ফিচার

পর্দায় অরণ্যরাজ

বিপ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য July 11, 2020 at 11:27 am ফিচার

নব্বইয়ের দশকে ইস্কুলবেলা কাটানো যে ভারতীয় বাচ্চারা ফি সপ্তাহান্তে টিভির পর্দায় অরণ্যরাজ টারজানের হুঙ্কার শুনে অভ্যস্ত, তাদের এ কথা মনে করিয়ে দেবার দরকার পড়ে না যে মার্কিন পাল্প লেখক এডগার রাইস বারোজ সৃষ্ট এই প্রবল জনপ্রিয় চরিত্রটিকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিশ্বব্যাপী আকর্ষণের অন্যতম কারণ হল তার চলচ্চিত্রায়ণ। অল স্টোরি ম্যাগাজিনে বারোজের প্রথম টারজান কাহিনী টারজান অফ দি এপস (1912) প্রকাশের মাত্র বছর ছয়েক পরেই পর্দায় আসে এলমো লিঙ্কন অভিনীত প্রথম টারজান চলচ্চিত্র টারজান অফ দি এপস (1918)। তবে টারজানের ছবির স্বর্ণযুগ শুরু হয় যখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন সাঁতারু জনি ওয়েইসমুলার মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের সঙ্গে সাত বছরের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, মুক্তি পায় টারজান দি এপ ম্যান (1932)। সুদর্শন ওয়েইসমুলার ও স্বল্পবসনা মরিন ও’সালিভানের আবেদনে ভেসে যায় দর্শক, কোথাও কোথাও একই প্রেক্ষাগৃহে দিনে পাঁচবার থেকে ছ’বার অবধি দেখানো হতে থাকে ছবিটি। দশ বছরে এমজিএম প্রযোজিত ছয়টি টারজান চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ওয়েইসমুলার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ্রাসী আবহে কমিকসে সুপারম্যান ও ক্যাপ্টেন আমেরিকার পাশাপাশি পর্দায় অরণ্যরাজের উদ্ধত পৌরুষ বিপুল জনপ্রিয়তা পায় মার্কিন দর্শকবৃন্দের। এখানে বলা দরকার, পর্দায় টারজানের অতিপরিচিত উলুধ্বনিসদৃশ হুঙ্কারটি প্রথম শোনা যায় ওয়েইসমুলারের গলাতেই, লিঙ্কনের ছবিটি ছিল নির্বাক। ওয়েইসমুলারের প্রবল জনপ্রিয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বারোজ স্বয়ং, টারজান অ্যান্ড দ্য ফরেন লিজিয়ন (1947) নামক তাঁর শেষ টারজানের উপন্যাসে তিনি দেখান, শ্রিম্প নামক একটি চরিত্র টারজানকে ওয়েইসমুলার বলে ভুল করে। খোদ স্রষ্টার লেখনীতে চরিত্রের পরিচিতি ছাপিয়ে যাচ্ছে অভিনেতার আবেদন, যে কোনো অভিনেতার কাছে এ এক অনন্য সম্মান।


