ভয়
নাম ‘অভয়’ হলেও ভয় শব্দটাই অভয়বাবুর জীবনকে আদ্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করছে। সকালে ঘুম ভাঙলেই পাশে তাকিয়ে দেখে নেন বউ অমিতা আর মেয়ে অনুষ্কার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক কি না। মোদ্দা কথা হল তারা বেঁচে আছে কি না! পরের দৃষ্টি ধাবিত হয় দরজার দিকে। রাতের কুটুমরা তাঁর দরজা ভাঙেনি দেখে অতি সন্তর্পণে শয্যা ত্যাগ করেন তিনি। এহেন অভয়বাবু যখন সপরিবারে বেড়াতে যান তখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলে বাড়িকে নিরাপদ করার প্রচেষ্টা। স্ত্রী ও মেয়েকে নির্দিষ্ট সময়ের অন্তত চল্লিশ মিনিট আগে অটোস্ট্যান্ডে বিকাশ রক্ষিতের কম্পিউটার সেন্টারের বারান্দায় বসিয়ে রেখে ফিরে আসেন বাড়িতে। সন্দেহ হয় ফাঁকা বাড়িতে কেউ লুকিয়ে নেই তো? সব ঘরের খাটের তলা, টেবিল, আলমারি ও ফ্রিজের পিছনে, নীচে, বাথরুমের চৌবাচ্চা, চালের ড্রাম, ঢাকনা দেওয়া জলের বালতি সর্বত্র সরেজমিনে তদন্ত করার পর বন্ধ জানালার পর্দার পিছনে এবং ক্যালেন্ডারের পাতা সরিয়েও দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে এক লাফে দরজার বাইরে আসেন। পাছে কেউ পায়ের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে যায় তাই এই লম্ফনটা প্রয়োজন! তারপর দু-দুটো তালা দরজায় লাগিয়ে সেগুলো ধরে ঝুলে পড়েন। যদি আলগা থাকে আর চোর এসে হাত দিলেই খুলে যায়!
এই নিরীহ ভিতু মানুষটা কারো সাতে এবং পাঁচে থাকেন না। অভয়বাবুর দিন চলে বাঁধা রুটিনে। ভোর পাঁচটায় উঠে ত্রিফলার জল সপ্তাহে তিন দিন। বাকি চারদিন নিম আর তুলসী পাতা চিবিয়ে দু গ্লাস জল খেয়ে ছাদে পায়চারি করেন। শত বলে বুঝিয়েও মেয়ে বউকে তিনি এই ব্যাপারে রাজি করাতে পারেননি। অগত্যা ‘একলা চলো রে’ নীতি নিয়েই সকালের এসব কাজ সেরে তিন কাপ চা করে তিনি বাকি দুজনের ঘুম ভাঙান সাতটা নাগাদ। তারপর টাটকা মাছ, সবজির জন্য বাজারের থলি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর কর্মজীবনটিও বড় সাদামাটা। সরকারি অফিসের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হয়েই কাটিয়ে দিলেন পঁচিশ বছর। সামনের বছর অবসর গ্রহণ করবেন। অফিসের কোনও বড়সাহেব বা ইউনিয়নকে বিশেষ তোয়াজ করেন না বলে এত বছরে একটা প্রোমোশনও পাননি। তবে যেটা উনি নিঃস্বার্থ ভাবে করেন সেটা হল সবাইকে সাবধান করা। পাশের টেবিলের সৌমেনকে বলেন, “বুঝলে ভায়া, এই বাঁচা-মরার মাঝখানে একটা সেতু আছে। খুব সরু। একটু অসাবধান হয়েছ কি পিছলে পড়বে।”
সৌমেন অভয়বাবুর থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট এবং ডাকাবুকো স্বভাবের। সে একটু কাব্য করে বলে, “অভয়দা, আমার তো ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য। চিত্ত ভাবনাহীন’।” আশপাশের টেবিলের লোকেরা অসমমনস্ক দুই সহকর্মীর আপাত গুরুত্বহীন কথায় বেশ মজা পায়। বাঁদিকের টেবিলের মিতালী বলে, “কী করে সাবধান হব বলুন তো, বিপদ কি বলে কয়ে আসে?” অভয়বাবু ঈষৎ গম্ভীর হয়ে বলেন, “তবুও নিজেকে আগাম সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।”
