ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ওয়েব সিরিজ রিভিউ : দ্য বয়েজ

সুচরিতা বসু Dec 16, 2020 at 6:41 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ওয়েব সিরিজ রিভিউ : দ্য বয়েজ
মাধ্যম : অ্যামাজন প্রাইম
পরিচালনা : এরিক ক্রিপকি
দৃশ্যগ্রহণ : জেফ কাটার

২০০৬ সালে ডিসি কমিক্সের ছাতার তলায় এক নতুন গল্পের জাল বুনতে শুরু করেন দুই শিল্পী, গার্থ এনিস ও ড্যারিক রবার্টসন। চিরাচরিত গল্পের থেকে তা ছিল বেশ আলাদা, খানিক অস্বস্তিকর। অস্বস্তির পরিমাণ এমনই বেশি যে প্রথম ছয়টি সংখ্যা প্রকাশের পরেই গল্পের ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেন সংস্থার কর্তারা। প্রস্তাবিত সংখ্যাগুলিও বাতিল করা হয়। রচয়িতাদের ক্ষয়ক্ষতির কথা মাথায় রেখে অন্য কোনো প্রকাশক খুঁজতে সহযোগিতা করে ডিসি কমিক্স এবং অবশেষে একের পর এক বই দিনের আলোর মুখ দেখে। ২০১৯-এ এসে, সেই গল্প নিয়েই এরিক ক্রিপকি তৈরি করলেন ওয়েব সিরিজ, দ্য বয়েজ। 

আদতে এই সিরিজ এক মূর্তিমান চোরকাঁটা, একবার দেখা শুরু করলে সারাক্ষণ মগজে বিঁধতে থাকে। গড়পরতা কমিক্সের মতো এরও মূল উপজীব্য সুপারহিরো, তবে চরিত্রনির্মাণের দিক থেকে এই গল্প একেবারেই আলাদা। সুপারহিরোরা এখানে সর্বত্যাগী মসিহা নয়, বরং বাজার অর্থনীতির দাসত্বকারী কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। সিরিজের শুরুতেই পরিষ্কার হয়ে যায় এই গল্পে সুপারহিরোরা অভিনেতা বা খেলোয়াড়দের মতোই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর। তাদের ঘিরে মুনাফা লোটার একচ্ছত্র আধিপত্য চালায় Vought International; সুপারহিরোদের এলিট গ্রুপ, সেভেন-এর যাবতীয় মার্কেটিং কৌশল, কস্টিউম ডিজাইনিং, জনসংযোগ ও প্রচারের দায়িত্বে তারাই। এমনকি কোন সুপারহিরো কোন সমস্যার সমাধান করবে বা কোন সমস্যার সমাধানে মুনাফা বেশি, এই সবই নির্ধারিত হয় বাজারের চাহিদা ও ক্ষমতার তাগিদ মেনে। কার্যত সুপারহিরোদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই ইন্ডাস্ট্রির বিপুল আর্থিক খুঁটির উপর ভর করে থাকতে থাকতে হিরোদের মধ্যেও চলে আসতে থাকে গড কমপ্লেক্স। সিরিজের শুরুতেই ব্যাংক ডাকাতি থামাতে যাওয়া সুপারহিরো এ-ট্রেনের চরম গাফিলতির শিকার হয় সাদাসিধে দোকানি হিউই ক্যাম্পবেলের বাগদত্তা রবিন। রবিনের মৃত্যু এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলী হিউইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অতিমানবিক শক্তির আড়ালে প্রতিটি সুপারহিরোর মনবৃত্তি আসলে অতিদানবিক। রবিনের মতো বহু আনুষাঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি তাদের কাছে জলভাত, এমনকি স্বার্থের খাতিরে বহুসংখ্যক মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে সেই দায়ভার কাল্পনিক শত্রুর উপর চাপিয়ে দিতেও তারা দু’বার ভাবে না। আর এই সকল কুচক্রের মূল হোতা, সেভেন-এর নেতা, হোমল্যান্ডার। তাকে ঘিরে থাকা বাকি ছয়জনের কেউ কেউ তার নিসঙ্কোচ সমর্থক, কেউ তার পাশবিকতার ভয়ে আতঙ্কিত, আবার কেউ শুধুই ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রস্বার্থের জন্য নির্লিপ্তি বেছে নিয়েছে। এই সিস্টেমের শিকড়ে আঘাত পড়ে, যখন সেভেন-এর নবতম সদস্য হয়ে আসে স্টারলাইট। কনভেন্টের আদর্শে বড় হয়ে ওঠা মেয়েটির আশৈশব লালিত স্বপ্ন শুরুতেই ধাক্কা খায় সিনিয়র সুপারহিরোর হাতে যৌন হেনস্তার শিকার হয়ে। যত তাড়াতাড়ি সে নিজের অধিকার বুঝে নিতে শেখে, ততই অবাক হয় এই দেখে যে সাধারণের উপকার করার যে আদর্শ তাকে এতগুলো বছর শেখানো হয়েছে তার কোনো মূল্যই নেই খোদ সংস্থার কাছে। সিস্টেমের ভিতর থেকে নিজের প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নিতে থাকে স্টারলাইট। অন্যদিকে হিউইয়ের অসহায় প্রতিশোধস্পৃহাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় প্রাক্তন CIA এজেন্ট বিলি বুচার, ভাগ্যের ফেরে যার স্ত্রী হোমল্যান্ডারের কামুক প্রবৃত্তির শিকার এবং বহু বছর যাবৎ নিখোঁজ। একে একে মিলে যায় আরও কিছু খ্যাপাটে সদস্য, শুরু হয় সুপারহিরোদের মুখোশ খুলে দেওয়ার লড়াই – দ্য বয়েজ। 

