গল্প

জনক

তানিয়া Aug 30, 2020 at 3:58 am গল্প

দিন সকলের সমান যায় না। বাড়ির মাটির দাওয়ায় আজ সকালে তরতাজা এক বাটি মুড়ি দেখে এই কথাই মনে হল জগন্নাথের। জগন্নাথ নস্কর। বয়স ২৮। বন্ধুর বিয়ের পাঞ্জাবি ধার করে এনে সদ্য দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসেছে। দুকুর বউ এক বাটি মুড়ি খেতে দিয়ে গেছে। উঠোনের ধারে যেখানে জবাগাছের  পাশে পালং, ধনেপাতা গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, সেখানে সকালের রোদ এসে জাঁকিয়ে বসেছে। এই  রোদের সাথে জগুর বহুকালের দোস্তি। সেই ছোট্টবেলায়, বাবা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেত কোন ভোরে, আধো অন্ধকারে। জগু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক খোঁজে তবু এখনো কোনো আলোর হদিশ সে পায় না। মা পান্তার এঁটো থালা সরিয়ে নিত আর ন্যাতা লেপতে লেপতে জগুকে ডাকত, 'ওঠ, ওঠ, মাঠে যাবিনে?' তখন মাঠে মায়ের সাথে খেতমজুরের কাজ করত জগু। বয়স পাঁচ। উঠোন পেরিয়ে, বাঁশবন ছাড়িয়ে, কলাবাগানের অন্ধকার ঝোপ পিছনে ফেলে যে পথ সোজা মন্ডলদের জমির দিকে গেছে, সেটা শুধু কাঁচা মাটির পথ নয় জগুর কাছে। ওখান থেকে যেতে যেতে ও প্রতিদিন ভোর হওয়া দেখত, গোল লাল চাকতির মতো সুয্যিমামাকে দেখত আর অবাক হয়ে ভাবত, মা তাড়া লাগাত কিন্তু ও কিছুতেই আলোর থেকে মুখ ফেরাতে পারত না। জগু এখন বুঝেছে, এই পথ না পেরোলে তার জীবন হয়তো এরকম হতই না। সেও কি তবে বাবার মতো, পান্তা খেয়ে আধো অন্ধকারে বেরিয়ে যেত! তার যে অন্ধকারকে বড়ো ভয় করে। 'কি রে? একনো খাসনে?' পদ্মার গলার আওয়াজে, বাঁশবন আর কাঁচা রাস্তা ছেড়ে জগু এসে পড়ল স্টিলের মুড়ির বাটির সামনে। কী ফেলে এল জগু?একটা পুরোনো জং ধরা রডওয়ালা সাইকেল। আর? আর কিছু নয়?...

নয়?...

'আজ দুকুরে বাটা মাচের ঝোল আর ভাত। টেরেন কটায় আজ?' জগুর কোনো উত্তর না পেয়ে, পদ্মা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে । বছর আটত্রিশের পদ্মা, দুকুর বউ। দুকু জগুর বাবা। ব্যস।


হুমম, শুধু এই অস্ফুট আওয়াজ দিয়ে আবার মুড়ি খাওয়ায় মন দিল জগাই। শীত এখন বৃদ্ধ, সেই তেজ নেই, তবে মাঝে মাঝে রোঁয়া ফোলায়। ভোররাতের অন্ধকার উঠোনে থাবা বসায়, বাঁশবনের কুয়াশাকে বশে রাখতে চায়। কিন্তু পারে না। জগু এই সব কিছু বোঝে। আর খুব ভাবে। ভেবে ভেবে, না খেয়েও ও একবেলা কাটিয়ে দিতে পারে ছোট থেকেই। দুকুর বউ উনানে আঁচ দিয়েছে, এবার জগু একটা গ্যাস নিয়ে নেবে । ও পারবে। ও জানে ও পারবে কীভাবে জ্বালিয়ে দিতে হয়, আর পদ্মাকে ও শিখিয়ে দেবে।

