যে আর জি কর-কে চিনতাম, আর যাকে চিনি না
২০১১ সালে আর জি করে যাত্রা, ডাক্তারি পড়ুয়া হিসেবে। মফস্সলের ছেলে হয়ে প্রথমবার কলকাতার জৌলুস দেখে বিস্ময়ও জেগেছিল যেমন, তেমনই দারুণ ভয়ে কুঁকড়ে গেছিলাম, তার এই বিশালতা আর, আদবকেতার বাহুল্যে। এক অর্থে বাঁচিয়ে দিয়েছিল আর জি করই। কিছু দুর্দান্ত সিনিয়র, বন্ধু, শিক্ষক, পড়াশোনা, লেখালেখি, নাটক– এই সমস্ত কিছুই আস্তে আস্তে এই শহর আর তার মানুষকে চিনতে শিখিয়েছিল। শিখিয়েছিল নিজেকে চিনতেও। ঘর তো এইটুকুই। আজ সেই ঘর আমার কাছে পরিত্যক্ত... এত দীন কবে হল আমার আর জি কর, বা তার মধ্যে থাকা কতিপয় মানুষেরা? হয়তো আমরা, যারা প্রাক্তনী, তারা আঁচ পাচ্ছিলাম, ধীরে ধীরে ভিটেমাটি হারাচ্ছে আমাদের; তবে সাধারণ মানুষের কাছে সেসব বদল এই কদিন আগেও দৃষ্টিগ্রাহ্য ছিল না। দুর্ভাগ্য, চোখ খুলতে গিয়ে যে ঘটনাপ্রবাহের সামনে দাঁড়াতে হল, তার অভিঘাত অবর্ণনীয়।
বিগত কয়েকদিন এক অবশ যাপন চলেছে ব্যক্তিগত স্তরে। কিন্তু এ যে নীরব থাকার সময় নয়...
যে ঘটনা আজ আমার কলেজে ঘটেছে, তা বেশ কিছু প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়েছে। এবং বিগত কয়েকদিনে সোশ্যাল মিডিয়া এবং মেনস্ট্রিম মিডিয়া মারফত সেসব আপনারা জেনেছেন। মেয়েটির কোথায় কোথায় কেমন আঘাত, সে আঘাতের নৃশংসতার চরিত্র, একাধিক মানুষের জড়িত থাকার সম্ভাবনা, এসব নিয়ে আজ রাজ্য তথা দেশ অবগত এবং উত্তাল। দুর্ভাগ্যবশত আজকের এই ডেটা সায়েন্সের দুনিয়ায় মেয়েটির নামও বেরিয়ে এসেছে প্রকাশ্যে। কিন্তু এত তথ্যের ভিড়ে দু-একটা আপাত-সাধারণ বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ঘটনার একদম ঊষাকালে যে তথ্য পরিবেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, এবং যিনি ছড়িয়ে দেন, সমস্তই বিভ্রান্তিকর। এরপরেও দেহ সৎকার, সিসিটিভি ফুটেজ, অপরাধী গ্রেপ্তার এবং প্রিন্সিপালের ইস্তফার বদলে রুটিন ট্রান্সফার– এ সমস্তই বেশ স্ক্রিপ্টেড মনে হয় না কি? নিশ্চিত, হয়। আর হয় বলেই, গত সোমবার এত সহনাগরিক পা মিলিয়ে যান আর জি করে। এক মহিলার তথাকথিত 'ঘর'-এ ঢুকে তাকে দুমড়েমুচড়ে দেওয়ার হৃদয়বিদারক ঘটনার অব্যবহিত পরেই, এমন ঘটনাকে ধামাচাপা বা লঘু করার প্রচেষ্টাও কি আমাদের আরও আতঙ্কিত করে না? একটা মানুষকে মেরে ফেলার জন্য তার পেলভিক বোন ভাঙার মতো কষ্টসাধ্য কাজ তো করতে হয় না... সে কাজে স্রেফ নিষ্ঠুরতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাহলে কি এই নিষ্ঠুর, ঘৃণ্য অপরাধকেও যাতে র্যাশানালাইজ না করে ফেলা হয়, তাই আমাদের এত তীব্র প্রতিবাদ জানাতে হচ্ছে? অর্থাৎ, আমরা বুঝছি, আমাদের সমাজে এই জঘন্য অপরাধের সমর্থনকারী কিছু ক্ষমতাশালী মানুষও রয়েছে। তাই 'আমার ঘরের মেয়ের নিরাপত্তা কোথায়', এই প্রশ্নের উত্তর না মেলার আতঙ্ক যতটা সত্যি, তেমনই এত চূড়ান্ত পৈশাচিকতাকে র্যাশানালাইজ এবং এই ভয়কে ক্যাপিটালাইজ করার মতো আমার 'সমাজ'-টাও ততোধিক ভয়ংকর সত্য। প্রথম সত্য আমার-আপনার কাছে অনেক আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল, কিন্তু এই দ্বিতীয় সত্য খানিক নতুন... কারণ এত তীব্র অভিঘাতের মধ্যে দিয়ে আমার সমাজ কীভাবে যায়, এবং রিয়্যাক্ট করে, তা নির্ভয়ার ঘটনার পর সাম্প্রতিক অতীতে আর দেখা যায়নি।
