বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

জল শোধনের আলো

চিরন্তন সিংহ Jan 4, 2024 at 6:21 pm বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

চলতে ফিরতে আমাদের হাতে-পায়ে ধুলো বা ময়লা লাগলে আমরা সাধারণত জল দিয়েই তা ধুয়ে ফেলি। যে কোন বস্তুকে প্রাথমিকভাবে পরিষ্কার করার জন্য জলই আমাদের প্রথম এবং প্রধান পছন্দ। কারণ এখনো অবধি জল আমাদের চারপাশে সহজেই বিনামূল্যে পাওয়া যায়, জল ব্যবহার করা নিরাপদ এবং জল যথেষ্ট কার্যকরীভাবে ময়লা দূর করতে সক্ষম।

কিন্তু যখন এই জলকেই পরিষ্কার করার প্রশ্ন আসে, তখন? শুধুমাত্র ছেঁকে নেওয়া বা ফিল্টার্ড জল যে যথেষ্ট পরিষ্কার নয় তা আজ আমরা সকলেই জানি। কারণ এতে তুলনামূলকভাবে আকারে বড়ো (ম্যাক্রোস্কোপিক) অশুদ্ধি আলাদা করা গেলেও তুলনামূলকভাবে আকারে ছোট বা আনুবীক্ষণিক (মাইক্রোস্কোপিক) অশুদ্ধি অর্থাৎ ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়া-জাতীয় জীবাণু নির্মূল করা সম্ভব নয়। কিছু রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে জীবাণুনাশ করা গেলেও পানীয় জলের জন্য তা সবসময় গ্রহণযোগ্য নয় কারণ এতে জলের স্বাদ-গন্ধ পরিবর্তিত হয় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে। তাই তথাকথিত পরিষ্কার বা স্বচ্ছ জল আর বিশুদ্ধ বা পানযোগ্য জলের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাহলে এই আনুবীক্ষণিক জীবাণুমুক্ত করে জলের শোধন কিভাবে সম্ভব? 

এ ক্ষেত্রেই এক বিশেষ ধরণের আলো অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে যা অতিবেগুনী আলো বা অতিবেগুনী রশ্মি (আল্ট্রাভায়োলেট রে) হিসাবে পরিচিত। সংক্ষেপে এই রশ্মিকে ইউভি রশ্মি বা ইউভি রে-ও বলা হয়ে থাকে। এই অতিবেগুনী রশ্মির নাম কম-বেশি আমরা সবাই শুনেছি। তবে যেহেতু এই রশ্মির ক্ষতিকারক দিকটাই অনেক বেশি আলোচিত এবং প্রতিষ্ঠিত তাই বাঙালির অতি প্রিয় ছবি ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এর চরিত্র মগনলাল মেঘরাজের কথা ধার করে বলাই যায়, ‘নাম বলছেন কেনো? বদনাম বলুন!’ কিন্তু জগতের আর সব জিনিসের মতো এই অতিবেগুনী রশ্মি বা ইউভি রশ্মিরও কিছু ভালো ব্যবহার সম্ভব। সম্প্রতি কোভিড অতিমারীর কঠিন সময়ে আমরা দেখেছি জীবাণুমুক্ত করতে বা স্যানিটাইজেশনে ইউভি রশ্মি ব্যবহৃত হয়েছে। শুধুমাত্র জল, খাদ্যদ্রব্য বা বস্তুর উপরিতলকে জীবাণুমুক্ত করা ছাড়াও চিকিৎসাক্ষেত্রে, কৃষিকাজে, সামরিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রে, ফরেন্সিক তদন্তে এবং প্রসাধন ও বিনোদনসহ দৈনন্দিন নানা কাজে আজকাল ইউভি রশ্মির ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

