গল্প

খুন করার আগে

রোহন রায় July 11, 2021 at 8:35 am গল্প

[এক]


- ট্রেন সংহতি ছেড়ে দিয়েছে। আর পাঁচ মিনিট।

- হুঁ।

- ওভারব্রিজ দিয়ে নেমে আসবে। পুরো ফাঁকায় পাবি, তারপর চালাবি। বুকে চালাবি। বুঝলি? পিছন থেকে ডাকবি। তারপর একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াবি, পঙ্কজদা যেমন বলেছে। এরপর আর কী, সোজা বের করে পরপর দু বার টেনে দিবি। ফটকে ততক্ষণে গাড়ি নিয়ে সাঁই করে চলে যাবে। দরজা খোলা থাকবে। আমি আর তুই উঠে পড়ব। ক্লিয়ার?

- হুঁ।

- ফাটছে?

- না।

- মুখ দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে টাকে উঠে গেছে!

- না বলছি তো।

- ফালতু চাপ নিচ্ছিস কেন? বলেছি তো, তোর কোনও ভয় নেই। তোর সিকিউরিটির পুরো দায়িত্ব পার্টির। তাছাড়া তুই তো আবার জুভেনাইল। ধরা পড়লেও চাপ নেই।

- জানি। চাপ নিচ্ছি না।

- তাহলে শালা এরকম তোম্বা মেরে আছিস কেন? ভয় করছে?

- ভয় না।

- তাহলে কী?

- ভাল্লাগছে না বটাইদা। পাঁচটা মিনিট আমাকে একা ছেড়ে দাও। প্লিজ।

- ওরম হয় একটু। ফার্স্ট টাইম তো। নে, বিড়ি নে। দুটো টান দে, কনফিডেন্স লেভেল বাপ বাপ বলে বেড়ে যাবে।

- দাও।

- টান দে। ম্যাদামারা ভাবটা কেটে যাবে।

- একটা কথা জিগ্যেস করব বটাইদা? সত্যি বলবে?

- কী কথা?

- হারাধন জেঠার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবার পর পকাইদার সে বছরের পড়ার পুরো খরচা তো মাস্টারদাই টেনেছিল। তাই না?

- কে বলল তোকে?

- শুনেছি।

- যত্তসব ফালতু কথা। মাস্টারদা কেন দেবে? আমি ততদিনে কাজে ঢুকে গেছি না?

- দু বছর আগে তো তুমি সারাদিন ক্লাবে ক্যারাম খেলতে।

- আবে, পকাই মাধ্যমিক পাশ করেছে দু হাজার দশের মার্চে। দু হাজার দশের জানুয়ারিতে আমি শ্রীমা বিল্ডার্সের কাজে ঢুকেছি। ওর ইলেভেন ক্লাসের পুরো খরচা আমি চালিয়েছি। আমার ভাইয়ের পড়ার খরচা মাস্টারদাকে দিতে দেব কেন? আমার একটা প্রেস্টিজ নেই? কে বলেছে বল তো তোকে?

- কে বলেছে মনে নেই। শুনেছি।

- এইসব আলফাল কথা বলে বলে মাস্টারকে লোকজন হিরো বানিয়েছে। আসলে একটা…।

- আমার দিদির সায়েন্সের সব বই মাস্টারদা কিনে দিয়েছে।

- সে তো দেবেই। ও মালের তো মেয়েছেলেদের সঙ্গেই যত পিরিত। এইসব ধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ-ফঞ্চ বানিয়ে কী খ্যামটা চলে কেউ জানে না নাকি?

- এই নিয়ে বেশি কথা না বাড়ানোই ভালো।

- মানে?

- দু’ বছর আগেও আমার দিদি ফটফটে সকালেও একা একা পড়তে যেতে পারত না। আমাকে বা বাবাকে সঙ্গে যেতে হত। শুধু আমার দিদি কেন, গোটা সুঁটিয়ার কোনও মেয়েই পারত না। এখন পারে। সেটা ওই একটা লোকের জন্য।

- পাঁচ মিনিট বাদে যাকে খুন করবি, তাকে নিয়ে এত ভালো ভালো কথা ভাবছিস? তুই তো এক নাম্বারের সাইকো রে!