যেভাবে একের পর এক দুর্নীতির সঙ্গে ঘর করেছেন আর জি করের সদ্যপ্রাক্তন প্রিন্সিপাল, তাতে এক অর্থে আমরা যে সার্বিকভাবে সমস্ত রাজনৈতিক পরিচয় বজায় রেখে, খেয়োখেয়ি করেই বাঁচতে চাই, তা স্পষ্ট। কিন্তু এই জঘন্য ঘটনার প্রেক্ষিত খুঁজতে গেলে, কোনোভাবে কি একে বিচ্ছিন্ন বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়? নাকি আমাদের ইন্ট্রোস্পেক্ট করা উচিত প্রিন্সিপালের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া এক দলদাস বাহিনীর প্রতি? আমাদের সময়ের একের পর এক দুর্দান্ত শিক্ষকের বদলি, বিরুদ্ধ স্বর বুজিয়ে দেওয়ার দুর্মদ প্রচেষ্টা, মেডিকেল ওয়েস্ট প্রসেসিং সহ অন্য বিভিন্ন টেন্ডার দুর্নীতি, কিছু ইন্টার্নদের বুক ফুলিয়ে বেলাগাম অন্যায়-শাসন, অন্য কিছু মেরুদণ্ড সোজা রাখা ছাত্রদের ইচ্ছাকৃতভাবে ফেল করানোর নির্দেশ, এসবই আর জি করের দীর্ঘদিনের লড়াকু শিরদাঁড়াকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বিগত পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে। তাই গত শনিবার আর জি করে প্রবেশ করতে গিয়ে বাধা পেতে হয় শহরের অন্য মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়া-ডাক্তারদের, যাদের মধ্যে অনেকে আবার আমার মতো আর জি করেরই প্রাক্তনী। বেগ পেতে হয়, প্রিন্সিপালের পদত্যাগের দাবি তুলতে। এবং তা এই খুন এবং ধর্ষণের ঘটনার পরেও।
এও আমাদের সমাজেরই প্রতিফলন। আমরাই আমাদের সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তারি পড়তে পাঠাচ্ছি। তাদের মধ্যে মূল্যবোধটুকু শুধু বুনে দিতে ভুলে যাচ্ছি। আমরা মেয়েদের বলছি, 'রাতে একা বেরিয়ো না'; কিন্তু নিজেদের ছেলেদের চাহনির অসুস্থতা সারাতে পারছি না। ডাক্তারি এমন এক প্রফেশন, যেখানে হাতে হাত মিলিয়ে ছেলে এবং মেয়ে ডাক্তার, নার্সিং স্টাফ সকলেই দিন-রাত জুড়ে ডিউটি করে এসেছে। আজও করছে। ইতিপূর্বে এই ভয়ের মুখোমুখি কখনও হতে হয়নি। জেলা বা রুরাল হাসপাতালে সিকিউরিটির হাল তো আরও তথৈবচ। কী অবস্থা, সেখানকার মেয়েদের? বিশেষ করে রাতের হাসপাতালে? কিছুই বদলায়নি, বদলাবে কি? মানুষের স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী। আজ করিডরে আলো লাগানো হবে, সিকিউরিটি সংস্থাকে শো-কজ বা সাসপেন্ড করা হবে, প্রিন্সিপালকে বদলি করা হবে কি শুধুমাত্র এই স্মৃতি ফিকে হলে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য? যতদিন না দলমত নির্বিশেষে এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে প্রশাসন এবং ক্ষমতার অলিন্দে থাকা মানুষ প্রতিরোধ তৈরি করবেন, ততদিন এই তোষণ এবং শোষণের রাজনীতি বেঁচে থাকবে।
আজ যখন চিকিৎসক হিসেবে কোনও বাচ্চা মেয়েকে চিকিৎসা করছি, তখন মনে হচ্ছে, আর দশ কিংবা বারো বছর পর এই বাচ্চাকেও তাহলে ভয়টা নিয়ে পথে হাঁটতে হবে, কর্মক্ষেত্রে যেতে হবে এবং বাঁচতে হবে? এই ধারণা আমার মতো অনেকের মনে পুঁতে দেওয়ার জন্য এই সমাজকেই কাঠগড়ায় তুলি আমি। কিন্তু সে সমাজও তো আমার-আপনার মতো মানুষ দিয়েই তৈরি। আজ কি সত্যিই ভাবার সময় আসেনি, “কত হাজার মরলে পরে, মানবে তুমি শেষে, বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে?"
****************
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র এবং বিবস্বান
আরও পড়ুন : যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান