বড়দা
ভাঙা মন নিয়ে ফিরে যাচ্ছে দুটি ছেলে। এক প্রথিতযশা লেখকের কাছে সাহিত্যসম্মেলনে সভাপতিত্বের আর্জি জানিয়ে শেষ অবধি সম্মতি মেলেনি। জায়গাটা একটু দূর, উত্তরবঙ্গে। শুরুতে সাহিত্যিক রাজি হয়েছিলেন বটে, তবে নানা শর্ত ছিল। অল্প পুঁজির সাধ্যে সে আয়োজন সম্ভব নয়। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ এক ডাক শুনে পিছু ফিরল ছেলেদুটি। গড়পড়তা চেহারায় অতিসাধারণ জামাকাপড় পরা এক ব্যক্তি খানিক এগিয়ে এসে বললেন, ‘শোনো একটা কথা বলি, আমি গেলে কি তোমাদের কাজ হবে? আমাকে তোমাদের কিছুই দিতে হবে না। দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট দিয়ে নিয়ে গেলেও হবে।’ ওরা খানিক ইতস্তত করছে দেখে সেই মানুষটি আবার বললেন, ‘তোমরা আমাকে চেনো না, তবে হয়তো আমার একটি বই আছে শুনে থাকবে---‘পথের পাঁচালী।’ ছেলে দুটি হতভম্ব দশা কাটিয়ে তাঁকে প্রণাম করে বলল, ‘এ তো আমাদের মহাসৌভাগ্য! উনি না যাওয়াতে আমাদের আরও ভালো হোল।’
'এই ছেলেটি ব্যবসায় নতুন নেমেছে, একে কিন্তু আপনি একখানা বই দেবেন।' অচেনা ভদ্রলোকটি যে খোদ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তা গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য বুঝবেন কী করে? একুশ বছর বয়েস তখন, প্রকাশনা ব্যবসায়ে সদ্য হাত পাকাচ্ছেন। সঙ্গে আছে গজেন্দ্রকুমার মিত্রের তালিম। এমন সময় মিত্র ও ঘোষের বইয়ের দোকানে আচমকা এভাবে আলাপ হয়ে যাবে কে জানত! সাধারণ হাফশার্ট পরা মানুষটিকে দেখে খ্যাতির আন্দাজ পাওয়া মুশকিল। গৌরীশঙ্কর পারলে তখনই চুক্তি করে নেন, যদিও সামর্থ্য অল্প। একদিন বুক ঠুকে মীর্জাপুর স্ট্রীটের মেসে হাজির হয়ে বলেই ফেললেন, ‘কন্ট্রাক্ট কবে হবে? কত টাকা দিতে হবে একটু বলুন না। আমাকে ত তৈরি হতে হবে!’ শুনলেন, ‘...ও নিয়ে ব্যস্ত হবার কিছু নেই। দ্যাখো বাপু, লেখার আগে টাকা-পয়সার কথা কইলে লেখা খারাপ হয়ে যায়।’ তিনি তখন খেলাতচন্দ্র ইন্সটিউশনের শিক্ষক। পরে ইস্তফা দিয়ে স্বাধীনভাবে লেখা-পড়ার ইচ্ছেয় দেশের বাড়ি চলে যান। একদিন সেখানেও হাজির গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য। সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন উপন্যাসের প্রথম দফার পান্ডুলিপি। নাম ‘ক্লার্কওয়েল সাহেবের ইস্কুল’। পরে গজেন মিত্র যাঁর নাম বদলে রাখেন, ‘অনুবর্তন’।
খ্যাতিকে কখনও মাথায় চড়তে দেননি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। অনায়াসে মিশে গেছেন মানুষের মধ্যে। গাঁয়ের হাজারী জেলের থেকে বিড়ি চেয়ে খেয়েছেন, বাজারে নিতাই মুচির পাশে তারই হুঁকো খেতে খেতে গল্প জুড়েছেন। লোকের কথায় কান দেননি। বড়রা বকলে তর্ক না করে হাসিমুখে পরিস্থিতি সামাল দিতেন। সমবয়সী বা ছোটরা বললে বলতেন, ‘অমন ঠুনকো পেস্টিজ আমার দরকারে পড়ে না...তোরা তোদের অই ঠুনকো পেস্টিজ নিয়েই থাক। দেখিস আমি যখন মরবো না! সারা পৃথিবী জানবে এই বিড়ি চেয়ে খাওয়া লোকটা আজ মরেচে---’। যেখানেই তিনি গেছেন, সেখানেই জমেছে আড্ডা। প্রবোধকুমার সান্যাল, সুমথনাথ ঘোষ, গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য প্রমুখেরা তার সঙ্গী। তাঁকে ছাড়া মিত্র ও ঘোষ-এর জমায়েত অসম্পূর্ণ। বাইরে স্নেহের আধার,ভেতরে স্নেহের কাঙাল। সবার প্রিয় ‘বড়দা’।
পুত্রবধূ মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিচারণায় মনে করিয়ে দেন, ‘সবাই ভীষণ ভালোবাসতেন। আর সাহিত্যিক মহলে তো সবাই বড়দা বলতেন। এত শ্রদ্ধা করতেন , এমন ছিল যে, শ্বশুরমশাই নিজে জুতোর দড়ি বাঁধতে পারতেন না, গিঁট লাগাতে পারতেন না, খুলতে পারতেন না—এরকম ব্যাপার ছিল। হয়তো দেশের বাড়ি থেকে আমার শাশুড়ি ঠাকরুণ জুতো বেঁধে দিয়েছেন। আবার ঢাকুরিয়াতে গজেন্দ্রকুমার মিত্র, লেখক—তাঁর যে বাড়ি ছিল, সেখানে গেছেন, তাঁর স্ত্রী কিন্তু সেই জুতোটা খুলে দিতেন। মানে তাঁরা এত শ্রদ্ধা করতেন, যে এতে কিন্তু তাদের কোনো আপত্তি ছিল না, আবার তিনি বেঁধে দিলেন আসার সময়, ফিরে শাশুড়ি ঠাকরুণ খুলে দিলেন। এরকম ছিল।’
বন্ধু নীরদ চন্দ্র চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘...শিশুসুলভ দুর্বলতা তাঁহার মধ্যে পরিলক্ষিত হইত।ইহা তাঁহাকে আরও প্রিয়তর করিয়া তুলিত।’ পথের পাঁচালী-র প্রথম কপিটি সজনীকান্ত দাসকে দিয়ে নিজের নামের পরিবর্তে লিখেছিলেন, ইতি ‘অপু’।
মনের বয়সে তিনি অপু। আজীবন।
#বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় #জন্মদিন #ব্যক্তিত্ব #স্মরণ #Birthday #Bibhutibhusan Bandopadhyay #Remembrance #শৌভিক মুখোপাধ্যায়