যুগান্ত
১ প্রিয়তম শিষ্যের এই অকারণ ভাবাবেগ ও অপরিণত মনোবৃত্তির পরিচয় পেয়ে অতিশয় অপ্রসন্ন হলেন বর্ষীয়ান মহাস্থপতি অনঙ্গসেন। তাঁর সুগৌর মুখমন্ডলের রক্তিমাভায় ও ভ্রূকুঞ্চনে সেই অসন্তোষের ভাব সুস্পষ্ট হল। অথচ এই শিষ্যটির ওপরে কি পরিমাণ মানসিক নির্ভরতাই না গড়ে উঠেছিল তাঁর গত কয়েক বৎসরে। ভেবেছিলেন অদূর ভবিষ্যতে অমৃতনগরীর মহাস্থপতির মহান দায়িত্ব এর স্কন্ধেই অর্পণ করে নিশ্চিন্তে এই দায়িত্বপূর্ণ রাজপদ থেকে স্বেচ্ছাবসর নেবেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ রাজস্থপতির কী এই প্রকার চিত্ত-চাঞ্চল্য শোভা পায়?
তরুণ স্থপতি শুভ্রকেতন তখনো তাঁর সম্মুখে অধোবদনে দন্ডায়মান। পুনর্বার সেদিকে অপ্রসন্ন দৃষ্টিনিক্ষেপ করে অনঙ্গসেন বললেন, - “তাহলে তোমার মতে এই বৃক্ষচ্ছেদন করে আমরা অন্যায় করতে চলেছি? আচ্ছা, তুমিই না হয় আমাকে বুঝিয়ে বল এই বৃক্ষ উৎপাটন না করে কিভাবে মহাকালের মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বারটি নির্মাণ করা সম্ভবপর হবে? মহারাজের একান্ত ইচ্ছে মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বারটি যেন নদীর এই কুঞ্জঘাট থেকেই সোজা উঠে আসে, এ কথা তো তোমার অজানা নয়?”
শুভ্রকেতন বিনীত ভাবে উত্তর দেয়, - “অন্য কোন সাধারণ বৃক্ষ হলে আমার আপত্তির কোন কারণ থাকত না আচার্য। কিন্তু এ যে এক মহাপ্রাচীন বৃক্ষ। এর বয়স শতাধিক। রাজ্যের অতিপ্রাচীন মানুষেরাও বলেন যে তাঁরা তাঁদের জন্মাবধি বৃক্ষটিকে এইরকম পরিণত অবস্থাতেই দেখছেন। তাছাড়া তাকিয়ে দেখুন আচার্য, সুবিশাল এই বৃক্ষে কয়েকশো নিশাচর জতুকার বাস। বৃক্ষচ্ছেদন হলে এরা নিরাশ্রয় হবে। হয়ত এ আমার ধৃষ্টতা বা প্রগল্ভতা বলে মনে হবে আপনার কাছে, কিন্তু -”। একটু ইতস্তত করে শুভ্রকেতন বলে চলল, -“কিন্তু কাল রাত্রে আমি এক অদ্ভুত দুঃস্বপ্ন দেখেছি। কিসের এক অশুভ ইঙ্গিত যেন। এই বৃক্ষচ্ছেদনের পর নিরাশ্রয় হয়ে সেই জতুকারা সারা অমৃতনগরীর আকাশ জুড়ে –”
- “থাক, থাক।” শুভ্রকেতনকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন অনঙ্গসেন। “আর শুনতে চাইনা। আমি অত্যন্ত নিরাশ হচ্ছি এই কথা জেনে যে একজন সম্ভাবনাময় স্থপতি এক মহান, যুগান্তকারী নির্মীয়মান স্থাপত্যের সামনে দাঁড়িয়ে সেই স্থাপত্যের সম্পূর্ণ রূপকে স্বপ্নে প্রত্যক্ষ করে না, পরিবর্তে এক সামান্য বৃক্ষ আর তার শাখায় বসবাসকারী কয়েকটি সামান্য পক্ষী, না পক্ষীও নয়, পক্ষীতর নিশাচর স্তন্যপায়ী প্রাণীকে প্রত্যক্ষ করে। অথচ তোমার ওপর আমার কত আশা ছিল, শুভ্রকেতন।”
শুভ্রকেতন নিজের বক্তব্যের সমর্থনে আরো যোগ করে, - “আরেকটা বিষয়েও আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আচার্য। এই বৃক্ষটিকে স্থানীয় অন্ত্যজরা দেবতা জ্ঞানে পুজো করে। ওই দেখুন, বৃক্ষদেবতার পদতলে তৈল-সিন্দুর মন্ডিত শিলাখন্ডসমূহ। এগুলি ওই গ্রামবাসীদের পুজোর নিদর্শন। শুনেছি এই নিয়ে অন্ত্যজ পল্লীতে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।”
- “হুম্, সে তথ্য সম্বন্ধে আমিও অবগত আছি। কিন্তু সেসব সামলানোর দায়িত্ব তো নগরকোটালের। প্রজাদের অসন্তোষ নিয়ে চিন্তাভাবনার দায়িত্ব তো স্থপতি-বাস্তুকারদের নয়। আমাদের কাজ হল নির্মাণ। একের পর এক সুমহান, সুবৃহৎ অট্টালিকা, মন্দির, সৌধ, স্তূপ, রাজপথ, অর্ণবপোত নির্মাণ করে যাওয়া। সভ্যতার বিজয়রথকে নির্বিঘ্নে এগিয়ে নিয়ে চলা” একটু থেমে আবার যোগ করলেন মহাস্থপতি, “আর হ্যাঁ, তার জন্য বৃক্ষ উৎপাটন, বৃক্ষচ্ছেদন আবশ্যিক। নচেৎ প্রাচীন পূর্বপুরুষদের মত আমাদের পুনরায় অরণ্যে, গুহাকন্দরে প্রত্যাবর্তন করতে হয়।”
মহাস্থপতি অপ্রসন্ন হচ্ছেন বুঝেও শুভ্রকেতন প্রত্যুত্তর করে চলে, - “কিন্তু, ভেবে দেখুন আচার্য, এই বৃক্ষটি তো অন্ত্যজদের কাছে দেবতা স্বরূপ। এক দেবতার জন্য দেবালয় বানাতে গিয়ে অন্য দেবতার আলয় ধ্বংস করা কি আমাদের উচিত হবে, আচার্য?”
“থামো, থামো।” এবার রীতিমত ক্রুদ্ধস্বরে শুভ্রকেতনকে থামিয়ে দিলেন মহাস্থপতি অনঙ্গসেন। “প্রগল্ভতা আর দুঃসাহসের একটা সীমা থাকে। আমার সামনে যা বললে বললে, আর কারো সামনে একথা বোলো না। মহারাজের কানে গেলে স্বয়ং মহাকালও তোমাকে বাঁচাতে পারবেন না।”
২
মাসাধিক কাল পরের কথা। মহাকালের মন্দিরের ভূমিপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে ইতিমধ্যে। এখন পুরোদমে চলছে মন্দির নির্মাণের কাজ। ভূমি খনন করে দেড় মানুষ সমান গভীর গহ্বর বানিয়ে তার ভিতর সুপ্রশস্ত ও শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। এখন স্তম্ভগুলি গাঁথা হচ্ছে একে একে। শত শত শকট বোঝাই করে উৎকৃষ্ট রক্তিম ও শ্বেত প্রস্তর আসছে রাজ্যের উত্তর ভাগের পার্বত্য অঞ্চল থেকে। দক্ষিণ প্রান্তের অরণ্য থেকে আসছে উৎকৃষ্ট সেগুন ও চন্দন কাষ্ঠ। মহাস্থপতি অনঙ্গসেন তাঁর সহকারী অন্যান্য তরুণ স্থপতি ও বাস্তুকারদের সঙ্গে নিয়ে ব্যস্ত ভাবে সব তদারকি করছেন। নির্মাণকার্য ঠিকমত চলছে, কিন্তু তবু যেন অনঙ্গসেন সন্তুষ্ট নন। আরো দ্রুত গতিতে কাজ করতে হবে। সামনের মাঘী পূর্ণিমার মধ্যে মন্দিরের নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হওয়া চাই। রাজ জ্যোতিষীর গণনা অনুযায়ী, মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য সেই তিথিটিই সর্বোত্তম। তাছাড়া আরো একটি কারণে দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। মহারাজ বিজয়বর্মার অভিষেকের পঞ্চম বর্ষপূর্তীও সেইদিন। কিন্তু মাঘী পূর্ণিমার তো মাত্র নয় মাস আর বাকি। এর মধ্যে কি করে সম্পূর্ণ হবে এই বিপুল কর্মকান্ড?
