একজন খলনায়ক এবং কমিক্স

কমিক্স কি শুধু মনগড়া গল্পই বলে? নাকি ইতিহাসের আশ্চর্য দলিল হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে ছবিতে মোড়া সেইসব অগণিত রঙিন বা সাদাকালো পাতা? কমিক্সপ্রেমী মাত্রই জানেন দ্বিতীয় কথাটা কী ভীষণভাবে সত্যি। আচ্ছা, কখনও বাস্তবের কোনও চরিত্রকে কমিক্সের পাতায় উঠে আসতে দেখেছেন? না, জীবনীমূলক চিত্রকাহিনির কথা বলছি না কিন্তু! দস্তুরমতো কল্পকাহিনি, হতে পারে তুমুল জনপ্রিয় কোনও সুপারহিরো কমিক কিংবা টানটান কোনও গ্রাফিক নভেল, সেখানে যদি আমার আপনার পরিচিত কোনও ব্যক্তিকে দেখতে পাওয়া যায়? বারংবার? অজস্র শিল্পীর তুলিতে? তাঁর জীবদ্দশায় এমনকি মৃত্যুর বহুকাল বাদেও? নানা দেশে, নানা ভাষায়?
কী বলছেন, কে আছেন এমন? যদি বলি বিখ্যাত নন, কুখ্যাত একজন? এবার কি একটু একটু বোঝা যাচ্ছে? ঠিকই ধরেছেন, তিনি বিশ্বত্রাস স্বয়ং অ্যাডলফ হিটলার!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বইপড়ুয়াদের মধ্যে মাধ্যম হিসেবে কমিক্সের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত প্রায় একই সময়ে ঘটেছিল। আর সেই যুদ্ধ সর্বকালীন এক কুখ্যাত মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটাল পৃথিবীবাসীর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে এখনও মানবেতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ধরা হয়, আর সেই আমলে আমেরিকাসহ বহু দেশের রাতের ঘুম যিনি কেড়ে নিয়েছিলেন, অথচ ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন, তিনি হিটলার। মুসোলিনি, হিরোহিতো, তোজো – এঁরা শত্রুপক্ষ হলেও হিটলারকে আমেরিকা সবসময়েই প্রধান শত্রু হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। মজার ব্যাপার, এই যুদ্ধের যুগেই কমিক্সের দুনিয়ায় একের পর এক নতুন সুপারহিরোর আবির্ভাব ঘটে। অধিকাংশই আমেরিকায়। আর ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ -এর মধ্যে প্রকাশিত অজস্র কমিক্সে সেই সুপারহিরোদের প্রায় প্রত্যেকেরই প্রধান প্রতিপক্ষ হয়েছিলেন হিটলার স্বয়ং! কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন সে সময়ের কমিক্স শিল্পীরা? কিছুটা আন্দাজ পেতে সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত যুগের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী জ্যাক কার্বির বয়ানের দিকে চোখ রাখা যাক – “পথে বেরলেই আমার নজরে পড়ত মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহের স্তূপ, মরা গোরু, এমনকি মৃত শিশু, মৃত ঘরবাড়ি আর মৃত শস্যক্ষেত্র আর একটা মরে যাওয়া আকাশ। সর্বত্র ধোঁয়ায় ছেয়ে থাকা, আপনি শত চেষ্টা করলেও সেখানে কোনও ‘আকাশ’ দেখতে পাবেন না। জঘন্য অবস্থা!” আমেরিকাবাসীর প্রধান শত্রুকে বাস্তবে না পেরে কমিক্সে শায়েস্তা করেই হয়তো সুখ খুঁজে নিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। সেসব গল্পের অধিকাংশতেই উঠে এসেছে নাৎসি বাহিনীর তাণ্ডব, বর্ণবিদ্বেষ, গ্যাস চেম্বারের ভয়াবহতা, এমনকি নানাবিধ মারণাস্ত্রও। ক্যাপটেন আমেরিকা থেকে থর, ডেয়ারডেভিল, ফ্যান্টম, এমনকি সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান কেউই বাদ যাননি এইসব অভিযানে।
আর কারা এঁকেছিলেন সেইসব কমিক্সের ছবি? জো সিমন, জ্যাক কার্বি, অ্যালেক্স শ্যমবার্গ, উইল আইজ়নার, ল্যু ফাইনের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের তুলিতে বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছিলেন ‘ফুয়েরার’। কমিক্স মাধ্যম হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় হওয়ার দরুন সেটা হয়ে উঠল দেশাত্মবোধ জাগানোর অস্ত্র। কমিক্সের মলাটে হিটলার বা মুসোলিনির মতো কোনও শত্রুপক্ষের নেতার ছবি থাকলে স্বভাবতই সে বইয়ের বিক্রির সম্ভাবনা বাড়ত। হলও তাই। বেশির ভাগ গল্পেই হিটলারের চরিত্রটিকে ভীতিপ্রদ মূর্তিমান সন্ত্রাসের পরিবর্তে নিতান্ত ভাঁড়সদৃশ নির্বোধ হিসেবে দেখানো হল।
যেমন ধরা যাক ১৯৪১-এ প্রকাশিত ডেয়ারডেভিলের একটি কমিক্সের মলাট, ‘ডেয়ারডেভিল ব্যাটলস হিটলার’, যেখানে হিটলারের ভয়ার্ত মুখের বিরাট ছবির পাশে ডেয়ারডেভিল, সিলভার স্ট্রিক্, পাইরেট প্রিন্স, ডিকি ডিনের মতো একাধিক জনপ্রিয় সুপারহিরোরা উপস্থিত। এই গল্পে বাস্তবের খলনায়ক হিটলার ইতিমধ্যেই সুপরিচিত কুখ্যাত কাল্পনিক খলচরিত্র ‘ক্ল’-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মানুষের অনিষ্ট করতে উদ্যত হন এবং যথারীতি ডেয়ারডেভিল অ্যাণ্ড কোং-এর হাতে পর্যুদস্ত হন।

