ভুলে যাওয়া ছোটবেলা আর মনে রাখার বিজ্ঞান

স্মৃতি এক আজব বস্তু। যতক্ষণ অবধি সে আমাদের সঙ্গ দেয়, আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম এতই স্বচ্ছন্দে চলে যে তার প্রয়োজনীয়তা আলাদা করে টেরও পাওয়া যায় না। কিন্তু সে বিগড়োলেই আমরা ব্যাকফুটে। তখন রোজনামচায় মাথা চুলকানো আর হোঁচট লিখতে হয়। চেনা মানুষ, চেনা ঘটনা অচেনা হয়ে পড়ে, এমনকি স্মৃতি গোলমাল করলে নিজের সন্তান কী কাজ করে তাও মনে রাখা দায় হয়! তবে এ আলোচনার বিষয় বিস্মৃতি নয়, শুধুই স্মৃতির সীমানা।
আচ্ছা, ভেবে দেখুন তো, ছোটবেলার প্রথম কোন ঘটনার কথা আপনার সবচাইতে ভালো মনে আছে! খেলতে গিয়ে আছাড় খাওয়া, কিংবা অন্য কোনও দুর্ঘটনা? কারও কোলে চেপে শোনা গানের সুর, নাকি প্রথম চিড়িয়াখানা ঘুরতে যাওয়া? ঠান্ডা মাথায় ভাবলে দেখবেন, যতই পিছনে যান, দুই-তিন বছর বয়সের আগে পৌঁছতে পারছেন না। অর্থাৎ একেবারে কচি বয়সের কোনও স্মৃতি আমাদের থাকে না। যেটুকু থাকে তার বেশিরভাগটাই আসলে মা-দিদিমার মুখে শোনা সেই বয়সের গল্প আর তার সঙ্গে আমাদের কল্পনাশক্তির মিশেল। কিন্তু এমনটাই বা হয় কেন? একেবারে ছোট্ট বয়সে কি তাহলে কোনও স্মৃতিই তৈরি হয় না? নাকি বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাই ভুলতে থাকি একেবারে গোড়ার কথা?
শৈশবের শুরুর কথা আমরা মনে না রাখতে পারলেও (এটার একটা গালভরা নামও আছে, infantile amnesia) শিশুরা কিন্তু স্মৃতি গড়ে তুলতে সক্ষম। শুধু সেই স্মৃতি পরিণত মানুষের মতো আত্মজৈবনিক নয়, বরং ঘটনা-নির্ভর। জন্মের কিছুদিন পর থেকেই শিশুরা নতুন মুখের ভিড়ে মায়ের মুখ চিনে নিতে পারে। দিন গড়িয়ে মাস হলে তারা রোজকার পরিচিত মুখগুলিকেও মনে রাখতে পারে। এছাড়াও মাস ছয়েক বয়সের পর থেকেই তারা রপ্ত করে নেয় কিছু অভ্যাসগত স্মৃতি, যেমন উঠে দাঁড়ানোর বা উঁচু জায়গায় ওঠার কায়দা, ভাষার পরিচয় ইত্যাদি। বিজ্ঞানীদের মতে, এই সমস্ত স্মৃতিই আসলে আমাদের সার্বিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে মিশে যায়, তাই এদের আমরা আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারি না। এই প্রসঙ্গে আশি-নব্বই দশকের একটি বৌদ্ধিক গবেষণার উল্লেখ না করলেই নয়। গবেষকের নাম ক্যারোলিন রোভি-কোলিয়ের, এক বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী। তিনি ও তাঁর সহকারীরা বিভিন্ন বয়সী শিশুদের দৈনন্দিন কান্ডকারখানা জরিপ করে বেশ কিছু সমীক্ষা করেন, যার থেকে উঠে আসে চমকপ্রদ কিছু তথ্য। শিশুদের পক্ষে তো আর নিজেদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তাই গবেষকরা মাথা খাটিয়ে বের করেছিলেন এমন কিছু খেলা যার মাধ্যমে একটা টানা সময় ধরে শিশুদের বৌদ্ধিক বৃদ্ধিকে মাপা যায়। একেবারে পুঁচকে, অর্থাৎ দুই থেকে ছয়মাস বয়সী বাচ্চাদের একটা সাধারণ প্রবণতা হল বিছানায় শুয়ে হাত-পা ছোঁড়া; এই দাপাদাপির