ঘুম-বুড়ির কথা
_1366x1366.jpg)
ভারতবর্ষে পা রাখবার পর সবথেকে মারাত্মক যে অন্তরায়গুলির মুখোমুখি হতে হয় ব্রিটিশদের, তাদের অন্যতম ছিল সেখানকার প্রচণ্ড গরম। শার্লট ব্রন্টির জেন আয়ার উপন্যাসের নায়িকা যে মুহূর্তে ভারতে যাবার কথা ভাবে, ডায়ানা রিভার্স চমকে বলে ওঠে, “না না, সেখানে গেলে তোমার সোনার বরণ অঙ্গ ক্যালকাটার গরমে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে যে!” ভয়ঙ্কর ইন্ডিয়ান সামারের হাত এড়িয়ে পালাবার জন্যই উনবিংশ শতাব্দীতে পাকাপাকিভাবে ভারতবর্ষে জমিয়ে বসা ইংরেজের দল হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত অঞ্চলগুলির আধুনিকায়নের মাধ্যমে শুরু করে একের পর এক হিল স্টেশন সৃষ্টির পালা, তৈরি হয় আজকের সিমলা, মুসৌরি, এবং সর্বোপরি, দার্জিলিং।
সিকিম এবং ভুটানের স্থানীয় নেতৃত্বের হাত থেকে দার্জিলিংকে ছাড়িয়ে আনবার পর তাকে আধুনিক হিল স্টেশন হিসেবে গড়ে তোলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লেফটেন্যান্ট রবার্ট নেপিয়ার এবং কোম্পানি সার্জন আর্থার ক্যাম্পবেল, দার্জিলিংকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ধীরে ধীরে দার্জিলিঙে লোকসমাগম বৃদ্ধি পেতে থাকে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশদের পাশাপাশি শিক্ষিত বাঙালিদের কাছেও ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে শুরু করে দার্জিলিং।
মেরি লুই প্র্যাট, এডওয়ার্ড সঈদ ইত্যাদি বিভিন্ন লেখকের রচনা থেকে জানা যায়, উপনিবেশের পটভূমিকায় রচিত ইউরোপীয় ভ্রমণবৃত্তান্ত বা কল্পকাহিনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, স্থানীয় অধিবাসীদের ঠিক যথার্থ মানুষ হিসেবে না স্বীকার করে পারিপার্শ্বিকের অংশ হিসেবে তাদের উপস্থাপিত করা, মানবিক অপেক্ষা তাদের নান্দনিক তাৎপর্যটিকেই প্রাধান্য দেওয়া। দার্জিলিঙের ঘুম-বুড়িকে ঘিরে তৈরি হওয়া কাহিনীতে এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দার্জিলিঙে আগত প্রায় প্রত্যেক ব্রিটিশ অথবা শিক্ষিত ভারতীয় তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন ঘুম-বুড়ির কথা, সাহেবরা যার নাম দিয়েছিল ‘উইচ অফ ঘুম’ (ঘুমের ডাইনি)। দার্জিলিঙে রেলপথ তৈরি হবার পর থেকেই ঘুম স্টেশনে ভিক্ষারতা এই রমণীর বয়স কেউ বলত আশি নব্বই, কেউ বা একশো-দেড়শো। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দার্জিলিং ভ্রমণকারী একাধিক ইউরোপীয়ের তোলা ও তৎকালীন বিখ্যাত ফটোগ্রাফ প্রিন্টিং কোম্পানি বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের ছাপা ঘুম-বুড়ির একাধিক আলোকচিত্র সংরক্ষণ করা আছে ব্রিস্টল মিউজিয়াম, স্কটিশ ন্যাশনাল গ্যালারি, ক্যালিফোর্নিয়া মিউজিয়াম অফ ফটোগ্রাফি প্রভৃতি স্থানে। লোলচর্ম, পক্ককেশ ঘুম-বুড়ির মুখের শিশুর মত সরল হাসি তাকে ঘিরে একটি রহস্যের বাতাবরণ তৈরি করেছিল, এবং ‘ঘুমের ডাইনি’ নামটিও যেন শহুরে অভ্যাগতদের চোখে দার্জিলিঙের নতুনত্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘুম বুড়ির চরিত্রে একটি মধ্যযুগীয় বিজাতীয়তা যোগ করত। রহস্যময়ী ঘুম-বুড়ি শহুরে অভ্যাগতদের কাছে হয়ে উঠেছিল কুয়াশাঘেরা দার্জিলিঙকে ঘিরে তৈরি হওয়া অজানা আকর্ষণের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, ব্রিটিশদের কাছে যেমন দার্জিলিঙের বৌদ্ধ গুম্ফা মুণ্ডিত মস্তক লামা মন্ত্রোচ্চারণ ও প্রেয়ার হুইলের পাশাপাশি ঘুম-বুড়ি ‘ওরিয়েন্টাল’ ভারতবর্ষের আরেকটি দিক তুলে ধরত, অন্যদিকে শিক্ষিত কলকাতা নিবাসী বাঙালি ট্যুরিস্টের কাছে পাইন-বার্চ-ফার্ন-রডোডেনড্রনের মতোই ঘুম-বুড়ি ছিল দার্জিলিঙের রোমাঞ্চকর নতুনত্বের আরেক নাম।