এখানে একটা কথার উল্লেখ না করলেই নয়, মার্কিনিরা কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যোগদান করে ১৯৪১-এর ডিসেম্বরে, অথচ তার ঢের আগে থেকেই তারা তাদের বিচিত্র পোশাক পরা সুপারহিরোদের হিটলারের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়েছে বারংবার। নিচে দেওয়া ছবিটা দেখুন, ক্যাপ্টেন আমেরিকা হিটলারকে প্রবল এক রাইট হুক ঘুঁষিতে পরাস্ত করছে। ’৪১-এর মার্চে প্রকাশিত এই কমিক্সটি তুমুল জনপ্রিয় হয়।
শুধু ক্যাপ্টেন আমেরিকাই বা কেন, সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, থর কেউই পিছিয়ে ছিল না হিটলার দমনে। ছবিগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে সেটা।

সুপারহিরোদের পর আসে সাইডকিকদের পালা। তারাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? মিস্টিক কমিক্স, ফ’সেট কমিক্সের অজস্র ইস্যুতে এমন অনেক ছোটখাটো কমিক চরিত্র হিটলারকে মনের সুখে একহাত নিয়েছেন। গত শতকের চারের দশকে আমেরিকা তাদের বৈচিত্র্যে ভরা জনগণের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতেও কমিক্সকে হাতিয়ার করেছিল। হিটলারের মতো শক্তিশালী পক্ষকে যুঝবার জন্য সেইসব কমিক্সের প্রচ্ছদে ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষ একত্রে লড়াই করছে এমন ছবি থাকত। উদাহরণ হিসেবে এই ছবিটা থাকল।

