খেলা

বিশ্বমঞ্চে এক ধূমকেতু

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Aug 16, 2020 at 7:06 am খেলা

মনে আছে, কলেজে পড়াকালীন ভারতে ডিজিটাল হিউম্যানিটিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে প্রশ্ন করায় এক অধ্যাপক রীতিমতো খিঁচিয়ে উঠে বলেছিলেন, ‘ধাষ্টামো হচ্ছে? একটা ফিউডাল দেশ, যেখানে অভিনেতার ছেলে অভিনেতা, রাজনীতিবিদের মেয়ে রাজনীতিবিদ, ক্রিকেটারের ছেলে ক্রিকেটার হয়, সেখানে ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ? যত্তসব!’

সত্যিই তো, খুব একটা ভুল বলেননি তিনি। আধুনিকতা এ দেশে আংশিকভাবে এসে থমকে গিয়েছে, তাই সংবাদপত্রে ঝাঁ চকচকে অট্টালিকার শহুরে বিজ্ঞাপনের পাশেই দেখা যায় অসহায় বৃদ্ধাকে গ্রামে ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারার খবর, আপাত সরল ট্যালেন্ট হান্টের মোহে ছুটে যাওয়া তরুণ অভিনেতা আবিষ্কার করে নেপোটিজমের কুটিল ছক। এবং এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রাঁচির এক অজ্ঞাতকুলশীল যুবকের বিশ্বজয়ের গল্প। মেকন কলোনি থেকে ওয়াংখেড়ের ঝলমলে রাত পর্যন্ত যাত্রার রোমাঞ্চকর কাহিনি সংবাদপত্র ম্যাগাজিন পর্দার সুবাদে প্রায় লোকগাথার পর্যায়ে চলে গিয়েছে, ধীরে ধীরে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি হয়ে উঠেছেন একটা গোটা প্রজন্মের প্রেরণা, নিছক ক্রিকেটীয় ভক্তের বৃত্ত অতিক্রম করে এক মহাশক্তিধর ইয়ুথ আইকন। কারণ রূপকথার মত তাঁর উত্থান কাহিনি ভারতবর্ষের যুবসমাজকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে, একেবারে অখ্যাত জায়গা থেকে উঠে এসেও সেরাদের সঙ্গে টক্কর নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। ভারতীয় সমাজে সত্তর-আশির দশকে ক্রিকেট ছিল ব্রিটিশ আদবকায়দায় শিক্ষিত উচ্চমধ্যবিত্তের খেলা, মাঠে দাপিয়ে বেড়াত মুম্বই ও দক্ষিণ ভারতের খেলোয়াড়ের দল। নব্বইয়ের দশকে মূলত শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়কে কেন্দ্র করে ভারতীয় ক্রিকেটের বিপণনে উদারীকরণের ছোঁয়া লাগে, সংস্কৃতিবানের রেডিও শোনা থেকে ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়ে ক্লাবঘরে টিভির সামনে হল্লা করতে থাকা যুবকের ভিড়ে। কিন্তু শচীন ও দ্রাবিড়ের উত্থান মুম্বই ও দক্ষিণ ভারতের অভিজাত ক্রিকেটীয় ঘরানা থেকেই, আর সৌরভের পরিবারের সঙ্গে খেলাধুলোর যোগ সর্বজনবিদিত, ক্রিকেটের আঙিনায় তাঁকে কোনোমতেই অজ্ঞাতকুলশীল বলা চলে না। পাড়ার মোড়ে ঘিঞ্জি ঘরে তেরঙা নিয়ে হুল্লোড়ে ব্যস্ত মন্টু-পল্টু- বাবলুর দল যেন প্রথমবারের জন্য তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি খুঁজে পেল লালচুলো এক মৃদুভাষী উইকেটকিপারের মধ্যে, বাংলাদেশে অভিষেকের অল্পদিন পরেই যিনি পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কার বোলারদের স্রেফ থেঁতো করে দিতে পারেন আর সারা দেশজুড়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, কে এই মহেন্দ্র সিংহ ধোনি?

