মৃত্যুর দোরগোড়ায় কি ভেসে ওঠে স্মৃতি?
কথায় বলে, মৃত্যু শিয়রে এলে নাকি গোটা জীবনটা এক লহমায় চোখের সামনে ঝলসে ওঠে। কালান্তক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন যারা, তাদের অনেকের এমনটাই বক্তব্য। কেউ কেউ আবার বলেন, তারা নাকি একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সুতীব্র আলোর সামনে চলে এসেছিলেন; কেউ আবার নিজের দেহের বাইরে থেকে নিজেকে দেখার কথা বলেছেন। কিন্তু দিনের শেষে এই সবকিছুই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যার কতটা সত্য আর কতটা বিভ্রম, তা বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করা নয়। সম্প্রতি সেই কাজেই বিজ্ঞানীরা কিছুটা এগিয়ে গেলেন, তাও আবার নিতান্ত আকস্মিক ভাবেই।
মৃত্যুর চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আমাদের মস্তিষ্ক ঠিক কিভাবে সাড়া দেয়, সে কথা জানার সবচাইতে প্রাথমিক উপায় অবশ্যই নিরন্তর পর্যবেক্ষণ। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মগজ পর্যবেক্ষণ করার কাজ তো আর আটঘাঁট বেঁধে করা যায় না, যেখানে চিকিৎসকদের মুখ্য উদ্দেশ্যই হল সেই মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার সবরকম চেষ্টা করা। কিন্তু ৮৭ বছর বয়সী এক মৃগীরোগী যখন হাসপাতালে ভর্তি হলেন, তখন অযাচিত ভাবেই ডাক্তার রাউল ভিসেন্তি ও আজমল জামারের কাছে সে সুযোগ এসে গেল। দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই রোগীর মাথায় রক্ত জমাট বেঁধেছিল, তাই তাঁর মস্তিষ্কে শল্যচিকিৎসা করার আগে-পরে তাঁকে ২৪ ঘন্টার পর্যবেক্ষণে রাখাও দরকারি ছিল। সেই সময়ে ডাক্তাররা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে তাঁর মস্তিষ্কের ইলেক্ট্রো-এনসেফালোগ্রাফি (ইইজি) করতে থাকেন। এই পদ্ধতির নাম আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত, এতে মগজের নিজস্ব বৈদ্যুতিক ছন্দটি দিব্যি বোঝা যায় – ঠিক যেভাবে হৃদপিণ্ডের নির্দিষ্ট ছন্দ বুঝে নেয় ইকো-কার্ডিওগ্রাফি পদ্ধতি। এই পর্যবেক্ষণ চলাকালীনই রোগীর অবস্থার অবনতি হয় এবং তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ডাক্তাররা যখন সবগুলো ইইজি রিপোর্ট নিয়ে বসেন, তখন তাঁরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেন। মৃত্যুর একটু আগে থেকে হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হওয়ার একটু পরে অবধি মস্তিষ্কের অন্য সব ছন্দ কমে গিয়ে শুধুমাত্র গামা ওয়েভ বেড়ে গেছে।
ব্রেইন ওয়েভ বা মগজ তরঙ্গ আসলে রাশি রাশি নিউরন কোশের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা বৈদ্যুতিক সংযোগের ছন্দ। ইইজি পদ্ধতির মাধ্যমে এই ছন্দ মেপে স্নায়ুঘটিত বিভিন্ন রোগের ধরন বোঝা যায় খুব সহজেই। মূলত পাঁচ ধরনের ওয়েভ দেখা যায় – আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা আর থিটা। এর মধ্যে ডেল্টা সবচাইতে ধীরগতির ছন্দ, যা গভীর ঘুম বা ধ্যানের সময় উৎপন্ন হয়, আবার বিটা ওয়েভ হল কর্মক্ষম মগজের সবসময়ের সঙ্গী। আর সবচাইতে দ্রুতগতির ছন্দ হল গামা, যা কিনা অতিসক্রিয়তা এবং উচ্চতর চেতনার সঙ্গে যুক্ত। গবেষণায় প্রমাণিত, ডিলিউশন ও হ্যালুসিনেশন জাতীয় অবস্থায় গামা ওয়েভের ছোটখাটো বিস্ফোরণ দেখা যায়। এইক্ষেত্রেও রোগীর মৃত্যুর ৩০ সেকেন্ড আগে থেকে ৩০ সেকেন্ড পরে অবধি তাঁর মগজের ছন্দের মধ্যে গামা ওয়েভের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। বাকি চাররকমের ওয়েভ ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে, এইধরনের নির্দিষ্ট ছন্দ মস্তিষ্কের পুরনো স্মৃতি মনে করার নির্দেশের সঙ্গে মিলে যায়।
আরও পড়ুন : মহাকাশের বুকে টেলিস্কোপের সেলফি / টিম সিলি পয়েন্ট
পুরোটাই যদিও একজনেরই মৃত্যু অভিজ্ঞতার ফসল, আর সত্যি বলতে, জেনেবুঝে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের আকস্মিক মৃত্যুতে এমন গবেষণা করা একরকম অসম্ভব ও অবিবেচক কাজ। তাই নির্দিষ্টভাবে কোনোকিছু এখনই বলা সম্ভব নয়, তবে হয়তো নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন হলে মানব মস্তিষ্ক ফিরে দেখে নেয় তার ফেলে আসা জীবনটাকেই।
...............
তথ্যসূত্র :
Enhanced interplay of neuronal coherence and coupling in the dying human brain, Frontiers in Aging Neuroscience, 2022