পরিমাণ কিন্তু সব বাচ্চার ক্ষেত্রে একরকম নয়। ক্যারোলিন প্রথমে বেশ কিছু শিশুর দোলনা-খাটের উপর একটা খেলনা ঝুলিয়ে তাদের এই স্বাভাবিক পা ছোঁড়ার একটা জরিপ করলেন, তারপর তাদের প্রত্যেকের পায়ের সঙ্গে আলগা একটা সুতো বেঁধে দিলেন ওই খেলনা অবধি। এবার পা দাপালেই খেলনা নড়তে থাকল। বাচ্চারাও খুব তাড়াতাড়ি বুঝে গেল যে এক্ষেত্রে তারাই নিয়ন্ত্রকের আসনে – বেশি করে পা নাচালেই খেলনা নাচবে। হলও তাই, প্রত্যেকটি শিশুর পা ছোঁড়ার পরিমাপ গড় হারের চেয়ে বেশ খানিকটা বেড়ে গেল। অর্থাৎ, প্রত্যেকেই নিজেদের অভ্যাসগত স্মৃতিতে ঘটনাটা দিব্যি ধরে রাখতে পারছে। স্মৃতির সঙ্গে পরিচয় শুরু হতে তাহলে বয়স কোনও বাধা নয়।
দ্বিতীয় পরীক্ষাটা হল ছয়মাস থেকে দেড়বছর বয়সী বাচ্চাদের নিয়ে। এই বয়সের বাচ্চারা দোলনায় শুয়ে থাকার চাইতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়াই বেশি পছন্দ করে, তাই গবেষণার ধরনও পাল্টাল সেই মতো। মা-বাবার কোলে বসিয়ে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল একটা খেলনা হাতল বা লিভার। তাতে চাপ পড়লেই মেঝেতে বিছানো লাইন জুড়ে রেলগাড়ি চলতে শুরু করবে। শুধু মজাটা হল, হাতলে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় চাপ পড়লে তবেই সে গাড়ি চালু হবে, তার চাইতে কম চাপে সে নড়বে না। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল কমবেশি সব শিশুদেরই, তারপর সবাই শিখে নিল খেলতে হলে কতটা চাপ দিতে হবে। গবেষকরা প্রথমে মাপলেন শিশুদের স্বাভাবিক বলপ্রয়োগের ক্ষমতা, তারপর মাপলেন রেলগাড়ির কু-ঝিকঝিক দেখার জন্য তাদের অর্জিত বলপ্রয়োগের মাত্রা। আসল ধাপ এল এরপরে, নির্দিষ্ট দিনের ব্যবধানে এই সব শিশুকে আরও একবার জড়ো করলেন গবেষকরা। তারপর বয়স অনুযায়ী তাদেরকে আবার দোলনায় টাঙানো খেলনা বা ট্রেন চালানোর হাতল ধরিয়ে দেখলেন, তারা এখনও তাদের শেখা অভ্যাস মনে রাখতে পেরেছে কিনা। সেই প্রথমবার কিছু চেনা ঘটনার বৈজ্ঞানিক নির্মাণ পোক্ত হল। ক্যারোলিন ও তাঁর সহকারীদের গবেষণায় দেখা গেল, ছয়মাস বয়সী কোনও শিশুকে এক মিনিট ধরে কোনও বিষয় শেখালে সে একদিন পরেও সেটা মনে রাখতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখার ক্ষমতাও বাড়ে। আরও দেখা গেল, যত বেশি সময় ধরে কোনও বিষয় অভ্যাসের মাধ্যমে বাচ্চাদের শেখানো যায়, ততই তারা আরও ভালভাবে সেটা মনে রাখতে পারে। মনে রাখার ক্ষমতা আরও বাড়ে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর স্মৃতিকে একবার ঝালিয়ে নিলে। অর্থাৎ, আপনা থেকে রেলগাড়ির চলা বা খেলনার দুলুনি দেখালে শিশুদের অভ্যাসের স্মৃতি আরও চাঙ্গা হয়। জন্মের কয়েকমাস পর থেকেই স্মৃতি তৈরিতে বা তাতে শান দিতে বাচ্চাদের কোনোই অসুবিধা হয় না।