একটাই উপায়। আরো অধিক সংখ্যায় শ্রমিক চাই। তাহলেই দ্রুত সমাপ্ত করা যেতে পারে এই সৌধ। কিন্তু আরো শ্রমিক কোথায় পাওয়া যাবে? দেশের যত যুদ্ধবন্দী, ক্রীতদাস এবং অন্ত্যজ পল্লীর বিশাল সংখ্যক মানুষকে তো ইতিমধ্যেই কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু মাঘী পূর্ণিমার মধ্যে মন্দিরের কাজ শেষ করতে হলে এর দ্বিগুণ শ্রমিক চাই। উপায় এক আছে। জানালেন মহামন্ত্রী। যদিও মহারাজের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি জড়িত এর সঙ্গে।
অমৃতনগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে অরূপনগর। বছর দশেক আগে এই অরূপনগর এক ভয়াবহ মন্বন্তরের কবলে পড়ে। দুই বৎসর ব্যাপী চলে তার প্রভাব। সেই সময় অনাহার সহ্য করতে না পেরে অরূপনগরের এক বিশাল সংখ্যক মানুষ অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রতিবেশী রাজ্য অমৃতনগরীতে চলে আসে। তৎকালীন মহারাজা অজয়বর্মা এই ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিলেন। রাজার তৃতীয় পত্নী ছিলেন অরূপনগরের কন্যা। অরূপনগরের সঙ্গে বন্ধুত্বের, আত্মীয়তার সম্বন্ধ ছিল এই নগরীর। মহারাজ অজয়বর্মা অমৃতনগরীর দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন অরূপনগরের মম্বন্তর-পীড়িত মানুষের জন্য। দলে দলে মানুষ সেদিন আশ্রয় পেয়েছিল অমৃতনগরীতে। দু’বছর পরে অরূপনগরে আবার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত শুরু হলে তাদের অনেকে আবার অরূপনগরে ফিরে যায়, অনেকে আর ফেরে না। থেকে যায় এই ভূমিতেই। বিবাহাদি করে মিশে যায় এদেশের জনারণ্যে।
মহারাজ অজয়বর্মার মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বিজয়বর্মা রাজা হলে অরূপনগরের সঙ্গে অমৃতনগরীর সম্পর্কে চিড় ধরে। বিজয়বর্মা হলেন মহারাজের প্রথমা মহিষীর পুত্র। অপর দিকে তৃতীয় মহিষীর পুত্র চন্দ্রবর্মাও ছিল সিংহাসনের অভিলাষী। বিজয়বর্মার সঙ্গে এই বৈমাত্রেয় ভ্রাতাটির সম্পর্ক কোনোদিনই ভাল নয়। এমনকি চন্দ্রবর্মা রাজার বিরুদ্ধে একবার বিদ্রোহ করারও চেষ্টা করেন, আর এই কাজে তাঁকে সাহায্য করেন দক্ষিণ-পশ্চিম পল্লীর বেশ কিছু মানুষ, যারা সকলেই নাকি অরূপনগর থেকে এ রাজ্যে এসে স্থিত হওয়া প্রজা। তাদের সাহায্যেই চন্দ্রবর্মা ছদ্মবেশে অমৃতনগরী ত্যাগ করে পালাতে সক্ষম হয়েছেন, তাই ষড়যন্ত্রকারীকে ধরাও যায়নি। শোনা যায় তিনি অরূপনগরেই আশ্রয় পেয়েছেন। এই ঘটনার পর থেকেই সেই দেশ থেকে আসা মানুষদের প্রতি রাজার বিদ্বেষ। রাজা তাঁর বিশ্বাসভাজন কিছু অনুচরের সহায়তায় চেষ্টা করছেন এই বিভেদ-বিদ্বেষের বিষ রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে।