এমজিএমের চুক্তি শেষ হবার পরে আরকেও ফিল্মসের সাথে আরও ছয়টি টারজানের ছবি করেন ওয়েইসমুলার, যদিও সেগুলির প্রোডাকশন বাজেট ও জৌলুস ছিল অনেকটাই কম। ষাট ও সত্তরের দশকে টারজানকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র প্রায় নেই বললেই চলে, ওয়েইসমুলারকে ঘিরে নস্টালজিয়া তখনও জনমানসে প্রবল। তবে রবিবার সকালে এনবিসি চ্যানেলে সম্প্রচারিত রন এলাই অভিনীত টারজান টিভি সিরিজ কচিকাঁচাদের মধ্যে মোটামুটি জনপ্রিয় হয়। ক্রমশ পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব ছাপ ফেলে টারজানের আবেদনে, রোজ সকালে শ্বেতাঙ্গ নায়কের দ্বারা আফ্রিকার আদিবাসী নিধনের দৃশ্য ছোটদের পক্ষে ঠিক কতটা ‘শিক্ষামূলক’এ প্রশ্ন উঠতে শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহলে, সওয়াল ওঠে টারজান কাহিনীগুলির নির্লজ্জ পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধেও। আশির দশক থেকে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়, টারজানের গল্পগুলির মূল দর্শনটিকে পর্দায় বিনির্মাণ ও পুনর্নিমাণের প্রয়াস। 1981 সালে মুক্তি পায় লাস্যময়ী বো ডেরেক অভিনীত টারজান, দি এপ ম্যান, যার ট্যাগলাইন ছিল ‘আনলাইক এনি টারজান ইউ হ্যাভ এভার সিন!’ সমালোচকরা ছবিটিকে নিম্নমানের পর্নোগ্রাফি বলে উড়িয়ে দিলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে এই প্রথম কোনো টারজান ছবিতে জেন পোর্টারের চরিত্রটি অধিক গুরুত্ব পায়, এমনকি সম্পূর্ণ কাহিনীটিই বর্ণিত হয় জেনের দৃষ্টিকোণ থেকে। 1999 সালে নির্মিত ডিজনি প্রযোজিত অ্যানিমেটেড টারজান ছবিতে টারজানের ব্রিটিশ বংশপরিচয় উহ্য রাখার মাধ্যমে তাঁর চরিত্রের সাম্রাজ্যবাদী অংশটি সযত্নে ছেঁটে ফেলা হয়, স্ত্রী জেন ও শ্বশুর আর্কিমিডিস পোর্টারের সঙ্গে সভ্যতার স্পর্শবিহীন এক অরণ্যলালিত স্বর্গে থেকে যায় সে। 2013 সালে রাইনহার্ড ক্লুস পরিচালিত জার্মান অ্যানিমেটেড টারজান ছবিতে অরণ্যরাজ সরাসরি যুদ্ধে নামে নয়া ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে, তার প্রতিপক্ষ অরণ্যসম্পদ ধ্বংসকারী গ্রেস্টোক এনার্জিস কোম্পানির অসাধু সিইও। টারজানের সাম্প্রতিকতম চলচ্চিত্রায়ণ ঘটেছে হ্যারি পটার খ্যাত ডেভিড ইয়েটস পরিচালিত দ্য লেজেন্ড অফ টারজান (2016) ছবিতে, ইতিহাস সচেতন এই ছবিটির চিত্রনাট্যের মধ্যে নিউ হিস্টোরিসিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই ছবিতে জন ‘টারজান’ ক্লেটন দাসত্ববিরোধী ইতিহাসের বরেণ্য চরিত্র জর্জ ওয়াশিংটন উইলিয়ামসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লড়তে নামে বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড শাসিত কঙ্গোর দাসপ্রথার বিরুদ্ধে। ছবিটিতে টারজানের পাশাপাশি মার্গট রবি অভিনীত জেনের চরিত্রটিকে সচেতনভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কখনও কখনও সে টারজানের চেয়েও সপ্রতিভ। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বারোজ সাহেবের ধরাবাঁধা জন ক্লেটন, লর্ড গ্রেস্টোকের পরিচয় অতিক্রম করে টারজান আজ এক সচল, সজীব সাংস্কৃতিক আইকন, শিল্পের স্বাভাবিক নিয়মেই যে পুনরাবিষ্কৃত হয়ে চলেছে নিত্য নতুন রূপে।


চিত্রঋণ :
১) ডেভিড ইয়েটস পরিচালিত ‘দ্য লেজেনড অব টারজান (২০১৬) ছবির দৃশ্য।
২) ডিজনি পরিচালিত অ্যানিমেশন ছবি টারজান (১৯৯৯) -এর পোস্টার।

#ফিচার

  • Tanusankar Chakraborty
    July 19, 2020 at 2:16 am

    Loved reading it. Succinct, with the ability to make the reader glue to the text. Well done!

  • Susanta chakraborty
    July 18, 2020 at 1:06 pm

    Khiub sunder lekha

  • Writuparna chakraborty
    July 12, 2020 at 3:17 am

    সুন্দর তথ্যভিত্তিক লেখা।

  • Hemonta Mondal
    July 11, 2020 at 4:42 pm

    বেশ সুন্দর তথ্য সম্বৃদ্ধ ও চিত্রনাট্য এর তুলনামূলক আলোচনা! এক ধাপ এগিয়ে দেবে যখন আবার সিনেমার পর্দায় দেখবো। এটা আমাদের আরো নিখুঁত ভাবে সিনেমা দেখতে শেখাবে।

  • Anindita De
    July 11, 2020 at 4:26 pm

    💕💕

  • Bivash Mandal
    July 11, 2020 at 2:56 pm

    Valo laglo...sir.

  • Rajarshee Gupta
    July 11, 2020 at 2:21 pm

    রুপোলী পর্দায় টারজানের বিবর্তন-যাত্রা ও দৃষ্টিকোণের পরিবর্তনের বিষয়টি সেভাবে চর্চিত নয়। এই ছোট্ট সুন্দর লেখাটি সে অভাব পূরণ করল।

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

14

Unique Visitors

225510