মুক্তগদ্য

বঙ্কুবাবুর গপ্প

বিবস্বান দত্ত Sep 22, 2021 at 3:51 pm মুক্তগদ্য

বঙ্কুবাবুকে মনে আছে? সেই বঙ্কুবিহারী দত্ত? কাঁকুড়গাছি প্রাইমারি স্কুলের বাংলা আর ভূগোলের শিক্ষক? লকডাউনে বঙ্কুবাবু তেমন ভালো ছিলেন না। দুষ্টু ছাত্রগুলো যতই তাঁকে জ্বালিয়ে মারুক, ওদের ছাড়া বঙ্কুবাবুর ভালোলাগে না। তা তিনি নিয়ম করে অনলাইন ক্লাস নিয়েছেন। গুগল মিটে দেখেছেন সবুজ ঘাস কীভাবে ইঁটের তলায় চাপা পড়ে হলুদ হয়ে যায়।


সরকারি স্কুলের মাস্টার বঙ্কুবাবু। অনেক ছাত্রেরই অনলাইন পড়ার সুযোগ নেই। হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলে ছাত্রদের পড়িয়েছেন। যাদের তাও নেই তাদের তিনি জনে জনে ফোন করে পড়া দেওয়া আর পড়া নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে এই পুরো ব্যবস্থায় একেবারে তিতিবিরক্ত তিনি। তার মধ্যে ফেসবুক খুললেই বঙ্কুবাবু দেখতে পান সরকারি শিক্ষকদের নিয়ে যা-তা লিখছে সবাই। তাঁরা নাকি বসে বসে মাইনে নেন। ইত্যাদি। ফেসবুকে ভালো মন্দ কত লেখা থাকে। বঙ্কুবাবুর কপাল এমন, বেছে বেছে শিক্ষকদের গালি দেওয়ার পোস্টগুলোতেই নজর পড়ে তাঁর। কষ্ট পান বঙ্কুবাবু। তবে ঝগড়া করেন না। চশমা আরও এঁটে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে আসা খাতায় বানান ঠিক করেন। দুর্গা বানানে এখনও কেন ঊ-কার দিচ্ছে বাচ্চারা? বঙ্কুবাবুর ভুরু কুঁচকে যায়।


বঙ্কুবাবুর মনে আছে ছোটোবেলায় ভীষণ বানান ভুল করতেন তিনি। অনেক চেষ্টা করেও বানান কিছুতে ঠিক হত না তাঁর। মাস্টারমশাইরা বকতেন। বন্ধুরাও মজা করত। তারপরেও এক পাতায় অন্তত খান দশেক বানান ভুল না করলে তাঁর ভাত হজম হত না। বঙ্কুবাবু বানান ভুল করতেন। আর বানান ভুল করে কষ্টও পেতেন। ভীষণ লজ্জা করত তাঁর। হাঁ করে চেয়ে থাকতেন ভুল হওয়া বানানের দিকে। দেখতেন মূল বানানে উ-কার লিখেছেন তিনি। সেই উ-কার থেকে গজিয়ে উঠছে লতানে গাছ। ভরে যাচ্ছে সমস্ত পাতা। অথবা আকাঙ্ক্ষা বানানে যেখানে ক্ষ-এর জায়গায় খ লিখেছেন, ঠিক সেই জায়গা থেকেই একটা পাখি ডেকে উঠল। বঙ্কুবাবু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতেন খাতা ভরা লাল লাল কাটার দিকে। সেই কাটাচিহ্নের গা ঢেকে যেত শ্যাওলায়।


মাস্টার হয়ে বঙ্কুবাবু তাই কখনও লাল কালি দিয়ে খাতায় দাগ দেন না। কাটা চিহ্ন ব্যবহারই করেন না। বঙ্কুবাবুর মনে হয় লাল কালিতে কাটলে বাচ্চারা কষ্ট পাবে। তাই জনে জনে ডেকে ভুলগুলো ধরিয়ে দেন তিনি। ছাত্ররা আবার তাঁকে স্যার বলে ডাকে না। বলে বন্ধু। বঙ্কুবাবুর মনে হয়, স্যার শব্দটার মধ্যে একটু সাম্রাজ্যবাদী প্রভু প্রভু গন্ধ আছে। তাছাড়া বঙ্কুবাবু ছাত্রী শব্দটাও ব্যবহার করেন না। সংস্কৃততে নাকি ছাত্রী মানে ছাত্রের বউ। শব্দটার মূলে খানিক পিতৃতন্ত্র খুঁজে পান তিনি।


এইসবের জন্য লোকজন বঙ্কুবাবুকে পাগল ঠাওরায়। বঙ্কুবাবু কিছু বলেন না। তাঁর মাথায় যে বেশ অনেকটা ছিট রয়েছে এ তো তিনি নিজেই ভালো মতো জানেন। 