ভাবতে অবাক লাগে, এই ষোলো বছরে কতটা পথ তিনি কী সাবলীলভাবেই না পেরিয়ে এসেছেন! কেরিয়ারের প্রথমে লম্বা চুলের ক্যারিশমাটিক হার্ড হিটার থেকে অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব পাবার পর হয়ে উঠেছেন লোয়ার মিডল অর্ডারের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। প্রায় আনকোরা একটা দল নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ জিতে এসেছেন ক্রিকেটের এমন একটা ফর্ম্যাটে, যার সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, খোদ ক্রিকেটারদের ধারণাই অনেকাংশে স্পষ্ট ছিল না। একের পর এক জিতেছেন সিবি সিরিজ, এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। টেস্টে এক নম্বরের স্থায়ী আসন পেয়েছে ভারতীয় দল, আইপিএলে প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তাঁর দল চেন্নাই সুপার কিংস। ফিনিশার হিসেবে নিজেকে প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন, তাঁর আলোর গতিবেগে স্টাম্পিং নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন রসিকতা। এবং এতকিছু করেও বরাবরই থেকে গিয়েছেন যথাসম্ভব প্রচারের আড়ালে, ইংরেজিতে দ্রুত স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠলেও মিতভাষীর পরিচয়টি আগাগোড়া বজায় রেখেছেন। চূড়ান্ত সাফল্যের পরমুহূর্তেও উচ্ছল সতীর্থদের সামনে ঠেলে দিয়ে নিজে পিছনে চলে গিয়েছেন, ক্রিকেটবিশ্ব কুর্নিশ জানিয়েছে চাপের মুখে অবিচল তাঁর ঠাণ্ডা মাথাকে। মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ব্যক্তিগত জীবনে কোনো বিতর্কে জড়াননি, ক্রিকেট মাঠে অজাতশত্রু ইমেজের সঙ্গেই জনপ্রিয় হয়েছে স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে তাঁর কোয়ালিটি টাইমের ভিডিও। তাই তো তিনি প্রকৃত স্পোর্টসম্যান, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট থেকে শচীন তেন্ডুলকর থেকে বিরাট কোহলি, সবাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

কিন্তু বয়স কাউকে ছাড়েনা, তাঁকেও ছাড়েনি। কেরিয়ারের শেষদিকে উইকেটকিপিংয়ে ভুলভ্রান্তি হচ্ছিল, উঁচু শটগুলো নির্ভুলভাবে গ্যালারিতে আছড়ে পড়বার বদলে মাঝেমধ্যেই জমা হচ্ছিল ফিল্ডারের হাতে। ক্রিকেট একটি দলগত খেলা, এখানে ব্যক্তি যতই বড় হয়ে উঠুক, দিনের শেষে দলের স্বার্থে কেউ অপরিহার্য নয়। অমোঘ নিয়ম মেনে তাই ধোনিও সরে গেলেন, কিন্তু রেখে দিয়ে গেলেন কিছু প্রশ্ন। চাপের মুখে বিপক্ষের জমে যাওয়া ব্যাটসম্যানের সামনে আচমকা বোলার পরিবর্তন করে কে ঘুরিয়ে দেবে ম্যাচের মোড়? সাড়ে তিনশো তাড়া করতে নেমে একশো রানে পাঁচ উইকেট পড়ে গেলে কার মুখের দিকে তাকিয়ে আশায় বুক বাঁধবে ভারতের ক্রিকেটপ্রেমী? ধোনির মত উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান-ক্যাপ্টেন আবার কবে পাবে ভারতীয় দল? আদৌ পাবে কি? উত্তর জানা নেই। তবে এটুকু জানি, যতদিন ক্রিকেট বলে একটা খেলা থাকবে, ততদিন আপামর ভারতবাসীর কানে বারেবারেই বেজে উঠবে কিছু মায়াবী শব্দ, ‘ধোনিইইই, ফিনিশেস অফ ইন স্টাইল….।’



[কভার ছবি : pinterest]

#ধোনি #মহেন্দ্র সিংহ ধোনি #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

  • Amita Hajra
    Aug 21, 2020 at 6:46 am

    বাঃ

  • Atanu das
    Aug 17, 2020 at 5:51 am

    Pore khb vlo laglo ,eto sundor gochano akta lekha..Mon ta vlo Holo..!!#dada No one can take the place of dhoni both in the field and our hearts(generally).

  • Reeswav Chatterjee
    Aug 16, 2020 at 4:36 pm

    অপূর্ব সুন্দর হয়েছে লেখাটা.... মন ছুয়ে গেল। খুব জরুরি কিছু কথা। খুব সাবলীল ভাষায় লেখা। ABP এর পাতায় গৌতম ভট্টাচার্যর লেখা মনে পড়িয়ে দিলে।

  • Subarnika
    Aug 16, 2020 at 2:31 pm

    মন ভালো করা লেখা

  • ভাস্কর রায়
    Aug 16, 2020 at 10:14 am

    ক্যাপ্টেন

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

12

Unique Visitors

225508