- “কিন্তু এসব তো মহারাজের নিজস্ব স্বরাষ্ট্র নীতি। কোনোটা আবার পররাষ্ট্র নীতি। এর সঙ্গে মহাকালের মন্দির নির্মাণের সম্পর্ক কি?” মহামন্ত্রীর এই কূটনৈতিক ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে খানিক অধৈর্য হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেন অনঙ্গসেন। মহামন্ত্রী জানান, - “অতীতে যারা অরূপনগর থেকে এদেশে এসেছে তাদের চিহ্নিতকরণের কাজ চলছে দেশ জুড়ে। যারাই নিজেদের এই অমৃতনগরীর আদি অধিবাসী রূপে প্রমাণ করতে পারছে না, তাদের ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে, তাদের নাগরিক সকল অধিকার কেড়ে নিয়ে নিক্ষেপ করা হচ্ছে কারাগারে। এদের দিয়ে জবরদস্তি করানো হচ্ছে নানা পরিশ্রমের কাজ, যেমন ধরুন খনিতে পাথর ভাঙার কাজ। একপ্রকার ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়েছে এদের। যাহোক, এখন আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তাহলে এই অস্থায়ী শ্রমিকদের মহাকালের মন্দির নির্মাণের কাজে লাগাতে পারেন।”
কয়েকদিনের মধ্যেই নির্মিয়মান মন্দিরের চত্বরে সারি সারি অস্থায়ী তাঁবু পড়ল। শ্রমিকের সংখ্যা দ্বিগুণ হল। দ্রুততর গতিতে এগিয়ে চলল মন্দির নির্মাণের কাজ।
৩
অমৃতনগরীর আকাশে প্রথম যেদিন সেই জতুকা পক্ষী অর্থাৎ বাদুড়ের অশুভ ছায়া দেখা গেল সেদিনও পূর্ণিমাই ছিল। বৈশাখী পূর্ণিমা। তার ঠিক সাত দিন আগেই মন্দির সংলগ্ন সেই প্রাচীন বৃক্ষটি কর্তিত হয়েছে। সুবিশাল ও সুপ্রাচীন সেই মহাবৃক্ষ যেদিন উৎপাটিত হল সেদিন আশ্রয়চ্যুত শত শত বাদুড় ও অন্যান্য পাখীদের আর্ত কান্নায় অমৃতনগরীর বাতাস ভেসে গেল। তাদের ডানায় ঢেকে গেল সূর্য। নামল আঁধার। ক’দিন যাবৎ সেই আশ্রয়হীণ পক্ষীরা এভাবেই ঘুরে বেড়াল নগরীর আকাশে। গৃহস্থের আঙিনায়, ধানের গোলায়, শস্যক্ষেতে। তারপর ধীরে ধীরে তারা নদী পার হয়ে উড়াল দিল রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্ত ঘেঁষা অরণ্যের অভিমুখে।
এর সাতদিন পর থেকে রাজ্যে শুরু হল অজানা এক জ্বরের প্রকোপ। প্রথমেই এর কবলে পড়ল অস্থায়ী শিবিরের শ্রমিকরা। প্রবল সংক্রামক এই জ্বরের সহসঙ্গী কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। দিন কয়েকের মধ্যেই উজাড় হয়ে গেল শ্রমিক শিবির। দেখতে দেখতে রাজ্যের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ল মারীর প্রকোপ। গ্রামের পর গ্রাম শশ্মানে পরিণত হল। নগরের নানা প্রান্তেও মৃত্যুমিছিল অব্যাহত। আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেল রাজ্যবাসী। নানা রকম সম্ভব-অসম্ভব রটনা ভেসে বেড়তে লাগল রাজ্য জুড়ে। শোনা গেল শ্রমিক শিবিরে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না, পরিবেশও ছিল মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত। ক্ষুধার তাড়নায় শিবিরের শ্রমিকেরা নাকি মহাবৃক্ষচ্যুত বাদুড়দের হত্যা করে তাদের মাংস খেয়েছিল বেশ কয়েকবার। সেই থেকেই নাকি এই রোগের সূত্রপাত। সকলেই বলছে এই রোগের উৎস বাদুড়ের দেহ। কারণ, মৃত্যুর পূর্বে রোগী নাকি এক বাদুড়ের ছায়া দেখতে পাচ্ছে ঘরের মধ্যে। এই ছায়া দেখার কয়েক প্রহরের মধ্যেই মৃত্যু হচ্ছে তার। কোনো রকম ওষধিতেই কোনো কাজ হচ্ছে না।
