ব্ল্যাক হোল কী খায়
ব্ল্যাক হোলের খিদে রাক্ষুসে। সে নাকি যা পায়, আত্মসাৎ করে নেয় নিজের বিপুল জঠরে। তারপর সেই খাদ্যের পরিণতি কী হয়, সেটা নিয়েও তৈরি হয় রহস্য। আদতে ব্ল্যাক হোল কী খায় আর কী খায় না— এ বলা খুব কঠিন। মহাশূন্যের কোত্থাও আমাদের পৃথিবীর মতো এমন সুখাদ্যময় জায়গা নেই, আর সে জন্য ব্ল্যাক হোলদের বাধ্য হয়ে পেট ভরাতে হয় মূলত ধুলো, বালি আর গ্যাস দিয়ে।
যে কোনো ব্ল্যাক হোলেরই চারপাশে একটা সীমানা নির্দিষ্ট করা আছে, যেটাকে বিজ্ঞানীরা ‘ইভেন্ট হরাইজন’ বা ঘটনা দিগন্ত বলে ডাকেন। ওই এলাকার মধ্যে কোনোকিছু একবার ঢুকে গেলেই, ব্যস, তার খেল খতম। তখন তার আর রেহাই নেই, এক লহমায় কপাৎ করে সেটা গিলে খাবে রাক্ষুসে ওই দানব। এমনকি আলো, যার গতি জানা সমস্ত বস্তুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, সে পর্যন্ত পালাতে পারে না; তাকে পর্যন্ত হার মানতে হয় ব্ল্যাক হোলের টানের কাছে। আর সে কারণেই ব্ল্যাক হোল অদৃশ্য, ওর নাম ব্ল্যাক।
এমনিতে ব্ল্যাক হোলের খাদ্য হল ওর কাছাকাছি চলে আসা কোনো নক্ষত্র বা প্রকাণ্ড গ্যাসের পিণ্ড। আর যেহেতু ব্ল্যাক হোলদের সবাই একই আকারের নয়, ওদের মধ্যেও পেটমোটা, রোগাভোগা আবার বামন আকার— সব রকমেরই নমুনা উপস্থিত, সুতরাং সবাই যে একই পরিমাণে বা একই স্টাইলে খাবে সেটা নয় মোটেই। খুব ভারী যে সব ব্ল্যাক হোল, যাদের নাম দেওয়া হয়েছে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল (এরকমই একজন বসে আছে আমাদের এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একেবারে মাঝখানে), তাদের খিদে সবচেয়ে বেশি। প্রকাণ্ড বড় গ্যাসের পিণ্ড কাছে এলে তাই ওদের আনন্দ সবচেয়ে বেশি।
এবার এরকমই এক ব্ল্যাক হোলের কথা ভাবা যাক। ওর কাছাকাছি কোনো গ্যাসীয় মেঘপিণ্ড, ধরা যাক ভাসতে ভাসতে চলে এসেছে। এখন এই গ্যাসীয় পিণ্ড তো আর ছোটখাটো ব্যাপার না, এর আকার কখনও কখনও আমাদের এই গোটা সৌরজগতের চেয়েও অনেক বেশি লম্বা হতে পারে। তো এই গ্যাসের প্রকাণ্ড পিণ্ড যখন ব্ল্যাক হোলের কাছে চলে আসে, তখন ওর একটা প্রান্তকে ধরে টান দেয় ব্ল্যাক হোল, আর সেই টানে ওটা আরও বেশি করে লম্বা হতে শুরু করে। আমরা মুখের মধ্যে চিউয়িং গাম রেখে বেশ খানিকক্ষণ ধরে সেটাকে চিবিয়ে যখন আঙুল দিয়ে ওটা ধরে টানি, তখন ও যেমন লম্বা হয়, ঠিক সেইভাবে গ্যাসের ওই পিণ্ড লম্বা হতে থাকে। এরপর শুরু হয় ওর ব্ল্যাক হোলের পেটের দিকে যাত্রা। যেন প্রকাণ্ড এক মুখের মধ্যে দিয়ে ব্ল্যাক হোলটি তার পেটের মধ্যে টেনে নিচ্ছে লম্বা চাউমিনের এক টুকরো।
ওই এলাকা পেরিয়ে যাওয়ার পরে প্রচণ্ড পরিমাণে গতি বাড়তে থাকে ঢুকে যাওয়া ওই গ্যাসীয় পিণ্ডের। এখন ব্ল্যাক হোল যত বেশি পরিমাণে ‘খাদ্য’ গিলতে থাকে, তত বেশি বাড়তে থাকে ওর ওজন। এ তো সহজ কথা, আমরা কিছু খেতে থাকলেও আমাদের ওজন বাড়তে থাকে। আর ব্ল্যাক হোলের ওজন যত বাড়ে, ওর চেহারাও ফুলতে থাকে। আর ওই ব্ল্যাক হোলের চারপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে এক্স রশ্মির মতো বিভিন্ন ধরনের বিকিরণ। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে বসে থাকা ব্ল্যাক হোলের ভেতর থেকেও মাঝেমধ্যে এরকম এক্স রশ্মি নির্গত হয়, যা বিজ্ঞানীদের যন্ত্রে ধরা পড়ে। খুব বড় মাপের ব্ল্যাক হোল হলে স্বাভাবিকভাবে তার খিদে বেশি হবে, সে খাবে বেশি, আর তার শরীর থেকে এই রকমের বিকিরণও বেরিয়ে আসবে অনেক বেশি। কখনও কখনও এই বিকিরণের মধ্যে দৃশ্যমান আলোও থাকে। তখন ওদের খুঁজে পাওয়া সহজ হয়। আমাদের মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের ব্ল্যাক হোলের তুলনায় লক্ষ গুণ বড় এমন ব্ল্যাক হোলের সন্ধান বিজ্ঞানীরা ওই বিকিরণের মাধ্যমেই পেয়েছেন। এটা এখানেই বলে নেওয়া দরকার, বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর নামে এই বিকিরণকে ‘হকিং রেডিয়েশন’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আবার কখনও কখনও এমনও হয়, ব্ল্যাক হোলের আকার হয়তো বেশ ছোট, কিন্তু তার খেতে চাওয়ার ইচ্ছে অনেক বেশি। তখন হয় কী, সে তার চারপাশে থাকা প্রচুর ‘খাবার’-এর স্টক থেকে অল্প কিছুই গলাধকরণ করতে পারে, বাকি সবটাই তার ইভেন্ট হরাইজন টপকে বেরিয়ে আসে বাইরেই; যেন কেউ বেশি খেতে না পেরে বমি করে দিল। ওই পদার্থের সবটাই প্রায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আর ওটা থেকেই আবার তৈরি হয় নতুন বাচ্চা তারা।
সুতরাং ব্ল্যাক হোল আমাদের মতোই। কেউ বেশি খায়, কেউ খেতে না পেরে বমি করে দেয়, আবার কেউ যা খায় তার সবটাই হজম করে ফেলে।
হাবল স্পেস টেলিস্কোপের মতো বেশ কয়েকটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ অনেক কাল ধরেই মহাকাশের বুকে ছড়িয়ে থাকা এরকম বেশ কিছু ব্ল্যাক হোলকে নানাভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। ওদের যন্ত্রেই ধরা পড়েছে ব্ল্যাক হোলের খাওয়ার ছবি। কীভাবে ব্ল্যাক হোলের কাছে গিয়ে গ্যাসীয় পদার্থের লম্বা দলাপাকানো ভাণ্ডার প্রচণ্ড গতিতে ওদের ঘিরে পাক খেতে শুরু করে, তারপর কীভাবে সে চলে যায় রাক্ষুসে দানবের অন্দরে এর সবই। সুতরাং, ব্ল্যাক হোল যে আমাদের মতোই খাদ্যরসিক, এতে সন্দেহ থাকবার কথাই না। শুধু পার্থক্যের মধ্যে ওর খাদ্য নিয়ে বাছবিচার নেই, এই যা।
সাধে কি আর ব্ল্যাক হোলকে ‘কসমিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার’ বলে?
……………………………………