বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

তরুণী উদিতি কি পাল্টে দেবে ভারতের জিন গবেষণার মানচিত্র?

সায়নদীপ গুপ্ত July 18, 2024 at 6:40 pm বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ল্যাপটপের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন রাজীব সরফ। উঁচু পদে কাজ করার এই এক সমস্যা, শনিবার সকালেও রেহাই পাওয়া যায় না। একের পর এক মিটিং আর ই-মেইলের সমুদ্র আছড়ে পড়ছে খোলা পর্দায়, কিন্তু রাজীবের মন আটকে আছে দূরে কোথাও। খুব দূরেও নয় অবশ্য, লিভিং রুম থেকে যার প্রাণোচ্ছল গলা ভেসে আসছে, তার মুখটাই ভাসছে মনের মধ্যে। কত আর বয়স হল মেয়েটার, এই তো নয় পেরোল সবে। আর পাঁচজন বাচ্চার মতো সেও মেতে আছে লেখাপড়া, খেলাধুলো আর নাচ নিয়ে। সত্যি বলতে, সবকিছুতে যে মেয়ের মাত্রাছাড়া চঞ্চলতা, নাচের ব্যাপারে তার নিষ্ঠা দেখলে রাজীব নিজেই অবাক হয়ে যান। কিন্তু আপাতত তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে সন্তানের স্বাস্থ্য। বিগত কয়েকমাসে উদিতি বারদুয়েক অজ্ঞান হয়ে গেছে। না, ঠিক অজ্ঞান নয়, বরং ব্ল্যাক আউট বলা চলে। ওই কয়েক সেকেন্ডের ব্ল্যাক আউট একজন বাবার মনে কতটা ভয় জাগাতে পারে, রাজীব তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। চেনাজানা একজন ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু বিশেষজ্ঞ কাউকে দেখাবেন কি না, সেইটা ভেবেই মনটা বড্ড অস্থির।

চটকাটা ভাঙল একটা আওয়াজে। দ্রুত পায়ে লিভিংরুমে ঢুকলেন রাজীব, স্ত্রীয়ের চাপা আর্তনাদ চিনতে তিনি ভুল করেননি। কিচেনের সামনে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সোনম, আর উলটোদিকে সোফার কাছে উদিতি। তার চোখমুখ কেমন যেন ফ্যাকাশে, হাতদুটো যেন শূন্যে কিছু আঁকড়ে আছে আর পায়ের কাছে পড়ে আছে রাজীবের সাধের ডিএসএলআর ক্যামেরাটা। সোনম কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “ওর... ওর হাত থেকে ক্যামেরাটা এমনিই পড়ে গেল, কিন্তু... ও আর বুঝতে পারছে না সেটা!” রাজীব হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। কোথাও একটা গড়বড় হয়েছে।

