ফিচার

কলকাতার ক্যাফে কীর্তন

সায়নদীপ গুপ্ত Aug 21, 2020 at 5:59 am ফিচার

কথায় বলে, ময়দান চত্বর হল কলকাতার ফুসফুস। শুনতে ভালোই লাগে, তবে সাতসকালে গড়ের মাঠে গিয়ে অনুলোম-বিলোম করে দেখবেন একবার; তাজা বাতাসের সঙ্গে ঘোড়ার ইয়ের গন্ধও অ্যালভিওলাই ভরিয়ে দেবে। আর ময়দান ফুসফুস হলে এজেসি বোস রোডকে কি পাঁজর বলা যাবে? বন্ধুদের মধ্যে একবার এই নিয়ে কথা উঠতে এক বন্ধু সোনারপুরের জন্য একটা অঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তার স্পষ্ট বক্তব্য, সোনারপুরও কলকাতার অংশ। আরেক বন্ধু বলেছিল, “ওহ্‌, তাহলে ওটা অ্যাপেন্ডিক্স”, সেই শুনে তো এই বন্ধুটি তাকে এই মারে কি সেই মারে! সে যাকগে, আপনি কি বলতে পারেন, কলকাতার হৃদয় কোন্‌ জায়গাটা?

না না, নন্দন-সদন নয়। আর হ্যাঁ, শহরের মানুষ-টানুষ বলে বসবেন না প্লিজ! নিন্দুকেরা নাই মানতে পারেন, কিন্তু কলকাতার হৃদয় আসলে তার অগণিত কফিশপ। বিশ্বাস না হয়, একবার গল্পে-প্রবন্ধে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের আড্ডায় ঢুঁ মেরে আসুন। এমনিতে কফি হাউসের বিল্ডিংয়ের থেকে তার আড্ডার মিথ বড়, কিন্তু এ শহর আড্ডা ছাড়া আর কোন্‌ জিনিসকে তার হৃদয় দিয়েছে বলুন তো? সদ্যস্ফুট প্রেমের কলি থেকে সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক বুলি– আড্ডা ছাড়া কোনোদিন বাঙালি শিখেই উঠতে পারেনি। শহরের কফিশপগুলো সেই আড্ডাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখা এক একটা প্রকোষ্ঠ। ক্যাফে (Café, caffè) শব্দটার আদি অর্থ কফি, তাই সেখান থেকেই কফির ঠেক– অন্তত ফ্রেঞ্চদের তাই মত। অন্যদিকে ইতালিয়ানরা বলেন ক্যাফেতে সুরাপানও চলতে পারে অনায়াসে। কিন্তু ব্রিটিশদের খাদ্যরীতির অনেকটাই যেহেতু ফ্রেঞ্চদের থেকে টোকা, তাই ১৯৪২ সাল নাগাদ অ্যালবার্ট হলে যখন কফি ও স্ন্যাক্‌স দেওয়ার পরিষেবা চালু হল, সুরাপানের কোনোরকম বন্দোবস্ত সেখানে ছিল না। ভাবতে অবাক লাগে, সেই সময় এইটি ছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে কিঞ্চিৎ উচ্চকোটির ঠেক। পকেটে রেস্ত কম থাকলে গড়পরতা যুবাদল কফি হাউসের তুলনায় বসন্ত কেবিন বেশি পছন্দ করত। সেখানের বিখ্যাত আইটেম ছিল ‘ডবল হাফ কাপ চা’, অর্থাৎ সাধারণ দুধ-চিনি সহ ফুল কাপ চায়ের সম পরিমাণ জল কিন্তু অর্ধেক পরিমাণ দুধ-চিনি। তাহলে হাফ কাপ? সেখানে দুধ-চিনির মতো চায়ের জলও অর্ধেক! ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে এহেন ব্যবসায়িক উৎকর্ষ দেখে বিস্মিত হওয়াই স্বাভাবিক। তপন রায়চৌধুরী তাঁর ‘বাঙালনামা’ গ্রন্থে এই ইনোভেশনের কথা লিপিবদ্ধ করে জানিয়েছেন চার পয়সার ফুল কাপ ও দু’পয়সার হাফ কাপের জায়গায় তিন পয়সায় ডবল হাফ কাপ চা পাওয়া যেত এবং তারপরেও খদ্দেররা ‘এহেহে, এ তো পুরো জল’, ‘আজ কী পানসে বানিয়েছ গো’ ইত্যাদি বলে দুধ-চিনির পরিমাণ প্রায় ফুল কাপের দিকে ঠেলে নিয়ে যেত (দোকান মাত্রেই দরদাম করতে চাওয়াটা বাঙালির জাত্যাভিমান শুধু নয়, জেনেটিক্স)। কিন্তু সস্তা বলেই বসন্ত কেবিনে ভিড় হত বেশি, তাই হাত-পা ছড়িয়ে আড্ডা দেওয়ার জায়গা ছিল কফি হাউস, শুধু চার পয়সার চায়ের বদলে চার আনা দিয়ে কফি নিতে হত। কফি হাউসের ছোট ছোট এক একটা টেবিল কীভাবে দেশ-দর্শন-দস্তয়েভস্কি নিয়ে তুফান তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছে, বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে, সেকথা এখন প্রবাদপ্রতিম। ওই আড্ডার তুফান থেকে শিক্ষা ও মৌলিক চিন্তার যে বুনোট গড়ে উঠত, তা সম্ভবত উল্টো ফুটপাথের বাড়ি থেকেও সবসময় পাওয়া যেত না। সেই সময় এর পাশাপাশি সাধারণ ও অভিজাত ঠেক আরও অনেক ছিল; ওই চত্বরে দিলখুশা, সুরেন ব্যানার্জী রোডে অনাদি কেবিন, এমনকি মেট্রো গলি থেকে বেরিয়ে ক্যাফে ডি মোনিকো– কিন্তু এর কোনোটিই জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান বা অনিমেষ-মাধবীলতাদের স্বপ্নের ঠিকানা হয়ে উঠতে পারেনি।

