নিবন্ধ

Wish কী?

বিবস্বান দত্ত July 22, 2020 at 9:14 am নিবন্ধ

"Whiskey, like a beautiful woman, demands appreciation. You gaze first, then it's time to drink." -Haruki Murakami, Hard-Boiled Wonderland and the End of the World

গরল কিনা প্রকৃত পানীয় আমরা জানতে পারিনি কোনোদিন। তবে ছুঁয়ে দেখেছি তরল সূর্যাস্ত। নিভে আসা বিকেল ঠাঁই নিয়েছে গ্লাসে। আর ইতিহাসের কোন ধূসর লগ্ন থেকে উদযাপনে, বিরহে, একাকিত্বে মানুষের হাতে হাত রেখেছে সে।

মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর- এই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ নিয়ে আমরা সেই তরলে ডুব মারি। মদ খেলে নেশা হয় সবাই জানে। তবে মদ শুধু নেশার জন্য নয়। মদ একটা সংস্কৃতি, একটা চলমান ইতিহাস। আজ সেই ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় নিয়ে আমরা কথা বলব। হুইস্কি।

Whisky বা Whiskey শব্দটা এসেছে Uisge beatha বা uisce beatha থেকে। যার আক্ষরিক অনুবাদ করলে হয় Water of life। এর জন্মস্থান আয়ারল্যান্ড না স্কটল্যান্ড তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। স্কটল্যান্ডে যা ‘whisky’ আয়ারল্যান্ডে সেটাই ‘whiskey’। তবে প্রথম লাইসেন্সপ্রাপ্ত হুইস্কি কিন্তু তৈরি হয়েছিল ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে আয়ারল্যান্ডের বুশমিল জেলায়। রাজা প্রথম জেমসের আমলে। তার আগে নিশ্চিত ভাবেই হুইস্কির একটা দীর্ঘ ইতিহাস ছিল। সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়া থেকে আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডে হুইস্কি তৈরি শুরু হয়ে যায়।

আসলে অ্যালকোহলিক পানীয়ের দুটি মূল ভাগ আছে। যে অ্যালকোহলকে পাতন (distilled ) করা হয়, তাকে বলে স্পিরিট। যেমন, হুইস্কি রাম জিন ভদকা প্রভৃতি। আর যাকে পাতন করা হয় না, ফার্মেন্টেশনের পর সরাসরি খাওয়া হয়, তাদের বলে ওয়াইন। এখন হুইস্কি নানা ধরনের হয়। কোন জায়গায় তৈরি হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে হুইস্কিকে ভাগ করা হয়। যেমন, স্কচ(স্কটল্যাণ্ডে),আইরিশ(আয়ারল্যাণ্ডে), জাপানিজ, কানাডিয়ান, বারবন (আমেরিকায় মূলত) , ইন্ডিয়ান প্রভৃতি। আর তৈরি করার পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেও হুইস্কিকে নানা ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। হুইস্কি সাধারণত তৈরি হয় বার্লি থেকে। তবে নানা জায়গায় অন্যান্য শস্যও ব্যবহার করা হয়। যেমন আমেরিকায় রাইয়ের হুইস্কি মেলে। যে জায়গায় হুইস্কি তৈরি হয় (পাতিত) তাকে বলে ডিস্টিলারি। একটি ডিস্টিলারি থেকে যখন মলটেড বার্লি দিয়ে হুইস্কি তৈরি হয় তখন তাকে বলে সিঙ্গেল মল্ট (যেমন, গ্লেনফিদিক, গ্লেনলেভি, গ্লেন মোরেনজি প্রভৃতি)। আবার যখন একাধিক ডিস্টিলারির থেকে হুইস্কি এনে কোনো মাস্টার ব্লেন্ডার সেগুলোকে মিশিয়ে হুইস্কি তৈরি করেন তখন তাকে বলে ব্লেন্ডেড হুইস্কি। যেমন মানকিসোল্ডার, টিচার্স, হান্ড্রেড পাইপার্স, ব্লু লেভেল, ব্ল্যাক লেভেল, রেড লেভেল প্রভৃতি। এই মাস্টার ব্লেন্ডাররা কিন্তু প্রকৃত শিল্পী । বিভিন্ন ডিস্টিলারির হুইস্কি মিশিয়ে এঁরা এমন এক বিশেষ স্বতন্ত্র স্বাদ,গন্ধ এবং রঙের জন্ম দেন যা সেই বিশেষ হুইস্কিটির পরিচয় হয়ে ওঠে। আবার যখন কোনো একটি ডিস্টিলারির একটি ব্যারেলের হুইস্কি নিয়েই একটি হুইস্কির বোতল তৈরি হয় তখন তাকে বলে সিঙ্গেল ব্যারেল বা সিঙ্গেল কাস্ক।