গড়বড় যে ভালোমতোই হয়েছে তা বোঝা গেল একাধিক ডাক্তার আর একরাশ পরীক্ষানিরীক্ষার পরে। উদিতির শরীরে বাসা বেঁধেছে মৃগী রোগের বীজ। যা শুরু হয়েছিল ইতিউতি উঁকি দিয়ে, অচিরেই তা পরিণত হল ঘন ঘন হামলায়। ক্লাসের মাঝে, নাচের স্কুলে, সর্বত্র আচমকা হানা দিতে থাকল প্রবল খিঁচুনি। মৃগীর প্রকোপ সামলেও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টাকেই নিয়তি মেনে নিয়েছিলেন সবাই, কাজেই একাধিক ডাক্তার আর আত্মীয়-বন্ধুদের পরামর্শ মেনে অন্ধের মতো ছুটে বেড়ানো ছাড়া সে সময়ে আর কিছু করার ছিল না। আয়ুর্বেদিক গুরু থেকে আধুনিক স্নায়ু-বিশেষজ্ঞ, স্পেশ্যাল স্কুল থেকে হেলথ রিট্রিট– পরবর্তী ছ-সাত বছর কোনও দরজায় কড়া নাড়তে বাকি রাখেননি রাজীব-সোনম। একইসঙ্গে রাজীবের মনে হয়েছিল অন্তত একবার যদি সমস্যার মূলে গিয়ে আঘাত হানা যায়! মৃগী তো লক্ষণ মাত্র, অসুখের মূল বীজ নিশ্চয়ই অন্য কোথাও। অর্থের অভাব তাঁদের নেই, বরং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মানসিকতাও উপরি আছে। অন্যান্য অভিভাবকদের যে কথা মাথায় আসবে না, রাজীব সেই কাজটাই করলেন। ২০১৭ সাল নাগাদ উদিতির জিনোম সিকুয়েন্স করালেন। মানবদেহের প্রতিটি কোশে আছে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম, প্রত্যেকের মধ্যে আছে দ্বিতন্ত্রী ডিএনএ – যাতে লেখা আছে সারা শরীরের ঠিকুজি-কুষ্ঠি। এদের সবাইকে একত্রে বলে জিনোম। বিশ শতকের মাঝামাঝি শুরু হয়েছিল এর সম্পূর্ণ মানচিত্র তৈরির কাজ, আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে তা যে কেউ করাতে পারেন। তবে হ্যাঁ, পকেটের কিঞ্চিৎ জোর থাকলে, তবেই। যদি কোনও রোগের ঠিকানা জন্মগতভাবেই লেখা থাকে ডিএনএ-তে, তাহলে তার সিকুয়েন্স বা ক্রমসংকেতেও সেই ছাপ স্পষ্ট দেখা যাবে। A, T, G, C– ডিএনএ আসলে এই চারটে অক্ষরের বিভিন্ন রকমের সজ্জা দিয়ে তৈরি। মোক্ষম কোনও জায়গায় যদি নির্দিষ্ট অক্ষরের বদলে ভুলক্রমে চলে আসে আরেক অক্ষর, সজ্জারীতি যায় পালটে, আর কপাল মন্দ হলে তা থেকেই জন্ম নেয় রোগ। উদিতির জিনোম সিকুয়েন্সে ধরা পড়ল এমনই এক গণ্ডগোল– ফ্যামিলিয়াল এনসেফালোপ্যাথি। মস্তিষ্কের নিউরনের মধ্যে কাজ করে নিউরোসার্পিন বলে এক প্রোটিন। উদিতির শরীরে সেই নিউরোসার্পিনের জেনেটিক সংকেতে এক জায়গায় G-এর বদলে রয়েছে A– তার ফলে নিউরোসার্পিন তৈরি হয়েও দলা পাকিয়ে পড়ে থাকে। একের পর এক প্রোটিন দলা জমে জমে নিউরন তার কার্যক্ষমতা হারায়। খুব সংক্ষেপে বললে, উদিতির মস্তিষ্ক প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে।

পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া এক ব্যাপার, কিন্তু সমুদ্রে এক-বুক গভীরতায় দাঁড়িয়ে পায়ের তলার বালি ভেঙে যাওয়া আরও ভয়াবহ। রাজীব আর সোনমের অবস্থা তখন সেইরকম। ফ্যামিলিয়াল এনসেফালোপ্যাথির নাম তাঁদের কাছে তো বটেই, উদিতির চিকিৎসকদের কাছেও অজানা। জিনোম সিকুয়েন্স যদি বা সমাজের সচ্ছল শ্রেণির সাধ্যে কুলায়, আপামর ভারতবাসীর কাছে সে সম্বন্ধে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। রোগের জিনগত কারণ খুঁজে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা চালানো এতটাই ব্যয়সাধ্য এবং অনিশ্চিত, ডাক্তাররাও সচরাচর রোগীকে এমন পরামর্শ দেন না। উপযুক্ত তথ্যের অভাবে অনেকেই ‘ডিমেনশিয়া রোগী’ হয়ে থেকে যান, কারণ আরও কিছু স্নায়ুরোগের মতো এই ক্ষেত্রেও অন্যতম প্রকট লক্ষণ হল ডিমেনশিয়া। অসহায় বাপমায়ের কাছে তখন একমাত্র খড়কুটো হল ইন্টারনেট-লব্ধ জ্ঞান, কিন্তু যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগই চিহ্নিত হয় না সেখানে আর কতটুকুই বা জানা যাবে! ওদিকে উদিতির স্বাস্থ্য ক্রমাগত ভেঙে পড়ছিল, মরিয়া রাজীব তাকে নিয়ে পাড়ি দিলেন সুদূর নিউ ইয়র্কে, উদিতিকে এক বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন স্কুলে ভরতি করাতে। সময়টা ২০১৮-এর মাঝামাঝি। সেখানেই উদিতির চিকিৎসক হিসেবে আলাপ হল মৃগী-বিশেষজ্ঞ ওরিন ডেভিনস্কি-র সঙ্গে। ওরিন তাঁদের প্রথমবার একটা ক্ষীণ আশার আলো দেখালেন। উদিতিকে সুস্থ করার অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে ক্রিস্পার জিন থেরাপি। ২০২০ সালে যখন নোবেল পুরস্কারের মঞ্চ আলো করে দাঁড়িয়েছিলেন ক্রিস্পার (CRISPR) পদ্ধতির আবিষ্কর্তা দুই বিজ্ঞানী, তখন অনেক সাধারণ মানুষ এই নামটার সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তারও বছর দুয়েক আগে উদিতির মা-বাবা জানতেন না, এ জিনিস খায় না মাথায় দেয়। ওরিন তাঁদের বুঝিয়ে বললেন, ব্যাকটেরিয়া জাতীয় এককোশী জীবের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাই ক্রিস্পার, এরই মাধ্যমে তারা ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকায়। বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতিকে গবেষণাগারে ফেলে কাটাছেঁড়া করে তৈরি করেছেন জিনগত কারিকুরি করার এক অনন্য উপায়। এই ব্যবস্থায় ডিএনএ-র যে কোনও অংশের সংকেত ইচ্ছেমতো বদলে দেওয়া যায়, ভুলকে ঠিক করা যায়, ঠিককে করা যায় আরও উন্নত। তবে তো উদিতির স্নায়ুকোশের সেই ত্রুটিপূর্ণ A-কে বদলে G বসিয়ে দেওয়া কোনও ব্যাপারই নয়! না, অতটাও সহজ নয় কাজটা। পদ্ধতি আছে ঠিকই, কিন্তু মানবশরীরে তার প্রয়োগের পথে আছে বিস্তর বাধা। একটা টিউবের মধ্যে যে কাজ করা সোজা, সেটাই একটা কোশে করা কঠিন, আবার সেটাই স্নায়ুতন্ত্রের লক্ষ কোশের মধ্যে নিপুণভাবে করা আরও কঠিন। তার উপরে করতে পারলেই তো হল না, ধাপে ধাপে বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে কার্যকারিতা পরীক্ষিত না হলে সরাসরি মানুষের উপরে প্রয়োগের ছাড়পত্র দেবে না সরকার। কিন্তু রাজীব আর সোনমের কাছে এইটুকুই অনেক, কাজ শুরু তো হোক।


