'পিঞ্জরে বিহঙ্গ বাঁধা': তখন যেমন এখন তেমন...

'ভূপেন যখন আদালতে সাফাই গাহিয়া আপনাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিল না, তখন দেশে ছোকরাদের মধ্যে একটা খুব হৈ চৈ পড়িয়া গেল। এ কাণ্ডটা নূতন আজগুবী কাণ্ড বটে।'
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবীদের সাপ্তাহিক পত্রিকা 'যুগান্তর' সম্পাদনা ও বিপ্লবী ইস্তেহার 'সোনার বাংলা' প্রকাশের 'অপরাধে' ১৯০৭ সালে গ্রেপ্তার হন উত্তর কলকাতার সিমলার বাসিন্দা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, এক বছরের কারাদণ্ডও হয় তাঁর। ভূপেন্দ্রনাথের গ্রেপ্তারির পরের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে উদ্ধৃতাংংশের কথাগুলো লিখেছেন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর 'নির্বাসিতের আত্মকথা'য়।
উপেন্দ্রনাথের লেখা থেকে বোঝা যায়, ভূপেন্দ্রনাথের আদালতে সাফাই গেয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা না করা কিছুটা অন্যরকম খবর বলেই একটা 'হৈ চৈ'-এর ব্যাপার হলেও, রাজনৈতিক মতের জন্য শাসকের কারাগারে বন্দি হওয়ার খবরটা লোকের গা-সওয়াই হয়ে গিয়েছিল, ফলে ও নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। লেখক উপেন্দ্রনাথ নিজেও বিপ্লবী কর্মী হিসাবে 'যুগান্তর' এবং 'বন্দেমাতরম' পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন, আলিপুরের বোমার মামলার আসামি হিসাবে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আন্দামানের জেলে যান, ১৯০৯ সালে। ভূপেন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রনাথরা নিজেদের বিপ্লবী রাজনৈতিক কাজকম্মের জন্য শাসকের রোষানলে পড়েন, বন্দি হন, শাসকের অপছন্দের রাজনীতি করার জন্য বন্দি, রাজনৈতিক কারণে বন্দি, তাই এঁরা রাজনৈতিক বন্দি বা সংক্ষেপে রাজবন্দি।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জেলখানায় রাজনৈতিক কর্মীদের বন্দি করা আর রাজবন্দিদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছিলই। ১৯৩১ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরের হিজলী বন্দিনিবাসে রাষ্ট্রীয় বাহিনী রাজবন্দিদের উপর হামলা চালায়, পুলিশের গুলিতে শহিদ হন মধ্য কলকাতার বৌবাজারের সন্তোষকুমার মিত্র এবং বরিশালের গৈলা গ্রামের তারকেশ্বর সেন, পুলিশের লাঠি-গুলিতে আহত হন বহু রাজবন্দি। হিজলী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২৬ সেপ্টেম্বর মনুমেন্টের পাদদেশে সভায় সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডাঃ নীলরতন সরকার রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির জন্য একটি নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাখেন, রবীন্দ্রনাথকে সভাপতি করেই সে কমিটি তার কাজ শুরু করে।
এরপরেও পুলিশ হেফাজতে এবং জেলখানায় বন্দিহত্যা থেমে থাকেনি। ১৯৩২-এর ৬ জুন পুলিশি হেফাজতে খুন হন ঢাকার ছাব্বিশ বছর বয়সি বিপ্লবী কর্মী অনিলচন্দ্র দাশ, ১৯৩৪-এর ১৯ ডিসেম্বর রাজশাহির জেলে শহিদ হন তিন বছর ধরে বিনা বিচারে আটক চব্বিশ বছর বয়সি বিপ্লবী কর্মী সান্ত্বনা গুহ, ১৯৩৬-এর সেপ্টেম্বরে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ থানার পুলিশ খুন করে মেদিনীপুরের শহিদ বিপ্লবী নির্মলজীবন ঘোষের ভাই চব্বিশ বছরের নবজীবন (শালিখ) ঘোষকে। ১৯৩৩ সালের মে মাসে জোর করে নাকে নল দিয়ে খাইয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলের রাজবন্দিদের অনশন আন্দোলন ভাঙার চেষ্টা চললে তিনজন রাজবন্দি শহিদ হন— মহাবীর সিং রাঠোর (শহিদ দিবস: ১৮ মে), মোহনকিশোর নমোদাস (শহিদ দিবস: ২৬ মে) মোহিত মৈত্র (শহিদ দিবস: ২৮ মে)।