সমস্ত চিত্রনাট্য এত টানটান করে লেখা, কোথাও এতটুকু আকর্ষণ টসকে যাওয়ার জো নেই। উপরি পাওনা গল্পের বিভিন্ন স্তরে সাজানো বাস্তব সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতার নানান নিদর্শন। হিউইয়ের চরিত্র দেখায়, সাধারণ মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেলে তারা কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে; বিলি বুচার আর তার বন্ধুরা বুঝিয়ে দেয়, কোনোরকম সুপার পাওয়ার না থাকলেও শুধুমাত্র পারস্পরিক বিশ্বাস আর একরোখা মনোভাবের জোরে দানবীয় শক্তির সঙ্গেও টক্কর নেওয়া যায়। সুপারহিরোদের চরিত্রগুলি আসলে চেনাজানা কমিক্স চরিত্রের নির্মম ক্যারিকেচার। হোমল্যান্ডার প্রকৃতপক্ষে আদর্শহীন, বিকৃতকাম, মেগালোম্যানিয়াক সুপারম্যান। কুইন মেভ আর এ-ট্রেনের চরিত্রে অসহায় ওয়ান্ডার উওম্যান আর নেশাখোর ফ্ল্যাশের রূপক স্পষ্ট। এইসবের মাঝে ঘুরেফিরে আসে সমকামিতার ট্যাবু, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের মাদকতা, ক্ষমতার নির্লজ্জ পিতৃতান্ত্রিক পেষণ এবং অবশ্যই – ভালোবাসা। ক্রমাগত লড়াই আর পাল্টা লড়াইয়ের আখ্যান হিউই আর বিলিকেও এই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়, কতটা অপচয়ের পরে থামতে শেখা যায়? প্রথম সিজনের হোমল্যান্ডার আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে দ্বিতীয় সিজনে, তার সদ্যবালক সন্তানকে ঘিরে অদ্ভুত এক টানাপোড়েন শুরু হয়, তাতে না চাইতেও জড়িয়ে পড়ে বিলি আর তার বয়েজ টিমের সদস্যরা। রাজনৈতিক পালাবদলকে কেন্দ্র করে পাল্টাতে থাকে খেলা, বদলে যায় ব্যক্তিগত সমীকরণ। ঘৃণ্য চক্রান্তের জাল ছড়িয়ে পড়ে আরও আরও গভীরে। তাই শিউরে ওঠার মতো থ্রিলার, কদর্য মানবিকতার মেটাফোরিক ড্রামা আর স্কুলবেলা রোম্যান্সের হাল্কা আভাসের মারকাটারি মিশেল দেখতে চাইলে এই সিরিজ হাতছাড়া করা একান্তই অনুচিত! 



#Television series #Eric Kripke # Garth Ennis #Action Thriller #ওয়েব সিরিজ #টিভি সিরিজ #Amazon Prime #সুচরিতা বসু #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

29

Unique Visitors

219143