একুশ শতকের গোড়া থেকেই শহরের ক্যাফে কালচারে বদলটা চোখে পড়তে থাকে। সিসিডি (Café Coffee Day) ও বারিস্তার হাত ধরে ক্যাফেতে বিশ্বায়নের মরুঝড় এসে উপস্থিত হল। বাঙালি প্রথম জানল, ক্যাফেতে হাসি মেপে নিচু স্বরে কথা বলতে হয়। তখনও উচ্চবিত্তের নাগালে থাকা এই প্যারাডাইম শিফটের একটা কারণ যদি হয় অর্থনীতির খোলা বাজার, অন্যটা অবশ্যই পরিষেবার পড়ন্ত মান। অনাদি বা বসন্ত কেবিনের খাবারের কথা বাদই দিন, কফি হাউসের কফির থেকে তার নস্টালজিয়া বেশি স্বাদু। অবশ্য নিরঙ্কুশ অভ্যাসে কফি হাউসের কর্মচারীরা নিজেদের ছবি বিশ্বাস-সম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে খদ্দের মাত্রেই তাদের কন্যার পাণিপ্রার্থী বাউন্ডুলে ভানু বন্দ্যো, কাজেই খ্যাঁকানিযোগ্য। এইসবের তুলনায় সুরম্য কফিশপে সাহায্যকারীদের ব্যবহার দেখলে মনে হয়, সবার মধ্যে পাহাড়ি স্যান্যালরূপী ঈশ্বর বর্তমান। যে চরম তিতিক্ষায় তাঁরা বছরের পর বছর বাঙালিকে কাপুচিনো ও এসপ্রেসোর পার্থক্য বুঝিয়ে গেছেন, তা নির্দ্বিধায় তারিফ করার মতো। আড্ডার ঠিকানা পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গেই তার চরিত্রেও বদল এল; বইয়ের জায়গা নিল বোর্ড গেম, সংকোচের জায়গা নিল সাহস। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, তাবৎ বদল সত্ত্বেও কলকাতার যৌবন তার আঁচ পোহাতে লাগল এই ক্যাফেতেই। ষাটের দশকের কফি হাউসের টেবিল যেমন ‘এক্ষণ’-এর মতো বহু লিটল ম্যাগাজিনের কার্যালয় হয়ে উঠেছিল, হাল আমলের পার্ক স্ট্রিটে অক্সফোর্ড বুকশপের দ্বিতলে ছোট্ট চা-বারেও তেমনই ল্যাপটপ খুলে প্রোজেক্ট ডিজাইন থেকে ক্লায়েন্ট মিটিং সবই চলে পুরোদমে।

হৃদয়ের কলকাতা ভাষা বদলেছে মাত্র, ভালোবাসা বদলায়নি।



[পোস্টার : অর্পণ দাস।]

আরও পড়ুন

#ক্যাফে #কলকাতা #সায়নদীপ গুপ্ত #ফিচার

  • শুভ
    Aug 26, 2020 at 11:01 am

    নতুন মোড়কের Mason Jar-এ করে পাড়ার সেই পুরোনো দোকানের এই চা খেতে বেশ ভালোই লাগলো। এই ধরণের আরো এক cup এর অপেখ্যায় রইলাম, টা এর সাথে। শুভেচ্ছা থাকলো। উল্লাস।

  • Soumya
    Aug 25, 2020 at 2:32 pm

    সুস্বাদু গদ্য। অজানা তথ্য। কিন্তু শেষ অংশে এসে মনে হল দুম করে থেমে গেল। এখনকার ক্যাফে নিয়ে আরেকটু এগোলে ভাল হত।

  • বিকাশ
    Aug 22, 2020 at 7:33 pm

    বাহ! সুন্দর লেখা!

  • রূপসা
    Aug 22, 2020 at 9:32 am

    দারুন..

  • Souvik
    Aug 21, 2020 at 8:05 pm

    চমৎকার লেখা হয়েছে।

  • দ্বিজিৎ
    Aug 21, 2020 at 3:05 pm

    সুন্দর। কফি হাউসের বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনাটা দারুণ হয়েছে।

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

47

Unique Visitors

225543