১৯৪৫-এ হিটলার মারা যান। নাৎসিরা পরাজিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই ঘটনাপ্রবাহ কমিক্স দুনিয়ায় এক নয়া ট্রেন্ডের সূচনা করে। যদি হিটলার কোনোভাবে মারা না যেতেন, তাহলে কী হত? হিটলারের রহস্যাবৃত মৃত্যু এইসব জল্পনাকে আরও উস্কে দিল। অমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ একনায়ক কিনা মুখে বন্দুকের নল গুঁজে আত্মহত্যা করলেন! এখান থেকেই হিটলারকে নিয়ে নানাবিধ ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব বা আত্মগোপনকারী তত্ত্বের শুরুয়াত।
মারভেল কমিক্সের বিখ্যাত ফ্যান্টাস্টিক ফোরের কিছু গল্পেও হিটলার এসেছেন। বাস্তবের দুনিয়ায় হিটলারের মৃত্যুর পর কমিক্সে কখনও তাঁর এক ক্লোনকে হত্যা করেছে নায়করা, কখনও বা তাঁর কোনও অনুচর মায়াজাল বিস্তার করে সৃষ্টি করেছে দৈত্যসম হিটলার। ফ্যান্টাস্টিক ফোরের সঙ্গে সার্জেন্ট নিক ফিউরিকেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে দেখা গেছে এই গল্পগুলিতে।

এবার আসি মারভেল কমিক্সেরই এক অন্যরকম ইস্যুর গল্পে। মারভেল ফ্যানদের কাছে প্রবল জনপ্রিয় প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ছবি, কমিক্সে ঠাসা মারভেল ম্যাগাজিনের ১৯৯২ সালের বিশেষ সংখ্যায় ক্যাপ্টেন আমেরিকার জবানিতে এক অদ্ভুত গল্প পরিবেশিত হয়। অনেককাল আগের এক বড়দিনে ক্যাপ্টেন আমেরিকা এক অনাথাশ্রমের শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে যান, ঘটনাচক্রে সেদিনই সেখানে এক কাণ্ড ঘটে। এক কুখ্যাত মানুষ বন্দুকের নল ঠেকিয়ে কব্জা করেন শিশুদের প্রিয় স্বয়ং সান্টাক্লজকেই! তারপর ক্যাপ্টেন আমেরিকা কীভাবে সবাইকে তাঁর হাত থেকে রক্ষা করেন, সেই নিয়েই গল্প। বলা বাহুল্য সেই খারাপ লোকটি আর কেউ নন, স্বয়ং হিটলার। একটি ছবি এখানে দেখে নেওয়া যাক বরং। ডানপাশে রইল সেই গল্পেরই আরেকটি প্যানেলের ছবি। এখানে দেখা যাবে, হিটলারের মতো ভয়ানক খলচরিত্র সত্যিই এই জগতে ছিল কি না তা নিয়েও এই প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে যদি কোনও সংশয় থাকে, তা দূর করছেন ক্যাপ্টেন আমেরিকা।

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হেলবয় সিরিজের কমিক্সের দুটি সংখ্যায় আবার হিটলার পরপর দুবার আবির্ভূত হন। সেখানে ১৯৫২ সালের পটভূমিকায় এক যান্ত্রিক রণসাজে সজ্জিত হিটলারের সঙ্গে হেলবয়ের সম্মুখসমর দেখা যায়। প্রথম পর্বের শেষে হিটলার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও পরের সংখ্যায় দেখা যায় দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর মস্তিষ্কটি নাকি বিনষ্ট হয়নি, এক ভয়ানক গরিলার শরীরে প্রতিস্থাপিত হয়ে হিটলার আবার ফিরে আসেন এক দানবীয় রূপে। পরিশেষে অবশ্যই পাঠকের চাহিদা মেনে দুষ্টের দমন এবং মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়।