হুইস্কি তৈরির পরে বাধ্যতামূলকভাবে তাকে ওক কাঠের ব্যারেলে রাখা হয় বেশ কয়েক বছর (স্কটল্যান্ডে অন্তত তিন বছর)। একে বলে ‘এজিং’। যে হুইস্কি যত পুরোনো সেই হুইস্কি তত দামি। তার গন্ধ আর স্বাদও তত সুন্দর। এছাড়াও হুইস্কি নানারকম হয়। চিল ফিল্টার্ড- নন চিল ফিল্টার্ড, পিটেড, নন-পিটেড প্রভৃতি। এই ছোট্ট পরিসর এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য যথেষ্ট নয়।

যে গ্লাসে সাধারণত হুইস্কি খাওয়া হয় তাকে বলে ওল্ড ফ্যাশন গ্লাস বা রক গ্লাস। এছাড়াও দু ধরণের গ্লাসে হুইস্কি খাওয়ার চল আছে। গ্লেনকেন এবং কপিতা।

আসলে এই লেখার শুরুতে যা বলেছিলাম, সেই কথাটা আরেকবার মনে করা প্রয়োজন। মদ খেলে নেশা হয় ঠিকই। কিন্তু মদ শুধু নেশা নয়। মদ একটা সংস্কৃতি একটা পরম্পরা। সেই পরম্পরা অনুযায়ী বিশেষ মদ খাওয়ার জন্য বিশেষ গ্লাসের ব্যবহার। তবে সব সময় আর সব জায়গায় যে সেটা মানা হয় তাও নয়। কলকাতার অন্যতম পুরোনো বার ছোটা ব্রিস্টল বা সাউ ব্রাদার্সে (১৮৭২) এখনো জল খাওয়ার গ্লাসে হুইস্কি দেওয়া হয়। ওই বারে ওইটাই রিচুয়াল। আসলে পরম্পরা তো দেশকাল অনুযায়ী বদলে বদলে যায়।

যাই হোক, হুইস্কি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা আমরা এতক্ষণে করে নিয়েছি। এইবার আমাদের দেশের হুইস্কি নিয়ে একটু কথা বলা যাক। সারা পৃথিবীতে সবথেকে বেশি হুইস্কি বিক্রি হয় আমাদের দেশেই। Bank of America Merrill Lynch এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী শুধু মাত্র ২০১৪ সালে ভারতে হুইস্কি বিক্রি হয়েছিল দেড় বিলিয়ন লিটার। পৃথিবীতে সেই বছরে সব থেকে বেশি হুইস্কি বিক্রি হয়েছিল ভারতেই। ভারতে মূলত দুধরনের হুইস্কি মেলে। প্রথমত আমদানীকৃত হুইস্কি। দ্বিতীয়ত, ভারতে তৈরি হুইস্কি। এখন আমদানিকৃত হুইস্কি যা ভারতের বাজারে মেলে সেগুলি বেশিরভাগই OSBI (Over-Seas Bottled in India) গোত্রের। এগুলি বিদেশ থেকে আমদানী করে ভারতে বোতলবদ্ধ করা হয়। আমাদের চেনা জানা স্কচ বেশিরভাগই এই গোত্রের। যেমন ব্ল্যাক ডগ, ভ্যাট 69, হান্ড্রেড পাইপার্স প্রভৃতি। আবার বেশ কিছু হুইস্কি সরাসরি বিদেশ থেকেই বোতলবদ্ধ হয়ে আসে। যেমন কানাডিয়ান ক্লাব, ব্যালেনটাইন ফাইনেস্ট। আর ভারতে তৈরি হুইস্কি মূলত দুধরনের।প্রথমত, IMFL(Indian-made foreign liquor) ক্যাটাগরির হুইস্কি। মূলত ভারতে তৈরি হুইস্কির সঙ্গে খুব অল্প(দশ-বারো শতাংশ) স্কচ মিশিয়ে তৈরি হয় এই শ্রেণির হুইস্কি। যেমন , ব্লেন্ডার্স প্রাইড, সিগনেচার, এনটিকুইটি ব্লু, এইট পিএম প্রভৃতি। কিন্তু এই ধরনের হুইস্কিতে যে ভারতীয় হুইস্কি ব্যবহৃত হয় তা বেশিরভাগ সময়েই নিউট্রাল স্পিরিট। যা মূলত গুড় (মোলাসেস) থেকে তৈরি হয়। কারণ গুড়ের দাম ভারতীয় বাজারে বেশ কম। কিন্তু প্রকৃত হুইস্কি তৈরি হয় মূলত বার্লি থেকে। তাই ভারতে সর্বাধিক জনপ্রিয় এই IMFL ক্যাটাগরির হুইস্কিকে অনেক হুইস্কিবোদ্ধাই প্রকৃত হুইস্কি বলে মনে করেন না।

তাহলে ভারতে কি সত্যিকারের হুইস্কি তৈরি হয় না? উত্তরটা অবশ্যই হ্যাঁ। কেবল তৈরিই নয়, ভারতীয় হুইস্কি কিন্তু পৃথিবীর হুইস্কি মানচিত্রে খুব সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। এমনকি জিম মারির হুইস্কি বাইবেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হুইস্কিদের সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে ভারতের বেশ কিছু হুইস্কি। হয়তো ভারতীয় বাজারে সেগুলি খুব জনপ্রিয় নয়। তবু হুইস্কিবিশ্বে সেগুলিই ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন ১৯৪৮ সালে জে.এন. রাধাকৃষ্ণের তৈরি অমরুত ডিস্টিলারি। এই ডিস্টিলারির অমরুত ফিউশন সিঙ্গেল মল্ট ২০১৯ সালে সান ফ্ল্যান্সিস্কোতে অনুষ্ঠিত বারটেন্ডার্স স্পিরিট এওয়ার্ডসে গোল্ড এওয়ার্ড পেয়ে ‘হুইস্কি অফ দ্য ইয়ার’-এর খেতাব পায়। মনে রাখা দরকার, সেই প্রতিযোগিতায় অমরুতকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল সারা পৃথিবীর অনেক খ্যাতনামা স্কচ, আইরিশ, জাপানিজ, আমেরিকান হুইস্কির সঙ্গে। অমরুত আরও বেশ কিছু হুইস্কি তৈরি করে। যার মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য অমরুত এমালগাম ব্লেন্ডেড হুইস্কি। ম্যাকিন্টোসের মত পকেটবান্ধব হুইস্কিও তৈরি হয় এই ডিস্টিলারি থেকে। অমরুত ভারতের প্রথম সিঙ্গেল মল্ট প্রস্তুতকারক সংস্থা। বলা বাহুল্য অমরুতের হুইস্কি গুড়জাত নয়। হিমালয়ের পাদদেশ, পাঞ্জাব প্রভৃতি জায়গা থেকে বিখ্যাত ভারতীয় সিক্স রো বার্লি আহরণ করে মূলত কর্ণাটকে এই হুইস্কি তৈরি হয়। ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত উত্তরপ্রদেশের রাডিকো খৈতান গ্রূপের রামপুর সিঙ্গেল মল্ট আরেকটি উৎকৃষ্ট ভারতীয় নন চিল ফিল্টার্ড হুইস্কির উদাহরণ। এই হুইস্কির ঝুলিতেও রয়েছে প্রচুর আন্তর্জাতিক পুরস্কার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সান ফ্রান্সিসকো ডবল গোল্ড মেডেল।

এছাড়াও ভারতীয় হুইস্কির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জন ডিস্টিলারির পল জন হুইস্কি, খোদে ডিস্টিলারির পিটার স্কট, বিখ্যাত ওল্ড মনক রাম প্রস্তুতকারক সংস্থা মোহন ম্যাকিং-এর সোলান নাম্বার ওয়ান প্রভৃতি । এই হুইস্কিগুলিতেও মোলসেস ব্যবহার করা হয় না, ব্যবহৃত হয় গ্রেন এবং মল্ট। সুরারসিকরা স্কচ , বারবন ছেড়ে মাঝে মধ্যে ভারতীয় হুইস্কিও চেখে দেখতে পারেন। হয়ত বদলে যাবে স্বাদ। তৈরি হবে নতুন রুচি।

আপাতত গ্লাস শেষ। আরেকদিন বসা যাবে নাহয়। গলন্ত সূর্য নেমে আসবে গলায়। আর সেদিনও, এক দূরের ডিস্টিলারিতে, ওক কাঠের ব্যারেলে বুড়ো হতে হতে কোনো হুইস্কি মুচকি হাসবে। কত প্রেম দেখেছে সে। দেখেছে প্রেম ভাঙা। সাক্ষী থেকেছে যুদ্ধের আর মারীর। জীবনের থেকে গাঢ় নেশা তো হুইস্কিও দেয় না। ততদিনের জন্য , গ্লাসে গ্লাসে ঠোকাঠুকি হোক। জীবন তার সমস্ত সাফল্য,ব্যর্থতা আর একাকিত্বকে উল্লাসে ঢেকে দিক। চিয়ার্স!



[কভারে ব্যবহৃত হয়েছে Kevin Mckrell-এর বিখ্যাত ছবি 'Slainte']

#নিবন্ধ #হুইস্কি #বিবস্বান দত্ত #সংস্কৃতি #সমাজ #বিলাস

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

25

Unique Visitors

219267