চিত্র : ক্রিস্পার যেভাবে ডিএনএ সংকেত বদলাতে পারে

শুরু হল সে মহাযজ্ঞ। ওরিন ডেভিনস্কির আহ্বানে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ল্যাঙ্গন হেলথ ইন্সটিটিউটের তাবড় স্নায়ুবিজ্ঞানী ও ক্রিস্পার-বিশেষজ্ঞরা মিলে দিনরাত এক করে কাজ করা শুরু করলেন। গবেষকদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী, জয়িতা বসু। এতটুকু ভুল হলেও যে উদিতিকে বাঁচানো যাবে না সেকথা মনে রেখে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা একেকটা পরীক্ষা অন্তত পাঁচবার করে তবে নিশ্চিত হতেন। এই কাজের জন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া অর্থসাহায্যের সঙ্গে আলাদা করে টাকা দিয়েছিলেন সরফ-দম্পতি। কিন্তু এইরকম পর্যায়ের গবেষণা করতে যে বিপুল সময় লাগে ততদিন আমেরিকায় বসে থাকা তাঁদের কাছে অসম্ভব হয়ে উঠছিল, তাই কাজ চালাতে বলে উদিতিকে নিয়ে তাঁরা ফিরে এলেন দিল্লিতে। সে বড়ো সুখের সময় নয়, শুরু হল কোভিড অতিমারি। রেহাই পেল না উদিতিও, কুড়ি দিন হাসপাতালে কাটিয়ে যখন সে বাড়ি এল তখন কোভিডের সঙ্গে তাকে অংশত ছেড়ে গেছে পারিপার্শ্বিক বোঝার ক্ষমতা। ডেভিনস্কি ও তাঁর দলবল অবশ্য চুপ করে বসে নেই। তাঁরা স্বাস্থ্য দপ্তরের কাছে তদ্বির করে উদিতির জন্য ক্রিস্পারের এক নতুন প্রকারভেদ কাজে লাগানোর ছাড়পত্র জোগাড় করেছেন– অ্যান্টিসেন্স থেরাপি। উদিতিকে নিয়ে আসা হল নিউ ইয়র্কে, পরপর দুবার, কিন্তু সে চিকিৎসায় বিশেষ কাজ হল না। রাজীব ততদিনে বুঝে গেছেন, বিজ্ঞানের গবেষণা এবং সরকারি সবুজ সংকেত দুইই সময়সাপেক্ষ। তিনি ও সোনম ঠিক করলেন, ডেভিনস্কি যেমন কাজ করছেন করুন, কিন্তু তাঁরা ভারতেও ক্রিস্পার থেরাপির জন্য টাকা ঢালবেন।  বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী, আর বিদ্যায় বাঙালি। সরফ-নিবাস থেকে ঘণ্টা দেড়েকের দূরত্বে সরকারি সিএসআইআর-এর প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট অফ জিনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি (IGIB)-তে সিকল-সেল অ্যানিমিয়ার ক্রিস্পার থেরাপির কাজে আলো ছড়াচ্ছেন গবেষক দেবজ্যোতি চক্রবর্তী। তাঁকেই বললে কেমন হয়? 