দৃশ্যমান আলোর মতোই ইউভি রশ্মিও তড়িৎ-চুম্বকীয় বর্ণালী বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্পেক্ট্রারই একটি অংশবিশেষ। এই জাতীয় রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর বেগুনী রঙের আলোর চেয়েও কিছুটা ছোট তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মস্তিষ্ক তা বিশ্লেষণ করতে পারে না। ‘অতিবেগুনী’ নামটাও এই কারণেই এসেছে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুযায়ী ইউভি রশ্মিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এই প্রত্যেক ভাগের ব্যবহার আলাদা এবং সুনির্দিষ্ট। ৪০০ ন্যানোমিটার (এক ন্যানোমিটার মানে হল ১০-৯ মিটার) থেকে ৩১৫ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মিকে বলা হয় ইউভি-এ (UV-A) রশ্মি। ইউভি রশ্মির মধ্যে এই জাতীয় রশ্মি সবচেয়ে কম ক্ষতিকর এবং মূলত সদ্যোজাত শিশুদের চিকিৎসা, আধুনিক দন্তচিকিৎসা, আঙুলের ছাপ ও জাল নোট সনাক্তকরণ, নখের সৌন্দর্যায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই রশ্মি ব্যবহৃত হয়। ৩১৫ ন্যানোমিটার থেকে ২৮০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মি ইউভি-বি (UV-B) রশ্মির অন্তর্গত। প্রধানত কৃষিক্ষেত্রে গাছের বৃদ্ধিতে ও রোগ নিরাময়ে এই জাতীয় রশ্মি ব্যবহৃত হয়। ২৮০ ন্যানোমিটারের চেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মি ইউভি-সি (UV-C) রশ্মি হিসাবে পরিচিত। তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর এই ইউভি-সি রশ্মিই জীবাণুনাশ করতে সক্ষম এবং জল বা খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি বিশুদ্ধিকরণের কাজে ব্যবহৃত হয়। ইউভি-সি রশ্মির উচ্চশক্তিসম্পন্ন তরঙ্গ জীবাণুর কোশের নিউক্লিক অ্যাসিডকে ধ্বংস করে তাদের বিনাশ করে। 

এখন প্রশ্ন হল জীবাণুনাশক এই ইউভি-সি রশ্মি পাওয়া যায় কী করে? সূর্যরশ্মিতে যদিও প্রাকৃতিক ভাবে যথেষ্ট ইউভি-সি রশ্মি থাকে তবে তার কিছুই পৃথিবীপৃষ্ঠে এসে পৌঁছয় না, বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তরে শোষিত হয়ে যায়। ইউভি রশ্মির প্রচলিত কৃত্রিম উৎসগুলির ক্ষেত্রে সাধারণত কোনও প্রতিপ্রভ পদার্থ ব্যবহার করে (যেমন ফ্লুয়োরোসেন্ট ল্যাম্প), অথবা পরিচিত বৈদ্যুতিক বাতির গায়ে দৃশ্যমান আলো শোষণকারী পদার্থের আবরণ ব্যবহার করে (ব্ল্যাক ল্যাম্প) অথবা পারদ বাষ্প, জেনন গ্যাস বা ডয়টেরিয়াম গ্যাসজাতীয় কিছু বিশেষ পদার্থের মধ্যে কম চাপে তড়িৎমোক্ষণ ঘটিয়ে (এটা করা যায় গ্যাস ডিসচার্জ ল্যাম্পের সাহায্যে) ইউভি রশ্মি উংপন্ন করা হয় তবে তাতেও জীবাণুনাশক ইউভি-সি রশ্মির পরিমাণ খুব বেশি থাকে না। জীবাণুনাশে প্রচলিত ইউভি রশ্মির উৎসের কার্যকারিতা খুব বেশি হলে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মাত্র। এছাড়াও ইউভি লেসার এবং ইউভি এলইডি (LED-এর পুরো কথা ‘লাইট এমিটিং ডায়োড’। এ এক ধরনের বিশেষ ইলেকট্রনিক বস্তু যা থেকে আলো নির্গত হয়) উৎস থেকে ইউভি রশ্মি পাওয়া যায় কিন্তু তার কার্যকারিতাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। 

বর্তমানে জল শোধনের জন্য প্রচলিত পারদ বাষ্পনির্ভর বাতিই সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এগুলি সাধারণত ভারী এবং আকারে বড়, যে জন্য এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় সহজে নিয়ে যাওয়া যায় না। তাছাড়া এগুলোর ক্রয়মূল্য বেশি এবং বিদ্যুৎ খরচ বেশি হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে ব্যবহার করা কষ্টকর। আমাদের এমন এক ইউভি উৎসের প্রয়োজন যা সহজলভ্য, সস্তা, সাশ্রয়ী, ব্যবহার করা সহজ এবং সর্বোপরি যার সাহায্যে কার্যকরীভাবে জীবাণুনাশ করা সম্ভব। পানীয় জল জীবাণুমুক্ত করার ক্ষেত্রে আরও একটা জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে একবার জীবাণুমুক্ত করার পর যত সময় যায় জীবাণু কিন্তু ধীরে-ধীরে পুনরায় সক্রিয় হতে শুরু করে। তাই জল পান করার আগে তাৎক্ষণিক জীবাণুমুক্তকরণ সবচেয়ে কার্যকরী। আর এইজন্যই আকারে ছোট এবং অনায়াসে পরিবহনযোগ্য ইউভি উৎসের প্রয়োজন। 