অভয়বাবুর এই আগাম সতর্কতার বহরে ও বাহুল্যতায় সহকর্মীরা, বিশেষত বাড়ির লোকেরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। অভয়বাবু কী করবেন? তিনি যে সর্বদা হোটেল রেস্টুরেন্টের রং মেশানো খাবারে দেখতে পান কিলবিল করছে রোগ জীবাণু। সিরোসিস অফ লিভার, কিডনি ফেলিওর থেকে মাথার মধ্যে সর্বদা লাল অক্ষরে জ্বলজ্বল করতে থাকা ক্যান্সার সব কিছুর কারণ যে এইসব কীটনাশক, কৃত্রিম রং দেওয়া খাদ্যবস্তু, নরম পানীয়, প্লাস্টিকের বাসনপত্র, জলের বোতল, চায়ের কাপ, এমনকি ডাক্তারের দেওয়া কিছু ভুলভাল ওষুধ, সে বিষয়ে নানা পত্রপত্রিকা পড়ে এবং নিজের জীবন অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝে নিশ্চিত হয়েছেন। তার সঙ্গে আছে প্রতিদিনের সংবাদপত্র। চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, নানাবিধ দুর্ঘটনা, এমনকি সোশাল নেটওয়ার্কিং-এর দৌলতে নতুন যোগ হওয়া কিছু বিপদের সম্ভাবনায় শিউরে শিউরে ওঠেন তিনি। তাঁর ভয়ের তালিকাটা দেখে স্বয়ং চিত্রগুপ্তও আঁতকে উঠতে পারেন। তবে সব দোষ কি তাঁকে দেওয়া যায়? এই যেমন এতদিন শুনে আসছিলেন সরষের তেলে রান্না নৈব নৈব চ। সুতরাং রিফাইন্ড অয়েল। আবার একদিন কাগজে দেখলেন সরষের তেল পরিমিত মাত্রায় খেলে ক্ষতির চেয়ে উপকার বেশি। কেউ বলছেন চল্লিশ পেরোলেই খাসির মাংস বর্জন করুন। কেউ আবার বলছেন ইনজেকশন দেওয়া চিকেন না খেয়ে মাসে একদিন মাটন খান। উফ্, মাথা ঝিমঝিম করে তাঁর মাঝে মাঝে। তবে সারাদিন নানা উৎকণ্ঠা এবং দুশ্চিন্তার পাহাড় পেরিয়ে বাড়ি ফিরে স্ত্রী-কন্যার সুস্থ স্বাভাবিক মুখ দেখলেই তিনি উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি গ্রহণ সমাপ্ত করে বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। অভয়বাবু স্ত্রীকে বলেও রেখেছেন মেয়ে চাকরিসূত্রে যেখানে যাবে সেইখানে গিয়ে নতুন করে সংসার পাতার কথা। যতদিন না ভালো পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন, ততদিন তিনজন এক জায়গাতেই থাকবেন এমনটাই ভেবে রেখেছেন তিনি। তাঁর চাকরিও তো হয়ে এল প্রায়।
তবে ওই বিধাতা নামক ব্যক্তিটি অলক্ষে বসে কী যে কলকাঠি নাড়েন! তাতেই সব ওলটপালট হয়ে যায়। সেদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে অভয়বাবু যে মারাত্মক ভয়ে আক্রান্ত হলেন তা তাঁর মাথার মধ্যে অবিরাম সিগনাল দিতে থাকা মৃত্যুভয়কে ম্লান করে দিল। দুদিন পরে মেয়ের জন্মদিন, তাই একটু বেশি কেনাকাটা করে ফেলেছিলেন ফেরার পথে। দুহাত ভর্তি প্যাকেট! কলিংবেল বাজাতে একটু দেরি করায় ঘরের মধ্যে থেকে মেয়ের ফোনালাপ কানে আসে। অপর প্রান্তে সম্ভবত অনুষ্কার একমাত্র মাসি...