বেলা বাড়ছে আস্তে আস্তে। পুঁটি এসে দাঁড়িয়েছে পদ্মার উনানের ওপারে, পুঁটিকে দেখলে কেমন চমকে ওঠে পদ্মা এখন। কে জানে কেন! জগুও বুঝতে পারে না। এ ছাড়া জগু অনেক কিছুই বুঝতে পারে। কুয়োর জলে দুপুরের রোদ এসে পড়ে, সেই জলে স্নান করে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় জগন্নাথ। না, সব ঠিক আছে। এই তো চোখ, এই তো নাক, এই তো ঠোঁট । কই? কোথাও কিছু অবিশ্বাস্য নয় তো। তবে কেন? কেন তবে আজ নিজেকে বড়ো অচেনা লাগছে!

শহুরে, গণ‍্যমান্য অতিথিদের সামনে বেচারা একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। প্রথমবার। তাও আবার বন্ধুর বিয়ের পাঞ্জাবি, যদি স্টেজে উঠতে গিয়ে খোঁচা খেয়ে ছিঁড়ে যায়, তবে কি সুভাষ রাগ করবে? আর ওর  বউ সুপর্ণা তো ওকে ভাইফোঁটা দেয় প্রতিবার আর দুটো করে বই। এইসব ভাবতে ভাবতে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ায় জগু। এত আলো, চোখ ধাঁধিয়ে যায় ওর। বেচারা। লন্ঠন আর সূর্যের আলো এই দেখেই কৈশোর  কাটিয়েছে, আর এখন বছর পাঁচেক গাঁয়ে ইলেকট্রিক এসেছে। তাও ওদের ওখানে ভোল্টেজ কম। আর একটা আলো দেখেছিল না জগু একবার ,অনেক অনেক দিন আগে ওই বাঁশবনে। সেটাকে কী বলে? আজ বাড়ি গিয়ে পদ্মাকে জিজ্ঞেস করবে জগু। প্রথম মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে থতোমতো খেয়ে যায় ছেলেটা। তাও বলে যেটুকু বলার। বাবা, মা, শিক্ষক, বন্ধু- সবাই যা বলে আর কি! ব্যতিক্রম কিছু না। তবে এর সাথে ও জুড়েছে ওদের ছাগলের ছা-টাকেও। অনুষ্ঠান শেষে ফিশফ্রাই খেয়েছে, সই দিয়েছে, চেক নিয়েছে, আরো ফোন নং আরো উপহার সব একে একে ঝোলায় ভরেছে। তারপর রাতের অন্ধকারে স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। শেষ ট্রেন ধরবে না আজ। শেষের আগেরটা ধরবে।