দার্জিলিঙে আগত সর্বপ্রথম শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে একজন ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, স্ত্রী পুত্র কন্যা সমেত বেশ কিছু সময় তিনি এই শৈলশহরে কাটিয়ে যান। এই ভ্রমণের বিবরণ সহজ সুন্দর ভাষায় তিনি লিপিবদ্ধ করে যান দার্জিলিঙের পথে প্রবন্ধে। লক্ষণীয়, উপেন্দ্রকিশোর কিন্তু তাঁর বর্ণনায় শিক্ষিত বাঙালির পরিচিত দৃষ্টিভঙ্গিই অনুসরণ করেছেন, এবং ঘুম-বুড়ির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি (উপেন্দ্রকিশোরের সংস্থা ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে ঘুম-বুড়ির একটি ছবিও ছেপে বের করা হয়)। ঘুম-বুড়ির ছোট্ট বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে তার ভয়ঙ্কর কুঁচকে যাওয়া মুখের চামড়া, প্রায় অদৃশ্য চোখ এবং ঘুম স্টেশনে ট্রেন থামামাত্র চিরাচরিত ক্ষীণ স্বরে উচ্চারিত তার ‘বাবু, পইসা?’ শব্দবন্ধটি। সবমিলিয়ে পত্রিকার অল্পবয়সী পাঠকদের কাছেও যেন তার রহস্যময় মূর্তিটিই উপস্থাপিত হয়।
কিন্তু ঘুম-বুড়ির একটি ব্যতিক্রমী বর্ণনা আমরা পাই উপেন্দ্রকিশোরের দ্বিতীয়া কন্যা পুণ্যলতা চক্রবর্তী রচিত ছেলেবেলার দিনগুলি নামক স্মৃতিকথায়। সেই একই যাত্রার অভিজ্ঞতায় ঘুম-বুড়ি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে পুণ্যলতা লিখছেন, ‘সাহেবরা ওর নাম কেন যে ‘ঘুমডাইনি’ (উইচ অব ঘুম) রেখেছিল জানি না। শিশুর মতো সরল ওর মুখখানি দেখলেই ভাল লাগে, সকলেই খুশি হয়ে ওকে ভিক্ষা দেয়।’ পুণ্যলতা যেন ঘুম-বুড়িকে ঘিরে সভ্য ইউরোপের তৈরি মধ্যযুগীয় বাতাবরণটি ভেঙে দিচ্ছেন, প্রশ্ন করছেন এর যৌক্তিকতাকে। শুধু তাই নয়, পুণ্যলতার বর্ণনায় ঘুম-বুড়ি শুধুই রেলপথের ধারে অপেক্ষমান দার্জিলিঙের ঔপনিবেশিক পর্যটন সংস্কৃতির এক নিষ্ক্রিয় অংশ নয়, তিনি তুলে ধরেছেন তার মানবিক দিকটিকেও। পুণ্যলতা জানাচ্ছেন, মৃত্যুর আগে ঘুম-বুড়ি তার সারাজীবন ভিক্ষা করে সঞ্চিত দশ-বারো হাজার টাকা দান করে গিয়েছিল দরিদ্রদের বাসোপযোগী একছি ধর্মশালার নির্মাণকল্পে। ঘুম-বুড়ির এই অপ্রত্যাশিত আত্মত্যাগ যেন তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া কল্পকথার জাল ছিঁড়ে তাকে পাঠকের সামনে একটি রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়, দার্জিলিঙের ভালোমন্দে সেও হয়ে ওঠে এক সক্রিয় অংশীদার। মনে প্রশ্ন জাগে, নিজে নারী বলেই কি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে অপর এক নারী ঘুম-বুড়ির মানবায়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন পুণ্যলতা?
[কভার ছবিতে ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের ছাপা ঘুম- বুড়ির ছবি।]
#ফিচার #ঘুম- বুড়ি #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
Sridipa
খোদ পশ্চিমবঙ্গেই যে কত অজানা গল্পের ভাণ্ডার রয়েছে, ভাবা যায় না। ঘুমবুড়ির কাহিনির পাশাপাশি পুণ্যলতা দেবীর লেখালেখিও ভীষণই কম পঠিত এবং আলোচিত। অনেক ধন্যবাদ।
Soumyo
অজানা তথ্যের দুরন্ত পরিবেশন!
Bengali literature and colonial period is still now a hidden treasure
Want to know more about witch craft and superstition in colonial India.
Dipra Sarkhel
অজানা কতই না ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বয়ান ছড়িয়ে রয়েছে, জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন এর জন্য যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
Somrita Chakraborty
Excellent information.