- ভগবান আমায় ক্ষমা করবে না।

- ধ্যার পাঁঠা! ভগবান কী রে? ভগবান কে? পাওয়ারই হচ্ছে ভগবান। ভগবান কোনওদিন পাওয়ারের এগেইন্সটে যান না। আমার বাপ হেবি ভগবান মানে। শালা সারাজীবন কারখানার ওভারশিয়ারের কাজ করে করে মাথার চুল উঠিয়ে ফেলল, এখন চাকরি গিয়ে ঘরে বসে আছে। খৈনি খাবার পয়সা নেই। আর সুশান্তদাকে দ্যাখ। জেলে বসে লাখে খেলছে। জেলে বসে লোক মারছে। কে কী ছিঁড়তে পারছে? এইটা হচ্ছে পাওয়ার। এইটাই ভগবান।

- তুমি যা বলো সব বিশ্বাস করো বটাইদা?

- মানে?

- বলো না, যা বলো সব বিশ্বাস করে বলো?

- তুই খুব ঘেঁটে আছিস মাইরি।

- বটাইদা, আমি পারব না।

- লাইফে সবই কখনও না কখনও প্রথমবার করতে হয়। খুনও তাই।

- সেটা বলছি না। মাস্টারদাকে আমি মারতে পারব না। তোমাদের টাকা আমি ফেরত দিয়ে দিচ্ছি।

- টাকা ফেরত দিলেই হয়ে গেল? কেন আমড়াগাছি করছিস মাইরি?

- হ্যাঁ। সত্যি বলছি। আমি পারব না। মাস্টারদার মতো লোককে মারতে পারব না। হাসছ কেন? হেসো না। প্লিজ। আমি সত্যি বলছি।

- তোর হাতে অপশন আছে নাকি? পঙ্কজদা কি তোকে সঠিক উত্তরে টিক দিতে বলেছে?

- প্লিজ। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি পারব না।

- দ্যাখ সুমন্ত, মাস্টারের টাইম আপ। তুই কাজটা না করলে অন্য কেউ করবে। মাঝখান থেকে নিজের ইয়েটা কেন মারাবি তুই? ট্রেন আসতে তিন মিনিটও বাকি নেই, এখন পেঁয়াজি করছিস?

- তোমাদের তো এত লোক। অন্য কেউ করুক না। তুমি নিজেই তো করতে পারো। আমিই কেন?

- কারণ আছে নিশ্চয়ই। অত কথায় তো তোর কাজ নেই। কাজটা তোকে করতে হবে। নাহলে কী হবে তুই জানিস। স্পেশালি তোর দিদিকে… কী বলব…পঙ্কজদাকে তো চিনিস। তোর ফ্যামিলি, তোর দিদির চেয়েও মাস্টারদা তোর কাছে আগে হল? কাঁদিস না মাইরি। আমার সামনে কেউ কাঁদলে আমারও শালা কান্না পেয়ে যায়।

[দুই]  


- বকুলতলায় পারমিশন দিচ্ছে না। 

- বলেছিলাম দেবে না। 

- কী করবে তাহলে? সভা ক্যানসেল?

- সভা করতেই হবে। মিটিং-এ আজকে নিতাইদার সঙ্গে কথা বলব। ওদের বাগানের সামনের যে বড় ফাঁকা জমিটা, ওখানেই করব। 

- একটা কথা বলব মাস্টারদা? রাগ করবে না তো? 

- না শুনে কী করে বলব রাগ করব কিনা! 

- কটা দিন রেস্ট নাও। কাল জ্বর থেকে উঠে আজই স্কুলে দৌড়লে। তারপর আজকেই মিটিংটা না রাখলেই হচ্ছিল না? দুটো দিন রেস্ট নিলে কী এমন ক্ষতি হবে? মিটিং কাল বা পরশু রাখো। 

- রেস্ট নিয়ে সময় নষ্ট করলে হবে না রতন। সবকটাকে জেলে না পোরা অবধি আমি রেস্ট নিতে পারব না। 

- আর এইসব করতে গিয়ে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে? 

- তোরা তো আছিসই। 

- কী মুশকিল! আমরা তো এখনও আছি! তুমি আসলে ভরসাই করো না আমাদের! বুঝে গেছি! 

- অবান্তর কথা বলিস না। স্টেশন ঢুকছে। ওঠ। 

 

[তিন] 


- ট্রেন ঢুকছে। ওঠ। সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আরে ওঠ। 

- বটাইদা, আমার শরীর কেমন করছে। সত্যি বলছি আমি পারব না। আমার হাত-পা কাঁপছে। দ্যাখো। 

- আমারও ফার্স্ট মার্ডার করার আগে ওরকম হয়েছিল। পেঁয়াজি না করে ওঠ। আজ মাস্টারদা বেঁচে গেলে তুই ফ্যামিলিশুদ্ধু মায়ের ভোগে গেলি, এটা বুঝে নে। 