জগুর মা পদ্মা জগুর আসল মা নয়। সেই মা বিষ খেয়েছে যখন জগুর বয়স সাত। জগু তখন সদ্য অ আ শিখছে। হ্যাঁ ঠিকই। ওর পড়াশোনা হত না। ওর মা বিষ না খেলে ওকেও দুকুর মতো ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বেরোতে হত পুরোনো ভাঙা জিনিস বিক্রির জন্য। অবশ্য জগু এখনো তাইই করে, বাতিল, ভাঙাচোরা মানুষগুলোকে নিয়ে ব্যবসা করে। ওর এরকমটাই মনে হয়। এই যে লিখে চলা, গল্প তৈরি করা, সবেতেই সেই মানুষগুলোর ভিড়। কলেজ স্ট্রিটের নামী প্রকাশক বই ছাপতে চেয়েছে, প্রেমের উপন্যাস হতে হবে। জগু ফিরিয়ে দিয়েছে। ও পারবে না। ও প্রেমের উপন্যাস কখনোই লিখতে পারবে না। ও জানেই না প্রেম মানে কী! ও চেনে শুধু বাঁশবাগানের সেই অদ্ভুত আলো, যার থেকে বাড়ি ফিরে এলে বিষ খেয়ে নিতে হয়। যেমন ওর মা খেয়েছিল সেদিন। আধো আধো মনে পড়ে ওর সেই লড়ঝড়ে একটা সাইকেল। দিদা যখন খুব কাঁদছিল, গ্রামের নিরঞ্জন মাস্টারমশাই এসেছিল ওদের বাড়িতে। ওকে কোলে নিয়ে খুব আদর করেছিল আর পরের দিন এসে সবার সামনে থেকে ওকে নিয়ে গিয়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভরতি করে দিয়েছিল। পুরোটা পথ কোলে করে নিয়ে গেছিল জগুকে। আচ্ছা! মাস্টারমশাইয়ের সাইকেলটা কী হল? বেকার বেকার ফেলে রেখেছে গোয়ালের পাশে। নিজেও চড়ে না, কারোকে চড়তেও দেয় না। ওই মাস্টারমশাই-ই জগুকে যুক্তাক্ষর, নিজের নাম, আর অনেকদিন পর বাবার নাম লেখা শিখিয়েছিল। দুকুরাম নস্কর। সেদিন বেশিক্ষণ পড়ায়নি জগন্নাথকে। শুধু নামটুকু শিখিয়ে দিয়ে বলেছিল, 'যা ঘর যা,আমার কাম আছে'। জগু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, 'আজ এটুকুই ক্যেনে মাস্টারসাই', এই কথার উত্তরে ঝাঁঝিয়ে বলে উঠেছিল, 'তোর চাকর আছি নাকি রে, যে, তোকে উত্তর দিতে হবে?'

এই কথার এমন অপ্রত্যাশিত জবাবে আজকের মতোই  থতোমতো খেয়ে গেছিল জগন্নাথ। আস্তে আস্তে শ্লেট গুছিয়ে বগলে করে নিয়ে ঘরের দাওয়ায় এসে বসেছিল। ঠাকমা ওর চুন মুখ দেখে বলেছিল, 'দিন কখনো সমান যায় না রে ছাওয়াল, নেকাপড়া করচো, চাকরি করবে, বাপের মতো ফেরি কত্তে হবে না'। ঠাকুমা অশিক্ষিত হলেও মন্ডলদের বাড়ি ডিম বেচতে গিয়ে এইটুকু জেনে গেছে যে নেকাপড়া কল্লে চাকরি পাওয়া যায়, বড়ো বাবু হওয়া যায়। তাই আজও যখন ও চাকরি পায়নি, সাইকেল নিয়ে এ গ্রাম ও গ্রাম পড়িয়ে বেড়ায়, ওর ঠাকুমা কাঁথায় শুয়ে চিঁ চিঁ করে প্রশ্ন করে, 'কি রে বাপ, আপিসে যাচ্চিস কোলকেত্তায়?'

খুব শীত পড়েছে হঠাৎ। বৃদ্ধ আবার রোঁয়া ফুলিয়েছে। ফুলকপি খেত  পেরোতে পেরোতে নাকে ভেসে এল হাঁসের মাংসের গন্ধ। শীতকালের হাঁস! বেশ গতর হয়। কেউ রাঁধছে হয়তো। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে ঝোলা রাখল টেবিলের উপর। পাঞ্জাবি খুলতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠল জগু। ঘরের অন্ধকারে তার খাটে বসে রয়েছে কে? প্রথমে একটু থতোমতো খেয়ে গিয়ে তারপর বছর পঞ্চান্নর দুকুকে দেখে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল উঠতি লেখক। তার অন্ধকার ঘরে কখনো এমন খাটের উপর চুপ করে বসে না ফেরিওয়ালা । নির্বাক, স্হির। পাথরের মূর্তি বলে ভ্রম হবে। এই দুকু আসলে পাথরের মূর্তিই মনে হয়। নয়তো পদ্মা এখনো মা হল না। হঠাৎ  মূর্তি ডুকরে কেঁদে উঠল। দুকুকে কখনো জগু কাঁদতে দেখেনি। হাসতেও না। 'কী হয়েছে? কাঁদতিছ ক্যান?' অবাক হয়ে প্রশ্ন করে জগন্নাথ।