তাহলে এমনটা শুধু শেখানো অভ্যাসের ক্ষেত্রেই কেন? নিজের ব্যাপারে কোনও কথাই কেন মনে রাখতে পারি না আমরা? ক্যারোলিনের গবেষণায় তার উত্তর না মিললেও পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা এর কিছু সম্ভাব্য কারণ বলেছেন। তার মধ্যে একটা বড় কারণ হল, অত ছোট বয়সে আমাদের ভাষাজ্ঞান জন্মায় না। যেহেতু নিজস্ব কোনও ভাষা নেই, তাই নিজেকে ঘিরে ঘটে চলা সবকিছু সম্পর্কে কোনও বিবরণ তৈরির ধারণা নেই। আর বিবরণ থাকে না বলেই কোনও ঘটনাকে ফিরে দেখার উপায়ও নেই। আর একটা কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলেন, ছোটবেলায় আমরা নিজেদের ব্যাপারে খুব একটা সচেতন থাকি না। আত্মজৈবনিক স্মৃতির নির্মাণে এইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। ভেবে দেখুন, আপনি যদি নিজের আচার-ব্যবহারকে অন্যদের ভালোলাগা-মন্দলাগার সাপেক্ষে বিচার নাই করতে পারেন, তাহলে নিজের আচরণ নিয়ে আপনার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা না থাকাই স্বাভাবিক! বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়। খুব সহজ একটা পরীক্ষার মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানীরা সেটা দেখিয়েছেন। কিছু বাচ্চার নাকে লিপস্টিক কিংবা ব্লাশার দিয়ে লাল রং করে তাদের একটা আয়নার সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়। দেড় বছরের নিচের বাচ্চারা আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে অবাক হয়, মজা পায়, কিন্তু নাকের লাল রং নিয়ে কিছুমাত্র চিন্তিত হয় না। দেড় থেকে দুইবছর বয়সী বাচ্চারা কিন্তু প্রতিবিম্ব দেখামাত্র নিজেদের নাকে হাত দেয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে লজ্জাও পায়, অর্থাৎ তাদের মনে নিজের সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে এবং একটা লাল টুকটুকে নাক যে সেই ধারণায় খাপ খায় না, সেই ব্যাপারে তারা দিব্যি সচেতন। মনে করে দেখুন, ক্যারোলিনের গবেষণা কিন্তু দেড়বছর বয়সের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল! অতএব, সচেতনতার ধারণা নিশ্চিতভাবেই ওই বয়সের আগে গড়ে ওঠে না। অবশ্য এই সমস্ত মনোবৈজ্ঞানিক যুক্তির সমর্থনে আলাদা কোনও শারীরবৃত্তীয় প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি, কেবল একটি ছাড়া। মস্তিষ্কের যে অংশটি স্মৃতি গড়তে এবং জমাতে মুখ্য ভূমিকা নেয়, সেই হিপোক্যাম্পাস অঞ্চল, শৈশবের একটি নির্দিষ্ট সময় অবধি পূর্ণ ক্ষমতায় বিকশিত হয় না।
অতএব গবেষণা চলবে, যতদিন না স্মৃতির রহস্য পুরোপুরি ভেদ করা সম্ভব হচ্ছে। ততদিন অবধি কেউ যদি আপনাকে দেখে বলে, “ও মা! সেই কোন ছোট্টবেলায় তোকে দেখেছিলাম, আমার হাত ধরেই তো তুই প্রথম হামাগুড়ি দিলি। মনে আছে?” – নির্দ্বিধায় তাকে জানিয়ে দিন, সে কাজে আপনি বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই অপারগ।
******************************************************
তথ্যসূত্র: In memoriam - Carolyn Rovee-Collier, Rutgers Today.