যেমন ভাবা তেমন কাজ। দেবজ্যোতি জানতেন কাজটা সহজ নয়, তাঁদের কাছে বছরভর এমন অনেক অনুরোধ আসে বিরল রোগে আক্রান্তদের থেকে, কিন্তু আটকে যায় একটাই জায়গায়– অর্থ। উদিতির রোগ শুধু বিরলই নয়, গোটা দেশে সে এই রোগে আক্রান্ত একমাত্র রোগী। একজনের মুখ চেয়ে পুরো গবেষণা চালানোর জন্য সরকারি, বেসরকারি কোনও সাহায্যই পাওয়া যাবে না। সরফ-দম্পতি সেখানেও তাঁদের শেষ কড়িটুকু ঢেলে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু অর্থের জোগান হলেও সময়ের জোগান কি আছে তাঁদের কাছে? স্নায়ুকোশে ক্রিস্পার থেরাপি নির্ভুলভাবে পৌঁছতে, প্রতিটি কোশে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে, চিকিৎসার কোনোরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্মূল করতে চাই বিস্তর গবেষণা। সোনম-রাজীব জানালেন, সে ঝুঁকি তাঁরা নিতে রাজি। যোগাযোগ করা হল আরেক বঙ্গসন্তান, বেঙ্গালুরুর নারায়ণ নেত্রালয়ে কর্মরত ডাক্তার অর্কশুভ্র ঘোষের সঙ্গে। কোশের মধ্যে ক্রিস্পারকে পাঠানোর জন্য চাই অ্যাডেনোভাইরাস বাহক, আর সেই বহন-পদ্ধতির একমাত্র সরকার-স্বীকৃত ঠিকানা এই চক্ষু চিকিৎসালয়। অর্কশুভ্র নিজেই কাজ করেন এই পদ্ধতি নিয়ে, তাঁর গবেষণাগারে তৈরি হবে কোশের ব্যূহে ঢোকার উপায় আর দেবজ্যোতি তৈরি করবেন ডিএনএ-র সংকেত বদলানোর হাতিয়ার। IGIB-এর অধিকর্তা সৌভিক মাইতি আশ্বাস দিলেন, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় রাসায়নিকের সরবরাহে এতটুকুও দেরি হবে না। সকলেই বুঝছিলেন, এ দৌড় রোগের সঙ্গে নয়, সময়ের সঙ্গে। উদিতির যা অবস্থা, গবেষণায় ফল মিললেও তা কতটা কাজে লাগবে, বলা মুশকিল। সোনম আর রাজীব সব শুনে একটাই কথা বলেছিলেন, কাজটা শেষ হলে কারও না কারও উদিতি নিশ্চয়ই সুস্থ হবে। 

এরপর আর বসে থাকা যায় না। দুই দলের গবেষকরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন উদিতিকে একটা অবলম্বন দেওয়ার জন্য। দেবজ্যোতি চক্রবর্তী তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে তৈরি করলেন ক্রিস্পারের নবতর ধরন, ‘বেস এডিটিং’-এর এমন পদ্ধতি, যা উদিতির নিউরনে নিউরোসার্পিন-উৎপাদক জিনের ত্রুটিকে সংশোধনে সক্ষম। অর্কশুভ্র ঘোষের সহকারীরা লেগেপড়ে থেকে বানিয়ে ফেললেন এমন জাতের অ্যাডেনোভাইরাস বাহক যা স্নায়ুকোশে ঢুকে যাবে সহজেই, আবার দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তাকে অনুপ্রবেশকারী বলে রুখেও দেবে না। কিন্তু বেস এডিটিং-এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন-আরএনএ মিশ্রণের যা দৈর্ঘ্য, বাস্তবে অ্যাডেনোভাইরাসের বহন ক্ষমতা তার থেকে কম। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করলেন এক নতুন উপায়– দুইখানা অ্যাডেনোভাইরাসের মধ্যে ক্রিস্পারের উপাদানগুলো ভাগ করে রেখে একইসঙ্গে নিউরনে পাঠানো। গবেষণাগারে পড়ে থাকা মানুষগুলো সবাই মিলে একটু একটু করে অনেকটা পথ চলে এলেন। জুন ২০২৩-এর এক সকালে ডক্টর ঘোষ আর ডক্টর চক্রবর্তী উদিতির বাড়িতে এলেন প্রাতরাশের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে, আর সেইসঙ্গে সরফ-দম্পতিকে জানালেন ভালো খবরটা। গবেষণার প্রাথমিক ধাপ শেষ, ইঁদুরে পরীক্ষা করার পালা শুরু। যদি দেখা যায় কাজ হচ্ছে, সোজা উদিতির মস্তিষ্কে এর প্রয়োগ করা হবে। আর মাত্র কয়েক মাসের ব্যাপার। রাজীব আর সোনম শুনলেন, তারপর সোনম উঠে গেলেন ভিতরের ঘরে। রাজীব একদৃষ্টে তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কয়েক মাস নয় ডাক্তারবাবু, কয়েক দিনে করার চেষ্টা করুন।” ডক্টর ঘোষের একটু অস্বস্তি হল, গবেষণার গতিপ্রকৃতি কি এতই সোজা, আর তাঁরা তো চেষ্টার সত্যিই কোনও ত্রুটি রাখছেন না! একটু পরে সোনম এলেন, হুইলচেয়ারে উদিতিকে নিয়ে। কুড়ি বছর বয়সি এক তরুণী, অন্ধত্ব আর বধিরতা গ্রাস করেছে তার বোধক্ষমতা, চলচ্ছক্তিহীন, জড়ের মতো মিশে আছে দুই চাকার মাঝে। রাজীব উদিতির হাতদুটো ধরে চেঁচিয়ে বললেন, “কারা এসেছেন জানিস? তোকে ভালো করে তোলার জন্য যাঁরা প্রাণপাত করে চলেছেন!”

প্রায় কাঁপতে কাঁপতে সেদিন ফিরে এসেছিলেন অর্কশুভ্র ঘোষ। এক সহকর্মীকে ফোন করে শুধু বলেছিলেন, “দরকার হলে ল্যাবে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হবে, কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই কাজ শেষ হওয়া চাই।”

এর ঠিক চারমাস পরে, শরতের এক সকালে, উদিতি শেষবারের মতো ঘুমোল। একটু শান্তির ঘুম অনেকদিন ধরে বাকি ছিল যে। 

ভারতের প্রায় দশ কোটি মানুষ কোনও না কোনও বিরল রোগে ভুগছেন। জনসংখ্যার বিচারে মাত্র সাত শতাংশ। ওই ‘মাত্র’ শব্দটার জন্যই তাঁদের চিকিৎসার খরচ অস্বাভাবিক রকমের বেশি, সরকারি সাহায্য হাস্যকর রকমের কম, আর প্রয়োজনীয় গবেষণার গতি অত্যন্ত স্তিমিত। সবাই সরফ নন, প্রিয়জনকে বাঁচাতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক গবেষণায় বিনিয়োগ করা এবং স্বজনবিয়োগের পরেও সেই অনুদান অব্যাহত রাখা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। উদিতির মৃত্যুর দিন দশেক পরে এক কনফারেন্সে দেবজ্যোতি চক্রবর্তী এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন; পর্দাজোড়া তরুণীর হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে সব অতিথিদের মনে ছিল একটাই প্রশ্ন– আর কোনও উদিতির জন্য আমরা দেরি করে ফেলছি না তো? যে দেশের শিক্ষামহল ভালো গবেষণা বলতে বোঝে নামকরা জার্নালে ছাপানো আর কনফারেন্সে হাততালি কুড়োনো, যে দেশের সরকারি নীতি উচ্চশিক্ষা বলতে বোঝে নতুন সেন্টার অফ এক্সেলেন্স বানানো আর গবেষণাখাতে বরাদ্দ কমানো, যে দেশের মানুষ গবেষকের তুলনায় গুরুদেবের উপর বেশি আস্থা রাখেন, সেই দেশের প্রায়োগিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের চর্চাকে একজন উদিতি নিঃসন্দেহে বেশ কিছুটা এগিয়ে দিয়ে গেল। এরপরের অগ্রগতির জন্য কি আরও একজনের মৃত্যুর দিন গুনব? 

...........

তথ্যসূত্র : Hope, despair and CRISPR — the race to save one woman’s life (2024), Nature, by Heidi Ledford.

#CRISPR #CAS9 #Gene Editing #Popular Science #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

34

Unique Visitors

217255