'তোর মায় আমায় ছেড়ে গেল'

মানে- চিৎকার করে ওঠে জগু।

'আজ বিকেল থেকে তারে আর কেউ দ্যাখে নাই'- কিছুক্ষণের জন্য থতোমতো খেয়ে যায় জগু। পদ্মা তার মা নয় ঠিক। তবে তার দশ বছর বয়সে যখন দুকু পদ্মাকে নিয়ে আসে প্লাস্টিকের শাখা আর সিঁদুর ছুঁইয়ে, তখন  কুড়ি বছর বয়স পদ্মার। তাতে কী? খুঁদকুড়ো সংসারে চারটে পুষ্যিকে গায়ে গতরে, রেঁধে বেড়ে কাটিয়ে তো দিচ্ছিল এতগুলো বছর। আবার কী হল! আচ্ছা সব মেয়েরাই কি তবে একদিন এরকম করে চলে যাবে কুলো, লক্ষ্মীর ঝাঁপি, চালের হাঁড়ি, উনান উসকাবার আমকাঠের ডাল- এই সব ছেড়ে! কেন যাবে?

'চলো, থানায় চলো'। ছেলের কথায় দুকু থানায় গিয়ে বয়ান দেয়। খোঁজ খোঁজ। গ্রামময় তোলপাড়। কেউ বলে তাকে স্টেশনের দিকে যেতে দেখেছে, কেউ বলে জলে ডুবেছে, কেউ বলে পালিয়েছে। কিন্তু পুকুর, নদী, খেত, মাটি- কোথাওই তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। দুকু বুঝতে পারে না, তার সঙ্গেই প্রতিবার এমন ঘটে কেন? জগু বুঝতে পারে না, মেয়েরা এভাবে ছেড়ে যায় কেন? আর গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারছে না, দুকু আবার বিয়ে করবে কি করবে না- বছর পাঁচ তো কাটল।

জগু চাকরি পেয়েছে কলকাতায়। এখন শুধু শনিবার করে আসে। দুকুকে দেখে, ঠাকমাকে দেখে। ওষুধ, পথ্য, জামাকাপড়, পাকা ছাদ, সব করে দিয়েছে ছেলেটা। গ্রামের লোকেরাও তাকে মাতব্বর মানে। দশ-বিশটা উপন্যাস লিখে এখন জগু বেশ কেওকেটা। প্রেমের উপন্যাস এখনো লেখেনি জগু। তবে লিখবে খুব শীঘ্র। আর কদিন পর থেকেই ধরবে। এই কদিন তৃষাকে একটু বাবা মায়ের নাম লেখাটা শিখিয়ে দিক। তৃষা জগু ছাড়া আর কারো কাছে পড়তে চায় না।

জগুর ভালোও লাগে। শনিবার আর রবিবার তৃষা খুব উৎপাত করে, জগুকে পায় না বলে। জগু ওকে অ আ শিখিয়েছে। আজ নাম লেখা শেখাবে। রেগে যাবে না এতটুকু।

নিজের নাম - তৃষা (এটা সবার প্রথম শিখিয়েছে)

মায়ের নাম- পদ্মা (এটাও আগের দিন শিখে গেছে)

বাবার নাম- জগন্নাথ (এটা আজ শেখাল)

জগন্নাথ পদ্মাকে বিষ খেতে দেয়নি ওর মায়ের মতো। বাঁশবনের সেই আলো আজ জগন্নাথ দেখে ওর মেয়ের মুখে। অন্ধকারকে আজও বড়ো ভয় করে সেই গেঁয়ো তরুণ। 



[অলংকরণ : অভীক] 
#গল্প

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219125