আর এই একুশ শতকে এসে? আর কি তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা হয় না? হয় তো বটেই, আরও রমরমিয়ে! যেমন, ২০০০ সালে হ্যামস্টার প্রেস প্রকাশিত ‘হিরোজ ভার্সেস হিটলার’, যেখানে গল্পের নায়কেরা সময় ভ্রমণ করে অতীতে গিয়েও হিটলারকে পরাস্ত করে আসছে। মানে, হিটলারের ভূত এখনও পিছু ছাড়ছে না। সবই কি এরকম গল্প? না, অন্যরকম কয়েকটা সাড়া ফেলে দেওয়া কাজের কথা বলব এবার। আর্ট স্পিগেলম্যান রচিত ‘মাউস’ গ্রাফিক নভেল। এটি হিটলারের নারকীয় গণহত্যার বিভীষিকা থেকে কোনোক্রমে রক্ষা পাওয়া একজন ইহুদির আত্মকথা। ঘটনাচক্রে যিনি স্বয়ং লেখকের বাবা। শুধু গল্পের মূল চরিত্রদের আদল চিত্রে মানুষ নয়, মূষিকের! ইহুদিদের যে আসলে ইঁদুরের মতোই পিষে মারা হয়েছিল, যেখানে নাৎসি বাহিনীর জার্মানরা এক একটি শিকারি বিড়ালসম সেটাই বোঝাতে চাওয়া হয়েছে এখানে। এটি পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম গ্রাফিক নভেল। এর প্রচ্ছদটি একঝলক দেখলেই বোঝা যাবে এটি কোথায় সবার চেয়ে ভিন্ন।
২০০০ সালে প্রকাশিত পাস্কাল ক্রোসি’র আউশভিৎস গ্রাফিক নভেলটিরও উল্লেখ করতে হয় এই প্রসঙ্গে। সাদা কালোয় আঁকা ছবিতে কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে এখানে। এই কমিক্সেও গণহত্যার থেকে কোনোক্রমে বেঁচে যাওয়া এক ইহুদি দম্পতির কাল্পনিক আখ্যান বর্ণিত হয়েছে।

নরওয়ের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট জ্যাসন ২০০৮ সালের আইজ়নার পুরস্কারে ভূষিত হন তাঁর ‘আই কিলড অ্যাডলফ হিটলার’ বইটির জন্য। শক্তিশালী শিল্পী জ্যাসনের অনবদ্য পরিমিত রেখার ব্যবহার, রসবোধ এখানেও চমকে দেয়। মূল চরিত্রগুলি মানবেতর কুকুরের আদলে গড়া। তবে তাতে মজাটা আরও বাড়ে। কাহিনিসূত্র অনেকটা এরকম: এক পোড়খাওয়া ভাড়াটে খুনি তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজটা পায়, যখন তাঁকে বলা হয়, টাইম মেশিনে সময়ের পথে পিছিয়ে গিয়ে হত্যা করতে হবে স্বয়ং হিটলারকে। কিন্তু ধূর্ত হিটলারও প্রস্তুত হয়েই ছিলেন এমন আক্রমণের জন্য। তারপর কী ঘটে, শেষমেশ সেটা নিয়ে একটা জবরদস্ত টুইস্ট আছে। সেটুকু আপাতত সাসপেন্সই থাক।

গত কয়েক দশক ধরে হিটলার বা তাঁর নাৎসি বাহিনীকে নিয়ে এত অজস্র কমিক্স প্রকাশিত হয়েছে, যা এত স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা একপ্রকার অসম্ভব। বরং শেষ করার আগে উৎসাহী পাঠকদের জন্য একটি বইয়ের কথা বলি, যেখানে এযাবৎ প্রকাশিত এই গোত্রের বহু কমিক্সের মলাট একত্রে প্রদর্শিত হয়েছে। বইটির নাম ‘টেক দ্যাট অ্যাডলফ’, সংকলক তথা গ্রন্থকার মার্ক ফার্টিগ। বইটির প্রচ্ছদ এবং সেখান থেকে নেওয়া একটি ছবি দেওয়া হল। পরিশেষে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত আরও বেশ কিছু কমিক্স যেখানে হিটলারকে খলচরিত্র, পিশাচ, দৈত্য ইত্যাদি নানারূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে, তেমন কয়েকটির প্রচ্ছদের ছবি দিয়ে আপাতত এই আলোচনায় ইতি টানলাম।

[চিত্রঋণ: অন্তর্জাল এবং লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ থেকে]
অভয়শঙ্খ মন্ডল
টানটান লেখা। শ্রমের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু বোঝার ক্ষেত্রে শ্রমসাধ্য নয়। খুবই প্রাঞ্জল।
Souvik
chomotkar alochonaa..
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
পড়লাম। ঋদ্ধ হলাম।