ভারতে দুয়ের দশক থেকে বামপন্থী-সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মীদের উত্থান। ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (CPI)-এর প্রতিষ্ঠা। শ্রমিক-কৃষককে সংগঠিত করার জন্য বামপন্থীদের উদ্যোগে ইউনিয়ন গড়া হয়েছে আগেই, বেড়েছে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন, জেলে ঢুকেছেন প্রথম পর্যায়ের কমিউনিস্ট সংগঠকরা, এবং তাঁদের মাধ্যমেই জেলে ঢুকল মার্কসবাদী রাজনীতি। ১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর হল, ভারত আর ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ উপনিবেশ রইল না, তবুও 'স্বাধীন' ভারতের জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দিরা রইলেনই।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস শুরু হল ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, কলকাতায়। তখন কমিউনিস্ট পার্টি তেলেঙ্গানার লড়াই লড়ছে, আর বাংলায় তেভাগার লড়াই। দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে তেলেঙ্গানার পথকেই মুক্তির পথ বলে গ্রহণ করা হল আর পার্টি কংগ্রেস শেষ হওয়ার কয়েক সপ্তা পরেই নিষিদ্ধ হল কমিউনিস্ট পার্টি। গ্রেপ্তার হলেন মণিকুন্তলা সেন, চারু মজুমদার, প্রীতি সরকার (বন্দ্যোপাধ্যায়), মঞ্জুশ্রী চট্টোপাধ্যায়, জলি মোহন কল, সুভাষ মুখোপাধ্যায় সহ অসংখ্য কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী। জেলের মধ্যে বন্দিদের উপর হামলা চলতে থাকে, প্রেসিডেন্সি জেলে পুলিশ গুলি করে খুন করে রাজবন্দিদের, প্রতিবাদে দমদম জেলের রাজবন্দিরা লক-আপ প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন শুরু করলে সেখানেও পুলিশ গুলি-লাঠি-কাঁদানে গ্যাস চালায়, নিহত হন দুজন রাজবন্দি। রাজনৈতিক রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শহিদ হন লতিকা-প্রতিভা-অমিয়া-গীতা, ১৯৪৯-এর ২৭ এপ্রিল, মধ্য কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে।
১৯৬৭ সালের মে মাসে নকশালবাড়ির বিপ্লবী লড়াই এবং তার ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে সিপিআই (এম এল) পার্টি তৈরির পর নকশালপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসে। জেল ভরে ওঠে নকশাল রাজনৈতিক বন্দিতে, চলতে থাকে বন্দি হত্যা। বহরমপুর জেলে খুন হন তিমিরবরণ সিংহ, যাদবপুর থানায় খুন হন আশুতোষ মজুমদার, হুগলী জেলে খুন হন দ্রোণাচার্য ঘোষ, লালবাজারে বন্দি অবস্থায় চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া হয় চারু মজুমদারের। জেলের মধ্যে পুলিশি নির্যাতন ও যৌন হেনস্থার শিকার হন মলয়া ঘোষ, অর্চনা গুহ, জয়া মিত্র, মীনাক্ষী সেন, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়শ্রী (রুবী) ভট্টাচার্যরা। ১৯৭৭ সালে, বন্দিমুক্তি আন্দোলনের চাপে, পরিবর্তিত সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
তারপরেও সরকারের যাওয়া-আসা চলেছে, রাজনৈতিক বন্দিরা কিন্তু জেলেই থেকেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা জানতে পারছি, জেলবন্দি কবি ভারভারা রাও গুরুতর অসুস্থ। আশি পেরোনো ভারভারা রাও ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে জেলবন্দি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১৮-র জানুয়ারিতে মহারাষ্ট্রের ভীমা-কোরেগাঁওয়ে দলিত সংগঠনগুলির উদ্যোগে যে অনুষ্ঠান হয় তার 'ষড়যন্ত্রে' যুক্ত ছিলেন তিনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ থাকুক, ভীমা- কোরেগাঁওয়ে দলিতদের উপর হামলা চালায় ব্রাহ্মণ্যবাদী বাহিনী, তাদের কোনও শাস্তি হয় না, উলটে দলিত জমায়েতে মাওবাদী যোগের গপ্পো ফেঁদে সাজানো মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ও আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ, অধ্যাপিকা ও নারী আন্দোলনের কর্মী সোমা সেন, কবি ভারভারা রাও, আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিঙ, রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি আন্দোলনের কর্মী রোনা উইলসন, সমাজকর্মী মহেশ রাউত, অরুণ ফেরেইরা, ভার্নন গঞ্জালভেস, সাংবাদিক গৌতম নওলখা, অধ্যাপক ও দলিত আন্দোলনের তাত্ত্বিক আনন্দ তেলতুম্বডেদের। ভারভারা রাওদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলির মধ্যে একটি, যে, ওঁরা নাকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হত্যার চক্রান্ত করেছিলেন। ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে যে বাংলার বামপন্থী বিপ্লবী সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট সরকার এমন সাজানো অভিযোগেই ইতালির জেলে ঢুকিয়েছিল। সৌম্যেন ঠাকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি নাকি মুসোলিনি হত্যার ছক কষছেন! আসলে ভারভারা রাও-রা সকলেই নিপীড়িতের অধিকারের লড়াইয়ের সংহতিতে থাকা মানুষ, আর শাসকের চোখে সেইটেই এঁদের 'অপরাধ', যেমন 'অপরাধী' ছিলেন বিরসা মুণ্ডা, ভগৎ সিং-রা।
গণআন্দোলনের সংহতিতে থাকার কারণে দীর্ঘদিন ধরে জেলবন্দি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শারীরিক প্রতিবন্ধী জিএন সাইবাবা।ভারভারা রাও গুরুতর অসুস্থ, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, ভারনন গঞ্জালভেসরাও কমবেশি সকলেই অসুস্থ। এঁরা বাদেও দেশের বিভিন্ন জেলে আটক নাম জানা, না-জানা রাজবন্দিরা এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। কদিন আগেই জানা গেছে জেলবন্দি রাজনৈতিক কর্মী ষাটোর্ধ্ব অমিতাভ বাগচী করোনায় আক্রান্ত। যতীন দাশ, সন্তোষ মিত্র, আশু-তিমির, চারু মজুমদারদের মতোই ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন-রা কি এভাবেই হারিয়ে যাবেন গারদের অন্ধকারেই?
[ পোস্টার : অর্পণ দাস ]
#নিবন্ধ
Milan Malakar
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রসঙ্গ শেষ হল না যে। ১৯০৮ সালে খুদিরাম বসু, ১৯২৪ সালে আসফাকুল্লা খসন, ২৯৩৩ সালে সূর্য সেন, ১৯৩৪ সালে তৈরি দীনেশ মজুমদার প্রমুখ অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীকেই বৃটিশরা খুন করেছিল। একে একে সব বিবরণ আসুক।
Tapas Mukherjee
এসব নিয়ে যাঁরা সরব, তাঁরা বোধ হয় জানেন না নীরবে থাকা অসংখ্য মানুষ কনুইয়ে ভর দিয়ে একদিন উঠে দাঁড়াবেই দাঁড়াবে, তাদের এমন কোন শক্তি নেই তা দমন করতে পারে, শুধু সময়ের অপেক্ষা... সেটাই ইতিহাস, কিন্তু সময় একদিন আসবে, তখন প্রয়োজন হবে সঠিক নেতৃত্ব, যা তৈরী না হলে ঐ সময়কে সদ্ব্যবহার করে এই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকারী শক্তিকে পরাভূত করা যাবে না!.. তাই বিপ্লবী কবি সাহিত্যিক কর্মীবাহিনীর ওপর অত্যাচার নিয়ে হা হুতোস করার চেয়ে সেদিকে নজর দিলেই তাঁদের চাওয়া মানবতাকে সংরক্ষন বা ফিরিয়ে আনা যাবে বলেই মনে হয়...
সৌমিত্র শংকর সেনগুপ্ত
ভাল এবং জরুরি লেখা। লেখাটা পড়তে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ল। ১৯৪৮ -এ কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর যে নামী অনামী কর্মীরা জেলে ছিলেন তাঁদের নিয়ে এককলম লেখা বেরোতো 'স্বাধীনতা' পত্রিকাতে। যেমন, বক্সা জেলের বন্দী কর্মীদের নিয়ে লেখা কলমের নাম ছিল 'বক্সায় যাঁহারা বন্দী।' এই কলমগুলো একজায়গায় জড়ো করতে পারলে একটা ডকুমেন্টেশন হয়।
ব্রততী হোড়
খুব তথ্য সমৃদ্ধ ও সময়োপযোগী লেখা । উপনিবেশ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিবর্তিত হ'লেও চরিত্রগত পার্থক্য, অন্তত রাষ্ট্রীয় বিরোধিতার ক্ষেত্রে, পরিলক্ষিত হয় না । তাই বয়স এবং গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে ও যুগে যুগে এঁরা রাষ্ট্রের কাছে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের কাছে , 'বিপজ্জনক' হ'য়ে গরাদের ওপারেই রয়ে যান - বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে !