ওয়েব সিরিজ রিভিউ : তাজ মহল ১৯৮৯
ওয়েব সিরিজ : তাজ মহল ১৯৮৯ কাহিনি ও পরিচালনা : পুষ্পেন্দ্রনাথ মিশ্রদৃশ্যগ্রহণ : উইল হামফ্রিস সঙ্গীত : অমর মঙ্গরুলকর মাধ্যম : নেটফ্লিক্স
১৯৮৯, ভারতের ক্যালেন্ডারে এক অন্যরকম সময়। আলাদা কোনও কিছুই সেভাবে ডানা ঝাপটায়নি তখনও। তবু অন্যরকম, কারণ বছর কয়েকের ব্যবধানে মধ্যবিত্তের জীবন, মূল্যবোধ সবকিছুই এতটা পাল্টে যেতে থাকবে যে এই সময়ের সারল্যটাকে অবিশ্বাস্য অতীত বলে মনে হবে। ১৯৮৯, এমন এক সময় যখন ইন্টারনেট এক অলীক স্বপ্ন, কোনও এক অখ্যাত মনমোহন সিং-এর হাত ধরে বাজার অর্থনীতির খোলা হাওয়া এসে পৌঁছয়নি এবং বাবরি মসজিদ তখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
এইরকম ক্যানভাসে লখনৌ-এর অলিগলি জুড়ে টক-ঝাল-মিষ্টি গল্প আঁকে এই সিরিজের চরিত্ররা। বাজার-চলতি ছক মেনেই চরিত্ররা সবাই কোথাও না কোথাও একে-অপরের জীবন ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভালোলাগা খারাপথাকা সব কিছুই চেনা সমীকরণ ছেড়ে অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়ায়। কেউ কেউ তার মধ্যেই খুঁজে পায় জীবনের রসদ, কেউ হারিয়ে যায় চোরাবালিতে। গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি সুন্দর ভাবে দুই আলাদা প্রজন্মের সমান্তরাল ভাষ্য বুনে চলেন পরিচালক। একদিকে যেমন আখতার-সরিতা-সুধাকর-মুমতাজের প্রৌঢ়ত্বের সংসার, অন্যদিকে অঙ্গদ-রশমি-ধরম-মমতার কলেজ ক্যান্টিন মাতানো উদ্দাম যৌবন – দু’পক্ষই নিজেদের গল্প বলে চলে ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে। কলেজের প্রফেসর-যুগল আখতার ও সরিতা তাদের মিড-লাইফ ক্রাইসিসের মাঝে হাতড়ে চলে নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের হিসেব। খুঁটিনাটি বিবাদের মধ্যে দিয়ে মেপে নিতে চায় এতদিনের একসঙ্গে থাকা কী ভালোবাসা, নাকি শুধুই অভ্যাস? তাদের এই টানাপোড়েন আরও বাড়িয়ে তোলে পুরনো বন্ধু সুধাকর-মুমতাজের আকস্মিক আবির্ভাব। দাম্পত্যের মাঝদরিয়ায় পথ হারানো আখতারের রোজনামচায় তার প্রিয় মুশায়েরা-র মেহফিল সেজে ওঠে বন্ধুপত্নীর শায়রানায়। স্বল্পশিক্ষিত, স্বভাব-শায়র মুমতাজের ভয়াবহ অতীত তাকে খুশির স্বাদেও অহরহ বিষাদের ভয় দেখায়। সুধাকরের সঙ্গে তার কাব্যিক প্রেমেও কাঁটা হয়ে ফোটে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার একরোখা মনোভাব। অন্যদিকে সুধাকরের ভাগ্নে ধরম আর তার প্রেমিকা রশমির ক্যান্ডিফ্লস রোম্যান্সের মাঝে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকতে থাকে রাজনীতি আর ক্ষমতার চোরাস্রোত। বিশ্বফাজিল অঙ্গদের শরীরসর্বস্ব বস্তুবাদী দর্শনে ফাটল ধরাতে থাকে কমিউনিস্ট যুবনেত্রী মমতা আর সবাইকে ঘিরে ধরে পাখির নরম বুকের মতো ওম নেয় বিগত দশকের মধ্যবিত্তি।
আরও পড়ুন : ওয়েব সিরিজ রিভিউ : দ্য বয়েজ / সুচরিতা বসু
চিত্রনাট্যের শুরু থেকেই প্রতিটি চরিত্রের fourth wall ভেঙে সংলাপ বলার কাঠামো বেশ নজরকাড়া তবে একই ট্রিটমেন্টের পৌনঃপুনিক ব্যবহারে শুরুর দিকের মজা শেষে গিয়ে বিরক্তির উদ্রেক করে। কাহিনির ধরতাই হিসেবে যে ধরনের দৃশ্যান্তর সিরিজের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে, গল্পের শরীর জুড়ে যখন-তখন সেই একই ধরনের দৃশ্যান্তর কাহিনির গতিময়তাকে অনাবশ্যক স্পিডব্রেকারের মুখে ফেলে। এই জায়গায় প্রয়োজন ছিল দক্ষ সম্পাদনার, যে দায়িত্ব পরিচালক নিজের ঘাড়ে নিয়েছেন এবং ডুবিয়েছেন। এই ডোবানোর কাজে তাকে যোগ্য সঙ্গত করেছেন সিরিজের সঙ্গীত পরিচালক অমর। বারো-তেরোটি আলাদা আলাদা গান বিভিন্ন সময়ে খাপছাড়া ভাবে ঢুকেছে, কোথাও আবহ হিসেবে তা মানিয়েছে আবার কোথাও তার কোনও অভিঘাত আদৌ বোঝা যায়নি। অথচ গল্পকার হিসেবে নবাগত পরিচালক যা দক্ষতা দেখিয়েছেন তা এককথায় কুর্নিশযোগ্য। ঊর্দু ভাষার পেলবতায় মজে থাকা আখতার বেইগ, ভালোবাসার ঘর গড়তে চাওয়া মুমতাজ, কিংবা একটা পিস্তলকে ক্ষমতার শেষ কথা ভেবে মোহে আটকে পড়া ধরম – প্রতিটি চরিত্রকে অসম্ভব মুন্সিয়ানায় গড়ে তুলেছেন পুষ্পেন্দ্র। কাউকে অযথা কম সময় দেননি, কারও বক্তব্য অস্পষ্ট রাখেননি।
নিঃসন্দেহে এই সিরিজের আসল প্রাণশক্তি এর অভিনেতারা। আখতারের চরিত্রে নীরজ কবি আর মুমতাজের চরিত্রে শীবা চাড্ডা যেন স্বতন্ত্র এক অভিনয়ের প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন! ডিভোর্সের সময় কান্না আর ঝগড়ার সময়ের খিটখিটেপনা কী অদ্ভুত যত্ন সহকারে নিজের মধ্যে তুলে নিয়েছেন নীরজ, সম্ভবত নাসিরউদ্দদিন-উত্তর কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা তিনি। অন্যদিকে সরিতার চরিত্রে গীতাঞ্জলি কুলকার্নি বা সুধাকরের চরিত্রে দানিশ হুসেইন একইরকম অনবদ্য। তুলনায় নতুন প্রজন্মের গল্প কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে সমমানের দক্ষ অভিনেতার অভাবে। তারই মধ্যে অঙ্গদের চরিত্রে অনুদ সিং ঢাকা একার দায়িত্বে লাইমলাইটের পুরোটাই নীরজদের নিয়ে যেতে দেননি। চালচুলোহীন, দামাল তারুণ্য আর চোরা রোম্যান্টিক বুদ্ধিমত্তার মিশেলে গড়া এই চরিত্রে অনুদের হাসি আর চোখ সত্তর শতাংশ কাজ করে বেরিয়ে যায়।
গল্পের শেষে কমেডির মোড়কে এক ক্রাইম র্যাকেটের পর্দা ফাঁস আর তাজমহলের সামনে দাম্পত্যের নতুন যাত্রা সিরিজকে প্রয়োজনীয় হ্যাপি এন্ডিং উপহার দেয়। কাহিনি জুড়ে প্রতিটি যুগলই আসলে নিজেদের মতো করে তাজমহলের খোঁজ চালিয়ে যায়। বরাবাঁকির আধা-নির্মিত ঘরে, কলেজ রাজনীতির চড়াই-উতরাইতে কিংবা গিটার ক্লাসের নীরব প্রেমের বাঙময়তায় – ছোট ছোট তাজমহল গড়ে তুলতে চাই আমরা সবাই, কারও না কারও সাথে, কোনও না কোনও মুহূর্তে।