মুক্তগদ্য

দেশের বাড়ি

উদিতা আচার্য July 16, 2021 at 7:23 am মুক্তগদ্য

আমাদের সবারই একটা দেশের বাড়ি থাকে, একটা origin। আমাদের বা আমাদের পূর্ব প্রজন্ম – তাদের উৎস যেখান থেকে; হয়তো কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রাম অথবা বর্ধিষ্ণু জনপদ , মফঃস্বল কিংবা উঠতি শহর – কোথাও না কোথাও আমাদের শেকড়খানা লুকিয়ে থাকে। আমার-ও তেমন একটা ‘দেশের বাড়ি’ আছে , গ্রামের বাড়ী আছে। রবিবার বিকালবেলা যখন এক চিলতে বারান্দা দিয়ে দিনের শেষে নরম আর হলুদ আভাটুকু তেরচা ভাবে এসে পাশের নিম গাছটায় পড়ে, বিকেলে বেলার হাওয়ার সাথে তখন যেন দেশের বাড়ির গন্ধ ভেসে আসে।

যতদূর চোখ যায় দেখতাম শুধু মাঠের পর মাঠ ভরা সবুজ ধান গাছ। বিকেলের নরম আলোয় মাঠের একধারে চুপচাপ বসে এলোমেলো হাওয়া আর ধানের শিষের ধরাধরি খেলা দেখতে বড় ভালো লাগত। কখনও বা পুকুর পাড়েই চুপচাপ বসে থাকা। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনের ছবিগুলো বদলেছে মাত্র; কিন্ত বিকেল বেলার হাওয়াটা এখনও সেই একই রকম ‘মন কেমন করা’-ই আছে।


গ্রীষ্মের দিনে কোনও সময় বাড়ী থাকলে, মাঝে মাঝে অলস দুপুরবেলায় একরকম গরমকালীন নিস্তব্ধতার শব্দ পাই। এরকম নাম করে হয়তো শব্দগুলোর শ্রেণিবিভাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়; তবুও দুপুরের কতকগুলো নিজস্ব শব্দ থাকে। কখনও কখনও আলসেমি মাখা সেই ‘দুপুরে’ শব্দগুলো আমার গরমের ছুটি কাটানো ছেলেবেলার দেশের বাড়ীর শব্দগুলোর সাথে মাখামাখি করে একাকার হয়ে যায়। ক্লাস থ্রি-ফোরের আমি তখন হাতের লেখার খাতা খুলে রাস্তার দিকের ঘরে জানালার ধারে খাটে বসে ছুটির কাজ সারতে ব্যস্ত। দূর থেকে শুনতে পেতাম কোনও একটা গাছের গুঁড়িতে কাঠঠোকরা পাখির অনবরত পরিশ্রমের শব্দ, পাশের পুকুরের জলে ঢিল পড়ার শব্দ, আর পাশের ঘর থেকে দাদু–ঠাকুমার ভাতঘুমের প্রমাণ স্বরূপ নাক ডাকার শব্দ। সেই শব্দের ঝুড়িতে এসে মিশত পাশের বাড়ীর কাকিমা - দিদিদের হাসাহাসি আর চুড়ির শব্দ, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের কচি গলার আওয়াজ আর বহুদূর থেকে খুব অস্পষ্ট ভাবে ভেসে আসা সাদাকালো যুগের বাংলা ছবির কোনও কিংবদন্তি গানের আবছা সুর। এই সব শব্দগুলোর সঙ্গে গাছের পাতার জোরালো শিরশিরানি শব্দটাকে মিলিয়ে সারা বাড়ীময়, আমার সারা শৈশবময় ঘুরে বেড়াত একটা আলসেমি জড়ানো আলগা নরম হাওয়া । 


সেই রোদসেঁকা দুপুর, অস্পষ্ট সব দুপুরছবি আর ছুটির কাজের খাতারা অনেক দিন হল ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে। তবু কোনও কোনও কাজ না-থাকা দুপুরে কান পাতলে এখনও একইরকম ভালোবাসায় মোড়া নির্বাক শব্দগুলো ফিরে ফিরে ছুঁয়ে যায়।


আমাদের দ্রুতলয়ের জীবনে এখন সেই আবেগপূর্ণ সুরেলা বিস্তারের জায়গার বড় অভাব । তবুও পড়ন্ত বিকেলের আকাশটা, রাস্তার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো , এলোমেলো মন কেমন করা একমুঠো হাওয়া – এরা হঠাৎ হঠাৎ করেই ছেঁড়া-ছেঁড়া কিছু ছবি সামনে এনে দেয় । আমার দেশের বাড়ির আল্পনা দেওয়া মাটির দালান, ছেলেবেলার পাটকাঠির তীর–ধনুক খেলা, মোরাম বিছানো লাল রাস্তা ধরে একদল ভাইবোনের পা মিলিয়ে চলা, খড়ের গাদার উপর হুটোপুটি, দুপুর বেলায় পুকুরপাড়ে গাছের নীচে মাদুর পেতে বসে আকাশ দেখা বা ছিপ আর চার বানিয়ে মাছ ধরা অথবা ছোটো ডোবার পাশের বাঁশের মাচাটায় বসে শুধুই গল্প করা। এখন যখন শুধুই সামনের দিকে ছুটে চলেছি, ছেলেবেলার এইসব মানুষগুলোর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ কমে এসেছে, ভালোবাসায় আগলে রাখা লোকগুলো এক-এক করে শুধুই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে; তখন সেই মাটির বাড়ি, প্রসাদের ‘চিনি মাখানো ছোলা’, ঠাম্মার উনুনভরা রান্না, চাটাই আর কলাপাতার গন্ধ, হ্যারিকেনের আলো-আঁধারি মেশানো গল্প সব যেন ভীষণ বেশি করে মনে পড়ে যায়। 

    

আমার এই সব ভালোবাসা-মাখা ছেলেবেলার খড়-ছাওয়া মাটির বাড়িটা এখন আর নেই; আয়না-পাতার দল, হাবলি ফলের গাড়ি, পুজোর ছুটির নাড়ু–মুড়কির ঝুড়িরা এখন আর হ্যারিকেনের আলোয় গল্প-ও করে না; কারেন্ট–সিমেন্টের ভিড়ে অনলাইনের সহজলভ্যতাও এসেছে। তবু হয়ত আমাদের ছেলেবেলার এই হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলো বড় যত্নে এখনও কোথাও জমা আছে দেশের বাড়ীর কোনো এক কোণায়। বোধোদয়ের আগের বেশ কিছুদিন আর এইসব লম্বা ছুটি ছাড়া আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা সবটুকুই এই কলকাতা শহরের বুকে। তবু কখনও শহর–গ্রাম, অনুভূতি আর আবেগ, অতীত আর বর্তমান, আমার স্মৃতি আর কল্পনা সব যেন মিলেমিশে যায় আমার ভিতর আর বাইরের সত্তাটুকুর সঙ্গে। তাই কলকাতার বুকে, ইন্সটিটিউটের ছাদে, মন কেমন করা বিকেলে কাজের ফাঁকে ফিরে ফিরে আসে সেই নীল আকাশ, আলগা হাওয়া আর ছেলেবেলার শব্দমাখা একরাশ আনন্দ ।

 

........................... 

[কভার ছবি: pinterest]

#বাংলা #মুক্তগদ্য #উদিতা আচার্য #দেশের বাড়ি

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

24

Unique Visitors

216062