স্মরণে ইলিনা সেন

গণতন্ত্র বলে যে অবাঙমনসগোচর বস্তুটি খাতায় কলমে মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকেই সভ্য সমাজের চেতনায় আছে, তার একেবারে শৈশবে এথেন্সে কথা বলার অধিকার বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হত। ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকারকে রাষ্ট্র কীভাবে গণতান্ত্রিক পরিসরে জায়গা করে দেবে, তা ছিল গ্রীক ‘সুশীল’ সমাজের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। নির্ভয়ে খোলাখুলি যে কোনও কথা বলতে পারাকে গ্রীক তর্কশাস্ত্রে নাম দেওয়া হয়েছিল পারহেসিয়া(Parrhesia)। প্রায় ফসিল হয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা সবুজ এই শব্দটিকে ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতির ‘শাইনিং’ ইন্ডিয়ায় যাঁরা আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন, তাঁদের একজন চলে গেলেন। গত রবিবার (৯ অগাস্ট, ২০২০) মারা গেলেন বিখ্যাত গণআন্দোলন-কর্মী, লেখক ও অধ্যাপক ইলিনা সেন।
বয়স হয়েছিল ৬৯। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগছিলেন। বিখ্যাত চিকিৎসক ও ততোধিক বিখ্যাত মানবাধিকার- কর্মী বিনায়ক সেনের সহধর্মিণী ছিলেন তিনি। দু’জনে কাঁধে কাধ মিলিয়ে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে অক্লান্ত লড়াই করেছেন উপেক্ষিত শোষিত মানুষদের পক্ষ নিয়ে। বিভিন্ন শ্রমিক ও আদিবাসী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন। দু’জনেই বহু বছর ছত্তিশগড়ে ছিলেন। বিনায়ক মূলত জনস্বাস্থ্য বিষয়টিকে কেন্দ্র করে কাজ চালিয়ে গেছেন। আর ইলিনা উপজাতি ও খনিশ্রমিকদের আন্দোলনে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্থানীয় মানুষদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন সিভিল নজরদারি গোষ্ঠী ‘কোয়া কমান্ডো’। ভিলাই ট্রেড প্লান্টে মহিলাকর্মীদের ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। গণশত্রু ‘নকশাল’দের প্রতিহত করার নামে ছত্তিশগড় সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে গড়ে ওঠা ‘সালওয়া জুড়ুম’ প্রকারান্তরে সাধারণ আদিবাসী মানুষের ওপরেই অত্যাচার চালাত। এই ভয়ঙ্কর গুণ্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদেও বিনায়ক আর ইলিনা ছিলেন একেবারে প্রথম সারিতে। অনেক প্রতিরোধের মুখে পড়ে ২০১১ সালে এই সরকার - পোষিত গুণ্ডাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়। তার অনেকটা কৃতিত্ব বিনায়ক, ইলিনা আর তাঁদের বন্ধু - সহকর্মীদের প্রাপ্য। অধ্যাপক এবং লেখক হিসেবেও কৃতী ছিলেন ইলিনা সেন। মহারাষ্ট্রের মহাত্মা গান্ধী আন্তর্জাতিক হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। ‘Sukhvasin : The Migrant Woman of Chhattishgarh’ (১৯৯৫) এবং ‘Inside Chhattisgarh : A Political Memoir’ (২০১৪) বইদুটি ভালো সাড়া ফেলেছিল চিন্তাশীল মহলে।
২০১০ সালে ডঃ বিনায়ক সেনকে আদিবাসীদের উস্কানি দেওয়া এবং নকশাল আন্দোলনে সাহায্য করার অভিযোগে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় রায়পুর সেশন কোর্ট। পরে জামিন পেলেও আদালতের খাতায় আজও তিনি অভিযুক্ত। এই অবস্থায় ইলিনা একা হাতেই সামলেছেন বিনায়কের এনজিও-র কাজকর্ম। মারণ-রোগ নিয়েও কোণঠাসা মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছুটেছেন বারবার। প্রবলভাবে সরব ও সক্রিয় ছিলেন প্রতিটি সামাজিক ঘটনা বা আলোড়ন নিয়ে। ক্ষমতার মুখব্যাদান যেখানেই কুৎসিত হয়ে উঠেছে, পাওয়া গেছে তাঁর দ্ব্যর্থহীন প্রতিবাদ। সাম্প্রতিক অতীতে রোহিথ ভেমুলার হত্যাকেও স্পষ্ট ভাষায় ‘প্রাতিষ্ঠানিক খুন’ বলতে দ্বিধা করেননি।
ইস্পাতের তৈরি একজন মানুষ চলে গেলেন। যদিও ইলিনা সেনের মতো মানুষের প্রকৃত মূল্যায়ন কোনওদিনই সম্ভব হয়ে উঠবে না। শাসকের সাফল্য এখানেই। তাঁরা শতকরা পঁচানব্বই ভাগ দেশবাসীকে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন যে ইলিনা সেনের মতো মানুষেরা দেশদ্রোহী, গণশত্রু।
মৃণালিনী ঘোষালের আরও লেখাঃবিপ্লবী সিনেমার আঁতুড়ঘর ঝিগা ভেরতভ দল
#ফিচার #মৃণালিনী ঘোষাল #ইলিনা সেন
তোড়ি
গড্ডল প্রবাহের মুখে দাঁড়িয়ে ইলিনা সেন-দের কথা বারবার বলে যাওয়া জরুরি। কাজ হোক বা না হোক, বলে যাওয়াটাই কাজ। ধন্যবাদ, সিলি পয়েন্ট।