মেয়েদের ‘না’ কিছুতেই শুনব না আমরা?
রাজ্য জুড়ে মেয়েদের রাত দখলের দ্বিতীয় দফার দিনেই বেলঘরিয়ার প্রফুল্লনগর এলাকায় ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনা। চোদ্দ বছরের এক কিশোরীকে উপর্যুপরি কোপ মারল এক তরুণ, থামাতে গিয়ে আহত হতে হল মেয়েটির মা-কেও। স্থানীয় মানুষজনের হাতে বেদম মার খাবার পরে ছেলেটি আপাতত জেল হেফাজতে, মেয়েটি হাসপাতালে ভর্তি।
শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, মেয়েটির প্রাণের আশঙ্কা নেই। সে জন্যেই হয়তো এই খবরটি অচিরেই ধামাচাপা পড়ে যাবে, এর জন্য মিছিল, অবস্থান বিক্ষোভ বা রাত দখল করবার কথা তুললে লোকে পাত্তাই দেবে না। কিন্তু তিলোত্তমা কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যজুড়ে পুরোদমে প্রতিবাদ চলার সময়েই এই ধরনের একটি ঘটনা মনে আরো বেশি করে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। ভাবুন তো, ক্লাস নাইনে পড়া একটি মেয়ে, যার কাছে জীবনের রূপ রস গন্ধ অধিকাংশই এখনও অজানা, তাকে মুখে ব্যান্ডেজ নিয়ে হাসপাতালে শুয়ে থাকতে হচ্ছে কারণ সে অবাঞ্ছিত মানুষের বক্ষলগ্না হতে চায়নি, তার অশ্লীল আচরণের প্রতিবাদ করবার ‘বেয়াদবি’ দেখিয়েছিল।
অনেকেই হয়তো এত অবধি শুনে চট করে বলে বসবেন, ‘সত্যি খুব খারাপ ব্যাপার, কিন্তু আমাদের বাড়ির ছেলে এরকম নয়। এমন কাজ করবার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।‘ ‘উড়তা পঞ্জাব’ ছবিতে করিনা কপূর তো বলেইছেন, ভারতীয় অভিভাবকের সবচেয়ে প্রিয় সংলাপের একটি হল, ‘ওর ছেলে খারাপ, আমারটা কিন্তু ভালো।‘ অথচ ‘নট অল মেন’ মার্কা চেনা সাফাইয়ের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে একবার ভাবুন তো, আমরা সবাই কি বেড়ে ওঠবার সময় কোনও না কোনও সময় মেয়েদের ‘না’ শুনতে না চাওয়ার এই ক্ষতিকর সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসিনি? শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরিণীতা’ উপন্যাসের নায়ক(?) শেখরকে এখন রীতিমত আত্মম্ভরী মনে হয়, ললিতার প্রতি তার আচরণ মাঝেমধ্যে যথেষ্ট অসংবেদনশীল এবং আপত্তিকর। পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পের শেষে রয়েছে এক বিতর্কিত উক্তি, ‘দূর বোকা, মেয়েদের ‘যাঃ’ মানেই ‘হ্যাঁ’’। ঠিক কতগুলো হিন্দি বাংলা ছবিতে আমরা দেখেছি নায়িকার অপছন্দ পাত্তা না দিয়ে নেচেগেয়ে তার মন ভোলার চেষ্টা করছে নায়ক? নায়িকা বিরক্ত হচ্ছে, তবু তার বিন্দুমাত্র ভ্রক্ষেপ নেই। আমির খান-মাধুরী দীক্ষিতের ‘দিল’, সলমন খান-কাজলের ‘প্যায়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’, অজয় দেবগণ-সোনালি বেন্দ্রের ‘মেজর সাব’, জিৎ-কোয়েলের ‘হিরো’- লিস্ট দাঁড়াবে বিরাট লম্বা। শাহরুখ খানকে গড়পড়তা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বিকল্প হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন অনেকে, সত্যিই বলিউডের অন্যান্য তারকাদের তুলনায় তাঁর ছবিতে মহিলা শিল্পীদের বেশি জায়গা দেওয়া হয়। কিন্তু কি করে ভুলে যাই, শাহরুখের ‘জোশ’ ছবিতে তাঁর বোনের ভূমিকায় ঐশ্বর্য রাইয়ের গলায় সেই বিখ্যাত গানের কথা, ‘ইয়ে উসকা স্টাইল হোয়েঙ্গা, হোঁটো পে না দিল পে হাঁ হোয়েঙ্গা’। অর্থাৎ একটি মেয়ে নিজেই জোর দিয়ে বলছে, মেয়েদের ‘না’ আসলে ‘হ্যাঁ’। কী বিপজ্জনক!
অস্বীকার করে লাভ নেই, অল্পবয়সে এ ধরনের জিনিসপত্র আমরা সবাই দেখেছি। কেউ সেই শিক্ষা অগ্রাহ্য করে বিবেকের কথা শুনেছে, আবার কেউ বাজারচলতি সংস্কৃতির কথাকেই বেদবাক্য বলে ধরে নিয়েছে। মেয়েদের না মানে না, এ নিয়ে ‘পিঙ্ক’ নামের আস্ত একখানা সিনেমা তৈরি হয়ে গেলেও সামগ্রিক মানসিকতা বদলেছে কতটুকু? তাই আমাদের মাথায় রাখতে হবে, সমস্যার মূল আসলে অনেক গভীরে। আমাদের শুরু করতে হবে একেবারে নিজেদের বাড়ি থেকে, অল্প বয়স থেকেই বাচ্চাদের মন থেকে উপড়ে ফেলতে হবে পুরুষতন্ত্রের বিষ। তাড়াহুড়ো করলে অথবা মেজাজ হারালে চলবে না, বোঝাতে হবে ধীরেসুস্থে। প্রতি মুহূর্তে এই নিঃশব্দ লড়াই জারি না রাখতে পারলে কিন্তু সমস্ত মানব-বন্ধন, মৌন মিছিল ও রাত দখল শেষ অবধি মূল্যহীন হয়ে পড়বে।
.............
#gender politics #gender discrimination #silly পয়েন্ট