রাজার লোক নগরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ঢেঁড়া পিটিয়ে গেল, যারা এই গুজব ছড়াবে তাদের শূলে চড়ানো হবে। মন্দির নির্মাণের কাজ স্থগিত রাখতে হয়েছে আপাতত। শুভ্রকেতন ও অন্যান্য স্থপতি বাস্তুকাররা নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেল। রাজার আদেশে অতীব প্রয়োজন ছাড়া রাজ্যবাসীর নিজ গৃহ ত্যাগ করে অন্যত্র গমন নিষিদ্ধ। সংক্রমণ রোধের জন্য রাজকবিরাজের পরামর্শে এই নির্দেশিকা জারি হয়েছে রাজ্য জুড়ে। রাস্তায় কোনো নাগরিককে ইতস্তত বিচরণ করতে দেখলেই তাকে নগরকোটালের কাছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে রাজ পেয়াদারা। যদিও কয়েকদিনের মধ্যেই রাজ পেয়াদাদের অর্ধেকের সংক্রমণে মৃত্যু হল।
এরপর একদিন মহাস্থপতিও দেখলেন বাদুড়ের ছায়া। পরদিন থেকে তাঁর জ্বর আর শুষ্ক কাশি। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। তিনদিন জ্বরে ভুগে মারা গেলেন তিনি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি নাকি বারংবার শুভ্রকেতনের নামোচ্চারণ করেছিলেন। কে জানে কি কারণে শুভ্রকেতনের কাছে অনুতাপ জ্ঞাপন করে নিজের ভুল স্বীকার করছিলেন। তাঁর নিকটাত্মীয়রা এর কারণ অনুমান করতে পারেনি। জ্বরগ্রস্ত মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধের বিশ্রম্ভালাপ বলে উপেক্ষা করেছে।
রাজার আদেশে রাজপুরোহিত এরপর এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করলেন। নানা প্রকার শান্তি স্বস্ত্যয়ন করা হল মারী মুক্তির আশায়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। যজ্ঞের পরদিনই রাজপ্রাসাদে প্রথম দেখা গেল সেই বাদুড়ের প্রতিচ্ছায়া। রাজমাতা জ্বরে পড়লেন সেদিন রাত্রেই। একে একে রাজপরিবারের আরো অনেকে। সাতদিনের মধ্যেই রাজমাতা সহ রাজ পরিবারের বেশ কয়েকজন প্রবীণ সদস্যের মৃত্যু হল।
৪
এই রোগে অধিক মৃত্যু হচ্ছে বয়স্কদের। আর দুর্বলদের। প্রাপ্তবয়স্কদের অসুখ হলেও কয়েক দিন রোগভোগের পরেই তারা সেরে উঠছে। কিছু অল্পবয়স্ক মানুষও মারা যাচ্ছে, কিন্তু সংখ্যায় কম। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দেখা যাচ্ছে শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না। এই কঠিন দুঃসময়েও এটাই রাজ্যবাসীর কাছে সবচেয়ে ভরসার কথা।