- আমার বমি পাচ্ছে। সত্যি বলছি।

- করে নে। জলদি। ওভারব্রিজ পেরিয়ে এদিকে আসতে আরও এক-দেড় মিনিট তো লাগবেই। আবার কাঁদছিস? শোন সুমন্ত, মাস্টারদা ভালো লোক আমিও জানি। মাক্কালীর দিব্যি এরকম ভগবানের মতো লোক আমি চোখে দেখিনি। অবাক হোস না। আমি কি চোখে ঠুলি পরে চলি? সবাই জানে মাস্টারদা কী। কিন্তু মুশকিলটা কোথায় জানিস? মুশকিলটা হচ্ছে, আমি ওর অপোনেন্ট। তুইও এখন তাই। বমি করবি? করে নে। নাহলে ওঠ। ট্রেন ঢুকে গেছে, ওই দ্যাখ। 


[চার] 


- এই রতন, ভুলেই গেছিলাম। দিলুদার দোকান থেকে কয়েক দিস্তা খাতা কিনে তাহেরপুরে দুটো ছেলেকে দিতে হবে। আজই। 

- তাহলে তো এদিকে যেতে হবে। 

- হ্যাঁ, কিন্তু বাইকটা তো ওইদিকের স্ট্যান্ডে রাখা। 

- সে আমি নিয়ে আসছি। তুমি শুধু শুধু এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে অতটা যাবে? শরীরটা খারাপ তোমার।  

- তুই যাবি? 

- হ্যাঁ। তুমি যাও, ওইদিকে নেমে বিশুর চায়ের দোকানে দাঁড়াও। আমি বাইক ঘুরিয়ে নিয়ে আসছি। 

- ছাড় না। ভারি তো শরীর খারাপ। চল দুজনেই যাই।

- একটা কথাও শোনো না তুমি! নিজে যা ভালো বুঝবে তাই! 

- তুই না দিন দিন কেমন মা-কাকিমাদের মতো হয়ে যাচ্ছিস! 

- একটা কথা বলো তো। তুমি রোজ শেয়ালদা যাও ইস্কুল করতে। খামোখা দিলুদার দোকান থেকে এত এত খাতা কেন কেনো? কলেজস্ট্রিটে, শেয়ালদায় তো আরও কম দামে পাবে।

- জানি তো। কিন্তু দিলুদার থেকেও তো নিতে হবে, নাহলে দিলুদারই বা চলবে কী করে। 

- তুমি পারও মাইরি!  

- চল, চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।


[পাঁচ]  


- রেডি হ। সেফটি ক্যাচ সরিয়েছিস তো? 

- হ্যাঁ। 

- ব্যস। পিস্তল লোডেড। ওইত্তো, বকরা এসে গেছে। নামছে। 

- পিছনে রতনদা। 

- তাতে কী? রতনটা তো ভেড়ুয়া। ওকে নিয়ে চাপ নেই। 

- ও যদি চিনতে পেরে যায়?

- মুখে রুমাল। চিনতে পারবে না। স্যাট করে কাজ সেরে বেরিয়ে যাব। এসে গেছে। চল। আরে, চল। 

- বটাইদা, আমি…। 

- একটু আগে পঙ্কজদা মেসেজ করেছিল, বুঝলি। তোর বাড়ির বাইরে লোক দাঁড়িয়ে। তোর দিদিকে তুলবে কিনা জিগ্যেস করছিল। এই দ্যাখ। কী রিপ্লাই দেব? এইত্তো! লক্ষ্মী ছেলে! চল! আমি পিছনেই আছি। ঘাবড়াস না। ফটকেও রেডি, ওই দ্যাখ। স্টার্ট দিয়ে বসে আছে। পিস্তলটা হাতে নিয়ে রুমালের মধ্যে ঢেকে নে। কী বলেছি মনে আছে তো? ডাকবি, ফিরে তাকাবে, সোজা বুকে। দুটো। নে, ডাক দে এবার! আরে শুয়োরের বাচ্চা, বাইকে উঠে যাবে তো! ডাক! 

- মাস্টারদা! 

  


[গল্পের ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তবে খুনের মোটিফ, ধরন, অকুস্থল এবং খুন হতে চলা মানুষটির কাজকর্ম একটি কুখ্যাত বাস্তব ঘটনা থেকে অবিকৃতভাবে গৃহীত। বাস্তব ঘটনাটির সময়কাল ৫ জুলাই, ২০১২। সুমন্ত আর সুশান্ত নামদুটি বাদে বাকি নামগুলি কাল্পনিক।]

................................................

[অলংকরণ : অভীক আচার্য]

#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal #গল্প #রবিবারের গল্প #রোহন রায় #অভীক আচার্য

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

34

Unique Visitors

217255