মাঝেমধ্যেই পুরনো ছাত্ররা ফোন করে তাঁকে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ভারী আনন্দ পান তিনি। হঠাৎ করেই একটা ঘটনা ঘটল। একটি ছাত্র মেসেজ করেছে তাঁকে। সে আবার খুব দুষ্টু। অনেকদিন আগে প্রাইমারি স্কুল থেকে হাইস্কুলে চলে গেছে । নাম বলে দিয়ে সে পরীক্ষা করছে বঙ্কুবাবুর তাকে মনে আছে কিনা। বঙ্কুবাবু পড়েছেন মহা গেরোয়। বঙ্কুবাবুর স্মৃতিশক্তি খুব ভালো এ কথা বঙ্কুবাবুর পরম বন্ধুও বলবে না। বন্ধুমহলে ভুলোমানুষ বলে বরং খ্যাতি আছে তাঁর। কিন্তু এ যে ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষা। তবে যে ছাত্রদের ভালোবাসেন বলে বঙ্কুবাবুর এত গর্ব! ছি ছি! এই সময় মেয়েটি হোয়াটসঅ্যাপে তার এইসময়ের ছবি পাঠাল। যথারীতি বঙ্কুবাবু এইবারেও চিনতে পারলেন না। বর্ষায় চারাগাছের মতো এই বয়সটায় বাচ্চাগুলো বেড়ে ওঠে। হঠাৎ করেই এত লম্বা হয়ে যায় যে বঙ্কুবাবুর অবাক লাগে। এক সময় তো এরাই তাঁর কোমরের বেশি লম্বা ছিল না! কোন শিল্পীর তুলি তাদের বদলে দিল এতখানি! যে ছাত্রের ছবি বঙ্কুবাবু দেখছেন তাকে তিনি চিনতেই পারছেন না। ভীষণ লজ্জা করছে বঙ্কুবাবুর। ঠাণ্ডা ঘরে ফ্যানের তলায় বসে তিনি ঘেমে উঠছেন অস্বস্তিতে। মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর ছোটোবেলার কথা। 


যে প্রাইমারি স্কুলে বঙ্কুবাবু পড়তেন সেইখানে সিদ্ধার্থবাবু বলে একজন মাস্টারমশাই বাংলা পড়াতেন। তাঁকে খুব ভালোবাসতেন বঙ্কুবাবু। হাইস্কুলে উঠে যাওয়ার অনেকদিন পর একবার সেই স্যারের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। স্যারের চোখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারেন বঙ্কুবাবুকে বঙ্কুবাবুর প্রিয় মাস্টারমশাই ভুলে গেছেন। সেই শেষ গরমের বিকেলে কলেজ স্ট্রিটের শতাব্দী প্রাচীন ইস্কুল থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল এক অভিমানী কিশোর। কষ্টে লাল হয়ে ছিল তার চোখ। জীবনে যতটুকু ভালোবাসা পেয়েছে সে সবটাই তো মাস্টারমশাইদের কাছ থেকে। সেখানে একজন মাস্টারমশাই ভুলে গেছেন তাকে, এই কথা বড়ো কঠিন হয়ে বেজেছিল তার বুকে।


ইতিহাস তবে সত্যিই ফিরে আসে! আজকের মাস্টার বঙ্কুবাবু দেখতে পাচ্ছেন অভিমানী কিশোর বঙ্কুবিহারী দত্ত ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে স্কুল থেকে। সমস্ত কলেজ স্ট্রিট, ভিড়, বইয়ের দোকান সব যেন জল ছবি হয়ে আছে। তার ভেতর দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে অবুঝ কৈশোর। 


স্কুলেই কালিদাস রায়ের একটা কবিতা পড়েছিলেন বঙ্কুবাবু। “মালিকা পরিলে গলে প্রতি ফুল কেবা মনে রাখে”। জীবন এসে সেই কবিতা এমন ভাবে বোঝাবে বঙ্কুবাবুকে তা কি তিনি জানতেন! 


এর মধ্যেই সেই ছাত্র পাঠিয়ে দিয়েছে মাস্টার-ছাত্রের যুগল ছবি। স্কুলের কোনও অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছে সে, আর বাসন্তী পাঞ্জাবি পরে নীচু হয়ে বঙ্কুবাবু হারমোনিয়ামে মাইক ধরে আছেন। এক ধাক্কায় বঙ্কুবাবু পিছিয়ে গেলেন বছর চার। এই মেয়েটি থার্ড বেঞ্চের কোনায় বসত না!! 


বঙ্কুবাবু দেখতে পাচ্ছেন হোয়াটসঅ্যাপ ভরে উঠছে ফুলে। বঙ্কুবাবুর দেখতে পাচ্ছেন তাঁর ফেলে আসা মাস্টারমশাই সিদ্ধার্থবাবু স্কুলের লম্বা লনে দাঁড়িয়ে আছেন। দীর্ঘদেহী ফর্সা মানুষ। ব্যাকব্রাশ করা চুল আর গোঁফ। তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। অনেক বছর পেরিয়ে মাস্টার ছাত্র মুখোমুখি। স্কুল শেষের ঘণ্টা বেজে গেছে কখন! 


ক্লাসটা তবু শেষ হচ্ছে না।


কভার- https://bit.ly/3zC13Lw

#বঙ্কুবাবু #বিবস্বান দত্ত #মুক্তগদ্য #ছাত্র-শিক্ষক

  • Sayandeep Gupta
    Sep 26, 2021 at 7:34 am

    ভালোবাসা ছাড়া তো আর কিছুই দেওয়ার নেই। থাকলে, এই লেখারই প্রাপ্য হত।

  • Sharmistha Chatterjee
    Sep 24, 2021 at 12:31 pm

    Khub valo laglo bolle boddo kom bola hobe

  • রণিতা
    Sep 24, 2021 at 10:58 am

    অপূর্ব লিখেছিস রে!

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

90

Unique Visitors

227491