান থেকে রচিত হল আর এক রূপকথা, যার নাম ‘এনকোমো প্রাইমারি স্কুল’।

দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানরত কাওয়াজুলু-নাটাল নামক এক প্রত্যন্ত গ্রাম। চরম দারিদ্রতার দরুণ আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে একদম শেষের সারিতে নাম লেখানো গ্রামটিতে কোনরকম প্রথাগত শিক্ষার ব্যাবস্থা পৌছয়নি এতকাল। অধিকাংশ মানুষই কর্মহীন যেখানে দিনের পর দিন,প্রথাগত শিক্ষা সেই মানুষ গুলোর কাছে খানিকটা বিলাসিতাই বটে। কিন্তু ওই যে আলেক্সেই মারসিয়েভের সেই উজ্জ্বল চোখটা তাড়া করে চলেছে। তাই হাল ছাড়েননি মিসেস জিখালি ও তাঁর ভলান্টিয়াররা। ১৯৯৮ সালে মাত্র ৬০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে চারটি গাছের নীচে শুরু হয় এনকোমো প্রাইমারি স্কুল। নাছোড়বান্দা আশা আর ইচ্ছেশক্তি ছিল এগিয়ে চলার পুঁজি। কেবলমাত্র এই মূলধনে ভর করে এগিয়ে চলা মিসেস জিখালি চেয়েছিলেন সেই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত ও পূর্ণ বিকাশ। শুরু হয় স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। হোঁচট খাওয়া, পড়ে যাওয়া এবং আবার উঠে দাঁড়ানো। চলার পথ মোটেও সুগম ছিল না। প্রত্যেক দিন প্রায় ১০ কিমি পথ অতিক্রম করে,এক ভয়বহ নদী পেরিয়ে হাতে গড়া একটা পল্কা ছোট্ট নৌকো ৩৫ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে একাধিকবার পাড়ি দেয় স্কুলের উদ্দেশ্যে। মারসিয়েভ যে স্বপ্ন, যে আশা ভরে দিয়েছিলেন মিসেস জিখালির চোখকে, ধীরে ধীরে সেই স্বপ্ন, সেই আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে নায়ে বসা সেই ৩৫ জনের চোখে, মাত্র ৪ টি গাছের তলায় বসে থাকা ৬০ জন শিশুর চোখে। মরা গাঙে বান নিয়ে আসতে পেরেছে ওই ৬০ জন , ‘মাভৈ’ বানান করতে শিখেছে ওরা, তরী ভাসছে। ১৯৯৯ সালে এই স্বপ্নের মুকুটে যোগ হয় এক নতুন পালক। দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু জনগোষ্ঠী স্কুলটির উন্নতিকল্পে এক নতুন প্রস্তাব আনে। স্কুলটিকে উন্নত জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। মাত্র ৪ টি গাছের তলায় যে পথ চলা শুরু হয়েছিল, তা উঠে আসে পাকা বাড়িতে। আর আজ সেই নতুন পাকা বাড়িতে ১৯ টি ক্লাসরুম। ছাত্রসংখ্যা ৯৬০। ৯৬০ জোড়া স্বপ্নালু চোখ। ৬০ থেকে ৯৬০।

মিসেস জিখালী তাঁর সোনার কাঠির ছোঁয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার এক প্রত্যন্ত গ্রামকে গড়ে তুলেছেন এক স্বপ্ন লালনের কারখানা রূপে। যে ভালোবাসায় ভর করে তিনি শিক্ষাকে পৌছে দেওয়ার ভার নিয়েছিলেন, তা এখন কাওয়াজুলু-নাটালের আপামর মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে সুস্থ, স্বাভাবিক, উন্নততর এক জীবনের রুটম্যাপ। আমাদের এখানেও তো অনেকে অপেক্ষা করে রয়েছে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, কিংবা দার্জিলিং-এর চা বাগানে - 'মাভৈ' বানান শিখবে বলে। মিসেস জিখালীর মতো কেউ কেউ পথ কাটছেন এখানেও। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। এই আকালেও।

#ভালো খবর #এনকোমো প্রাইমারি স্কুল #জিখালি #দক্ষিণ আফ্রিকা #সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় #স্কুল #ভিন্ন ধারার স্কুল #শিক্ষা

  • PRATIK MAZUMDAR
    July 23, 2020 at 8:46 am

    “I don't remember the last time I read something as good as this . This make me think deep about everything. My words won't be enough.

  • Anita Patra
    July 23, 2020 at 6:07 am

    এইসব খবর পড়ে খুব আশাবাদী লাগে। ধন্যবাদ লেখিকাকে। এরকম লেখা আরও লিখুন।

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

12

Unique Visitors

225508