কিন্তু এই ভরসা দীর্ঘস্থায়ী হল না। মাস কয়েক বাদে যখন মনে হল রোগের প্রকোপ কমে যেতে শুরু করেছে, মানুষ যখন প্রিয়জন, বিশেষ করে পিতাপাতা, বর্ষীয়ান স্বজনদের শোক ভুলে চোখের জল মুছে নিজকাজে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে, আবার যখন সব একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে চলেছে, তখনই আবার নতুন করে রোগের ঢেউ এল রাজ্যে। এবার রোগে পড়ল শিশুরা। প্রথম ঢেউ এ যারা ক্ষতি গ্রস্ত হয়নি, যারা সুস্থ ছিল, মারণ জীবাণু এবার তাদের অঙ্গে আছড়ে পড়ল। সারা রাজ্য জুড়ে এবার শুরু হল শিশু মৃত্যু। প্রাণ হারাল এমনকি কিশোর রাজকুমারও।
তবে পরীক্ষা তখনো সমাপ্ত হয়নি অমৃতনগরীর বাসীর। আরো কয়েক মাস বাদে একদিন সভয়ে, সবিস্ময়ে অমৃতনগরীবাসী আবিষ্কার করল যে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যারা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে তারা প্রজনন ক্ষমতা হারিয়েছে। গত ছ’সাত মাসে একটিও শিশুর জন্ম হয়নি সারা রাজ্যে। সারা রাজ্য বন্ধ্যা। ভবিষ্যৎ নিহত হয়েছে মাতৃগর্ভে প্রবেশের আগেই।
একদিন রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তে আলোকমালা দেখা গেল। এই ঘোর দুঃসময়ে কে জ্বালাবে দীপাবলীর আলো? না দীপাবলী নয়, কিছু পরেই বোঝা গেল এ হল দাবানল। অরণ্যে আগুন লেগেছে। দীর্ঘ ন’মাস ব্যাপী মৃত্যুমিছিলে শবদাহে ব্যাবহারের পর যেটুকু কাঠ অরণ্যে ছিল তাও অকস্মাৎ দাবানলে ভস্মীভূত হল। অগত্যা নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতে লাগল মৃতদেহ। নদীর জলে ভেসে চলল লাশের সারি। অমৃতনগরীর যে কতিপয় মানুষ এখনো বেঁচে আছে তারা সান্তান-সন্ততির লাশ জলে ভাসিয়ে শূন্য চোখে বসে থাকে নদীর পাড়ে। অশ্রু তাদের শুকিয়ে গেছে আগেই। দৃষ্টিতে তাদের অন্তহীণ ধূ ধূ শূন্যতা। শরীর তাদের বন্ধ্যা। অতীতকে কাল পুড়িয়ে এসেছিল তারা নিজের হাতে, আর আজ ভবিষ্যতকে তারা ভাসিয়ে দেয় নিরুদ্দেশের স্রোতে। অমৃতনগরী আজ মৃতনগরীতে পরিণত। প্রাণের স্পন্দন স্তিমিতপ্রায়।
কেউ লক্ষ্য করেনি মহাকালের অসমাপ্ত মন্দিরের দেওয়ালে কবে যেন গজিয়েছে এক ছোট্ট চারাগাছ। বটবৃক্ষের একটি ক্ষুদ্র চারা। অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে কি করে যেন বাড়তে থাকে বৃক্ষচারাটি। কবে চারাটির জন্ম হল আর কি করেই বা এত দ্রুত বৃদ্ধি পেল সেই প্রশ্ন কেউ করে না, কারণ প্রশ্ন করার ক্ষমতা হারিয়েছে অমৃতনগরী বাসী। একদিন বৃক্ষচারাটি সশব্দে ফাটিয়ে ফেলে মন্দিরের একদিকের দেওয়াল। আর সেই দিনই গোধূলি লগ্নে দেখা যায় শত শত বাদুড়কে ডানা মেলে অমৃতনগরীর দিকে উড়ে আসতে। কে জানে কোথায় তারা লুকিয়ে ছিল এতদিন। আর কোথা থেকেই বা তারা আজ আবির্ভূত হল অকস্মাৎ। তাদের কালো ডানায় আবার অমৃতনগরীর আকাশ ঢেকে যায়। আঁধার নামে অসময়ে। শ’য়ে শ’য়ে সেই নিশাচর বাদুড়েরা এসে দখল নেয় মহাকালের মন্দির গৃহের।
আরও পড়ুন:চন্দ্রগুপ্তের আপন দেশে/অরিন্দম গোস্বামী
অলংকরণ: অভীক