ফিচার

বিপ্লবী সিনেমার আঁতুড়ঘর ঝিগা ভেরতভ দল

মৃণালিনী ঘোষাল July 25, 2020 at 4:55 am ফিচার

১৯৬৮ সাল। নকশাল আন্দোলনে পশ্চিমবাংলা তোলপাড়। একই সময় শ্রমিক আন্দোলনে উতরোল ফ্রান্সও। সে দেশের প্রায় ১১ লক্ষ শ্রমিক তখন মাওবাদী প্রভাবে এককাট্টা হয়ে এক আন্দোলন শুরু করেছিলেন, যার সঙ্গে ফ্রান্সের তাবৎ বুদ্ধিজীবী ও ছাত্ররাও যুক্ত হয়ে পড়েন। জাঁ পল সার্ত্র, সিমন দ্য বোভেয়ার মতো ব্যক্তিত্বরাও এঁদের সঙ্গে সামিল হন। প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র- নির্মাতা জাঁ লুক গোদার তাঁর চলচ্চিত্র ভাবনায় প্রথম বাঁকবদল খুঁজে পান এই আন্দোলনের হাত ধরেই। গোদারের এই বাঁকবদলের সঙ্গে জুড়ে আছে ‘ঝিগা ভেরতভ গ্রুপ’-এর নাম।

১৯৬০ সালে ‘ব্রেদলেস’ ছবির মাধ্যমে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন গোদার। কনটেম্পট (১৯৬১), লা পেতি সোলদাদ (১৯৬৩) বা ম্যাসকুলিন ফেমিনিন (১৯৬৬) – এর মতো একের পর এক চমকে দেওয়া কাজ বিশ্বের প্রথম সারির ফিল্মমেকারদের সঙ্গে এক আসনে বসিয়ে দিয়েছিল তাঁকে। ’৬৮-র আন্দোলন তাঁকে দিল নতুন দিশা। গদারের ফিল্মধারায় যাকে বলা যায় Revolutionary Period। মাওবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী অধ্যাপক ও চলচ্চিত্র- উৎসাহী জাঁ পিয়ের গোরিনের সঙ্গে মিলিতভাবে গোদার তৈরি করেন ছবি তৈরির একটি দল, যার নাম তাঁরা দেন ‘ঝিগা ভেরতভ গ্রুপ’। যাঁর নামে এই নামকরণ, সেই ঝিগা ভেরতভ ছিলেন উনিশ শতকের একজন প্রখ্যাত সোভিয়েত ডকুমেন্টরি নির্মাতা।

এই ব্যানার থেকে গোদার ঘোষণা করেন আর বুর্জোয়া ছবি নয়, এবার থেকে তিনি শুধু বিপ্লবী চলচ্চিত্র নির্মাণেই মন দেবেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ – এই পাঁচ বছর গোদার ও গোরিন আটটি ফিচার ফিল্ম তৈরি করেন। কোনওটিতেই নির্মাতা হিসেবে কারোর ব্যক্তিগত নাম তাঁরা ব্যবহার করেননি। ক্রেডিটে ব্যবহৃত হয়েছিল ঝিগা ভেরতভ গ্রুপের নাম। প্রত্যেকটিই সমসাময়িক রাজনীতি- ঘনিষ্ঠ এবং আপাদমস্তক র‍্যাডিকাল। লুই আলথুসের, মিশেল ফুকো, জাক লাকাঁর মতো ব্যক্তিত্বের সরাসরি ছাত্র ছিলেন গোরিন। ফিল্মে রাজনৈতিক বক্তব্য রাজনৈতিকভাবেই পরিবেশন করার লক্ষ্য ছিল তাঁর। গোদারের ভাবনাচিন্তা ও শৈলির সঙ্গে তা যুক্ত হয়ে র‍্যাডিকাল চলচ্চিত্রের এক অসম্ভব সাহসী ভাষা নির্মিত হয়। ঝিগা ভেরতভে গোদার কিন্তু নিজেকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন। সর্বকালের সেরাদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার মুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন করে তৈরি করে নেবার সাহস অনেকেই রাখেন না। গোদার সেই সাহস দেখিয়েছিলেন। এই দু’জনের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ছিলেন চার্লস স্টুয়ার্ট, জাঁ হেনরি রজার, কেনিথ ট্রড, জেরার্ড মারটিন, আরমান্দ মার্কো প্রমুখ আরও অনেকে। ঝিগা ভেরতভ গ্রুপের নির্মিত ছবিগুলি এক নজরে দেখে নেওয়া যাক -

১) উন ফিল্ম কম্মে লে অত্রে (আ ফিল্ম লাইক দি আদারস) / মুক্তি : ১৯৬৮
২) ব্রিটিশ সাউন্ডস (সি ইউ অ্যাট মাও)/ মুক্তি : ১৯৬৯
৩) প্রাভদা / মুক্তি : ১৯৬৯
৪) লা ভে এস্ত (উইন্ড ফ্রম দি ইস্ট) / মুক্তি : ১৯৭০
৫) জুকা লা ভিক্তরি (আনটিল ভিক্টরি / প্যালেস্তাইন উইল উইন) / মুক্তি : ১৯৭০
৬) লতে এন ইতালিয়া (স্ট্রাগলস ইন ইতালি)/ মুক্তি : ১৯৭১
৭) ভ্লাদিমির এত রোসা (ভ্লাদিমির অ্যান্ড রোসা) / মুক্তি : ১৯৭১
৮)তোউ ভা বিয়েন (এভরিথিং ইজ ফাইন) / মুক্তি : ১৯৭২
৯) লেটার টু জেন / মুক্তি : ১৯৭৩

ব্রেখট যেমন মঞ্চের ক্ষেত্রে চেয়েছিলেন, গোদার আর গোরিন তেমনই ফিল্মের ক্ষেত্রে চেয়েছিলেন শ্রমিক শ্রেণি বা নিপীড়িতের পক্ষ নিয়ে এক পৃথক চলচ্চিত্রভাষা তৈরি করতে। ফলে তাঁদের ছবিগুলিতে কোনওরকম বিনোদনের উপাদান খুব সচেতনভাবেই অনুপস্থিত ছিল। অবশ্য ছবিগুলির ভাষা ও ডিটেলিং-এর মর্মমূলে পৌঁছানো দুরূহ, এমন অভিযোগ বারবার উঠেছে। তবে বিষয়ের প্রতি তাঁদের সততা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি কোনওকালেই।

ঝিগা ভেরতভের যাত্রা শেষ হয়ে যাবার পরেও গোদার এই ভাবধারা থেকে মুক্তি নেননি। বৃহত্তর সম্ভাবনার চালচিত্রে এই দলগত উদ্যোগের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখনও যথাযথ বিচারের অপেক্ষায় বসে আছে। তবে সে প্রসঙ্গ যদি বাদও দেওয়া যায়, শুধুমাত্র জাঁ লুক গোদারের ‘হয়ে ওঠা’র পিছনে ঝিগা ভেরতভ গ্রুপের অবদানটুকুর কারণেই এই স্বল্পায়ু ও সাহসী প্রয়াস ফিল্ম- উৎসাহীদের স্মৃতিতে থেকে যাবার দাবি রাখে।



[কভার ছবিতে ঝিগা ভেরতভ দলের দুই প্রধান সদস্য, জাঁ লুক গোদার (স্ক্রিনের বাঁ দিকে) এবং জাঁ পিয়ের গোরিন।]

#ফিচার

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

58

Unique Visitors

216125