এই সমস্ত চাহিদা একসঙ্গে পূরণ করতে পারে একমাত্র এলইডি উৎস। বর্তমানে দৃশ্যমান আলোর ক্ষেত্রে এলইডি উৎসের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রচলিত উৎসগুলি এলইডি উৎস দিয়ে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। নীল আলোর এলইডি উৎস আবিষ্কারের জন্য ২০১৪ সালেই নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন জাপানী বিজ্ঞানী শুজি নাকামুরা (Shuji Nakamura)। বিগত দশকেই ইউভি রশ্মির এলইডি উৎসও আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বানিজ্যিকভাবে বাজারে পাওয়াও যাচ্ছে সে সব। কিন্তু তা সত্বেও জলশোধনে ইউভি এলইডি উৎসের ব্যবহার সেভাবে বাড়েনি। ইউভি-এ বা ইউভি-বি রশ্মির ক্ষেত্রে যদিও বা এলইডি উৎসের ব্যবহার কিছুটা হলেও দেখা যায় জীবাণুনাশক ইউভি-সি রশ্মির ক্ষেত্রে তা একেবারেই নগন্য। 

বাজারে উপলব্ধ ইউভি এলইডি উৎসের দাম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ইউভি-এ রশ্মির এলইডি উৎসের দাম তুলনামূলক কম হলেও ইউভি-বি বা ইউভি-সি-এর ক্ষেত্রে তা অনেকটাই বেশি। ইউভি রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কমে তার এলইডি উৎসের দাম ততই বাড়তে থাকে। সাধারণভাবে ইউভি-এ এলইডি সম্বলিত বাতি ২০ থেকে ২৫ মার্কিন ডলারে পাওয়া গেলেও জীবাণুনাশক ইউভি-সি এলইডি সম্বলিত বাতির দাম ২০০০ মার্কিন ডলারের বেশি। তাছাড়া কার্যকরীভাবে জল শোধনের জন্য একাধিক এলইডি একসঙ্গে ব্যবহার করা প্রয়োজন। এই কারণেই চাহিদা এবং উপযোগিতা থাকা সত্বেও জল শোধনে ইউভি এলইডির ব্যবহার এখনও সীমিত। 

দামের ক্ষেত্রে কেন এই বৈষম্য তা জানতে গেলে আমাদের আরেকটু গভীরে অনুসন্ধান করতে হবে। ইউভি-সি রশ্মি পেতে গেলে যে এলইডি দরকার তা প্রস্তুত করতে যে পদার্থ ব্যবহার হয় সেটা হল অ্যালুমিনিয়াম নাইট্রাইড এবং গ্যালিয়াম নাইট্রাইডের একটি অর্ধপরিবাহী সংকর। একে সংক্ষেপে ‘অ্যালগ্যান’-ও (AlGaN) বলা হয়। এইজাতীয় পদার্থ সাধারণত একটি ভিত্তি বা সাবস্ট্রেটের ওপর স্তরে-স্তরে গঠন করা হয়। এখন সাবস্ট্রেট হিসাবে যে পদার্থ (সাধারণত স্যাফায়ার) ব্যবহার করা হয় তার কেলাসের সঙ্গে ওপরে গঠিত হওয়া পদার্থের কেলাসের পার্থক্য (মিসম্যাচ) যদি বেশি হয় তাহলে কিছু গঠনগত ত্রুটি (ডিফেক্ট) তৈরি হয়। এই ত্রুটির জন্য ইউভি রশ্মি উৎপাদনের কার্যকারিতা কমে যায়। এই ত্রুটি বা ডিফেক্ট কমানোর জন্য সাবস্ট্রেট হিসাবে অন্য পদার্থ ব্যবহার করলে বা সাবস্ট্রেটকে পরিমার্জন করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই এলইডি উৎসের দাম বেড়ে যায়।

তবে আশার কথা এই যে বিজ্ঞানীরা এই সমস্যার সমাধানে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছেন। বাণিজিকভাবে এখনও জল শোধনে ইউভি এলইডির ব্যবহার প্রচলিত না হলেও আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে তা সম্ভব হবে। তখন হয়তো প্রতিটি পানীয় জলের কলে বা পানীয় জলের বোতলে ইউভি এলইডি উৎস ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক জীবাণুনাশ করা সম্ভব হবে। আর সেটা ঘটলে আগামী দিনে প্রতিটা শিশু নিরাপদে বিশুদ্ধ জল পান করে রোগমুক্ত জীবনযাপন করতে পারবে এই আশা আমরা করতেই পারি। 

...................

#UV treatment #Water Purification #silly পয়েন্ট #science

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

22

Unique Visitors

215890