রাতে সাধারণত সাড়ে দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন অভয়বাবু। অথচ রাত একটাতেও চোখে ঘুম আসেনি সেদিন। ফুলস্পিডে চলতে থাকা সিলিংফ্যান বেয়ে যেন নেমে আসছে অজানা কিছু সরীসৃপ। টের পাচ্ছেন তাদের হিমশীতল নিঃশ্বাস। ঘরের চাপ চাপ অন্ধকারে কারা যেন ঘিরে ধরছে তাঁকে। কুলকুল করে ঘামছেন তিনি কার্তিক মাসের শেষের হিম আমেজেও।
অন্যদিনের মতো অনুষ্কা চাদরটা জড়িয়ে পাশ ফিরতে গিয়ে বুঝল গায়ে সেটা নেই। চোখ মেলে দেখল পায়ের নীচে ভাঁজ করে রাখা রয়েছে। অথচ ভোররাতে বাবাই তো রোজ ওর গায়ে চাদরটা ঢেকে দেয়। জ্ঞান হওয়া ইস্তক এর অন্যথা হয়নি কখনও। আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে বিছানায় বাবা নেই, আর পরক্ষণেই ‘মা’ বলে আর্তনাদ করে ওঠে, কেন-না সদর দরজা খোলা। অনুষ্কা ছুটে বেরিয়ে যায় বাইরে। কেউ কোথাও নেই। সারা বাড়ি, বাথরুম, ছাদ সব জায়গাই জানান দিচ্ছে অভয়বাবুর অনুপস্থিতি। অথচ এইমাত্র যেন ছিলেন! প্রবল আতঙ্ক গ্রাস করে ওদের। মোবাইলে একের পর এক ফোন করতে থাকে আত্মীয়স্বজন আর অভয়বাবুর সহকর্মীদের।
ওদিকে অভয়বাবুকে তার বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে দেখা গিয়েছিল হাওড়া স্টেশনে। আপাতত তিনি কোনও একটি ট্রেনে উঠে পড়েছেন। তাঁর এই ভয় সংক্রান্ত বাতিক অবসর গ্রহণের পরে বাড়বে আশঙ্কায় অমিতা আর অনুষ্কা কোনও এক মেন্টাল অ্যাসাইলামে তাঁকে ভরতি করার যে গোপন ষড়যন্ত্র করেছে এটা সেদিন তাড়াতাড়ি অফিস থেকে না ফিরলে জানতেই পারতেন না তিনি। এমনকি প্রয়োজনে ‘মা’ ‘মেয়ে’ আলাদা থাকার পরিকল্পনাও করেছে ভেতরে ভেতরে। এত অসহ্য, এত অপাঙক্তেয় হয়ে উঠেছেন তিনি তাঁর সবচেয়ে আপনজনদের কাছে! তাই রাতারাতি সব সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছেন তিনি। অফিসে যা পাওনা ছুটি আছে, তাতে আর বছরখানেক না গেলেও কোনও অসুবিধে হবে না আশা করা যায়। বউ মেয়ের কোনোরকম আর্থিক সংকট যাতে না হয় তার যাবতীয় ব্যবস্থাসহ সবিস্তারে লিখে এসেছেন চিঠি। যেটা খানিকক্ষণ পরেই ওরা পেয়ে যাবে বালিশের নীচে। শুধু তাঁর নিজের সম্পর্কে কোনও তথ্যই সেখানে নেই। এমনকি রেখে এসেছেন ফোনটিও। ট্রেন ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। তীব্র ঝাঁকুনি আর প্রচণ্ড শব্দে অতীতে চোখের পাতা বন্ধ হত না অভয়বাবুর। বেড়াতে যাওয়ার সময় মেয়ে বউকে পাহারা দিতেন অতন্দ্র প্রহরী হয়ে। ভয় পেতেন ট্রেন দুর্ঘটনার। অথচ সেই অভয়বাবু, যাঁকে আত্মীয় বন্ধু ও সহকর্মীরা আড়ালে আবডালে ‘ভয় বাবু’ বলে ডাকে, এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন অকাতরে। এই প্রথম নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে...