বিন্যা
অন্ধকারে থেকে থেকে জোনাকিরা ঝিকমিক করে। সেই রাতের কত স্বর -- রাতপাখির তওঁক-তওঁক, একটা বার্কিং ডিয়ারের ডাক, সজারুর নড়াচড়া, জানলার শার্সির গায়ে মথের মৃদু ফ্লিপ-ফ্লপ শব্দ। উপত্যকার ওদিকের পাহাড়ে ছোট ছোট আলো জ্বলা গ্রাম --- কেরোসিন বাতির নিভু-নিভু আগুন অন্ধকারে দোল খাচ্ছে।
‘কী নাম তোমার?’, পাইনবনের পথে আমাদের আবারও দেখা হওয়ায় আমি জিজ্ঞেস করি।
‘বিন্যা’, সে বলে। ‘আর তোমার?’
‘আমার নাম নেই।’
‘আচ্ছা বেশ, শ্রীমান নাম-নেই।’
‘না না, মানে আমার তো এখনও নামডাক হয়নি। নিজেদের চেষ্টাতেই নাম করা উচিত আমাদের, বলো?’
‘আমার নাম বিন্যা। আর কোনও নাম চাইও না আমার। কোথায় যাচ্ছ?’
‘কোথাও না।’
‘বাহ! শ্রীমান নাম-নেই কোথাও না-তে যাচ্ছেন। তাহলে আমার সঙ্গে যাওয়া হবে না তোমার, কারণ আমি যাচ্ছি বাড়ি, আর তুমি আমার পিছু নিলে আমার দিদা তোমার পিছনে গ্রামের কুকুরগুলোকে ছেড়ে দেবে।’ এই বলে, সে হেসে, দৌড়ে নেমে যায় ঝোরার পথে। সে জানে, আমি পেরে উঠব না ছুটে।
গ্রীষ্মের বৃষ্টিধারা তার মুখ বেয়ে নেমে আসে, যত সে ওঠে পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে, সাদা গরুটাকে বাড়ির পথে ডাকতে ডাকতে। বাতাসিয়া এই পাহাড়ঢালে তাকে ছোট্ট লাগে ভারী; কপালে লেপ্টে থাকে চুলের সরু গাছি, আর ছেঁড়া নীল শাড়িটা জড়িয়ে থাকে ভরাট, নিটোল উরুতে। একটা ছাতা নিয়ে তার কাছে যাই আমি, আড়াল দিতে। ছাতার নিচে সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, আমি এক হাতে তাকে জড়িয়ে নিলে জড়াতে দেয়। তারপর মুখ তুলে তাকায় আমার মুখে, যেন কিছুটা অবাক। চকিতে আমি ওর ঠোঁটে নরম চুমো খাই; বৃষ্টিফোঁটা আর মিন্টের স্বাদমাখা সে ঠোঁট। তারপর সাহসভরে এই ঝমঝম বৃষ্টিতে সে আমায় ছেড়ে এগিয়ে যায়। হাসতে হাসতে বাড়ির পথে ছোটে। তবে এমন বৃষ্টিভেজা বৃথা যায় না।
আরেকদিন শুনলাম, সে ডাকছে আমায়, ‘নাম-নেই, ও শ্রীমান নাম-নেই!’ -- কিন্তু কাছেপিঠে দেখলাম না। বেশ কিছু পরে খুঁজে পেলাম তাকে, একটা চেরিগাছের প্রায় অর্ধেকটা অবধি উঠেছে, শক্ত করে পা রেখেছে বাকলে, ফরসা, নিটোল দুই উরুর মাঝে শাড়িটা গুটিয়ে রাখা, পা দুটি দৃঢ় আর সবল।
‘চেরিগুলো তো পাকেনি এখনও’, বললাম।
‘ও কোনোদিন পাকেও না। আমার এরকম সবুজ, টক-টক খেতেই বেশ লাগে। আসবে এখানে?’
‘দেখি, যদি এখনও গাছে চড়তে ভুলে না গিয়ে থাকি...’, বললাম।
‘আমার দিদা তো ষাট পেরোল, সে এখনও দিব্যি চড়তে পারে।’
‘সে ষাট বছরে গিয়ে আরেকটু অ্যাডভেঞ্চারাস্ হতে আমারও বাধবে না। তখন তো আর বেশি কিছু হারানোর থাকে না!’ খুব বেশি একটা কসরৎ না করেই অবশ্য গাছে উঠতে পারলাম, তবে উপরের সরু ডাল আমার ভার নিতে পারবে না বুঝে নিচের মূল শাখাতেই দাঁড়ালাম, আমার মুখ বিন্যার স্তনের সমান্তরালে। ওর কোমরে হাত রেখে বাহুর ভিতরের দিকের নরম অঞ্চলে চুমো খাই আমি, ও বলে না কিছু। বরং আমার হাত ধরে আমাকে আরও কিছুটা উঠে আসতে সাহায্য করে, আমি এক হাতে জড়িয়ে নিই ওকে, যতটা নিজের ভারসাম্য রাখতে, ততটাই ওর কাছে যাওয়ার ইচ্ছেয়।
পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, জানলার কাছে দীর্ঘ ওক গাছের মাথাগুলি জোছনায় ভেসে যায়। এই রাতের কতরকম স্বর, ঝিঁঝিঁর ডাক, রাতপাখির তওঁক তওঁক, আর তোমার গ্রাম থেকে ভেসে আসা ঢোল আর গানের শব্দ এই উপত্যকা দিয়ে বয়ে যায়। আজ তো উৎসবের দিন, তোমার বাড়িতেও উৎসব। তুমিও কি গাইছ, আজ রাতে? আচ্ছা, গাইতে গাইতে, হাসতে হাসতে, বন্ধুদের সঙ্গে নাচতে নাচতে তোমার কি আমায় মনে পড়ছে? আমি এখানে একা বসে আছি, কাজেই তোমাকে ছাড়া আর আমার কাউকেই ভাববার নেই।
বিন্যা... আমি বারবার তোমার নাম ধরে ডাকি --- যেন এভাবে এই ডাক তোমার কাছে ঠিক পৌঁছবে, তুমি আসবে আমার কাছে, ওই জোছনা-মোড়া পাহাড় পেরিয়ে...
বিদেহীরা ছড়িয়ে আছে এই রাতে। গাছে গাছে নিঃশব্দে ঘুরছে তারা; আমি যে জানলার মুখে বসি, তার আশপাশে তারা এসেছে; বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ির চারপাশে বয়ে যাচ্ছে সেই সব অশরীরী। গাছের প্রেত, পুরোনো বাড়ির প্রেত। এখানে গত বছর এক বুড়ি মারা যায়। প্রায় ত্রিশ বছর ছিল এই বাড়িতে; এখনও তার অস্তিত্বের কিছুটা এখানে রয়ে গেছে, আমি নিশ্চিত। তার পুরোনো লম্বাটে আয়নাটায় যখন তাকাই, কখনও কখনও বুড়ির ফ্যাকাসে মুখ, লম্বা, সোনালি চুল যেন একঝলক দেখি। মনে হয়, সে আমায় পছন্দ করে, আর বাড়িটাও আমাকে মায়া করে যেন। বুড়ি কি তোমায় হিংসে করবে, বিন্যা?
সুর আর গানের তেজ বাড়তে থাকে। আগুনের পাশে তোমার উজ্জ্বল মুখ আমি মনে মনে আঁকি। হাসিতে তোমার চোখ ঝিলমিলিয়ে ওঠে। তোমার চারিদিকে কত, কত মানুষের ভিড়, আর আমার শুধু ওই আকাশের তারারা, রাতপাখি, আর আয়নার এই প্রেত।
ঘুম ভেঙে যায় ভোর ভোর, ঘাসে তখনও শিশির সতেজ। পাহাড় থেকে সেই ঝোরার পথে নেমে যাই আমি, তারপর একটা ছোট্ট টিলায় উঠি যেখানে একটা পাইন গাছ বেড়ে উঠেছে নিঃসঙ্গ সৌন্দর্যে। তার তন্বী শাখাপ্রশাখায় হু হু বাতাস লাগে। আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা এটা, কী যে শক্তি আছে এখানে! সময়ে সময়ে নিজেকে নতুন করে পেতে ফিরে আসি। ঘাসে শুয়ে থাকি, স্বপ্নালু হয়ে। নীল আকাশ আমার মাথার ওপর ঘূর্ণি তোলে, ঈগল ওড়ে দূরে। নিচের ওই গাছগুলোর মধ্যে থেকে বিন্যার গলা আমি শুনি; বা মনে হয়, যেন শুনলাম। কিন্তু দেখতে এগিয়ে যাই যখন, আর খুঁজে পাই না।
নিজের যুক্তিবাদী মন নিয়ে আমার বরাবরের গর্ব; নিজেকে শিখিয়েছিলাম ‘প্রেমে পড়া’র মতো আবেগ-টাবেগ থেকে সাবধানী দূরত্বে থাকতে, কারণ এই সবই ক্ষণিকের মোহ। এবং যদিও আমি নিজেকে পইপই করে বলে চলি, আমার এবং বিন্যার দুজনেরই একে অপরের প্রতি যে আকর্ষণ, তা সম্পূর্ণ শারীরবৃত্তীয়, নিজের কাছে অস্বীকার করে লাভ নেই, বিন্যার প্রতি আমার অনুভূতি বাকিদের থেকে বেশ কিছুটা আলাদাই; এবং যৌনসঙ্গম একদিকে আমার কাছে যেমন এক উদ্যাপন, তেমনই তা আর সকল উদ্যাপনের মতোই শেষ হয় তৃপ্তিতে, বৈচিত্র্যের চাহিদায়, ভুলে যাওয়ার বাসনায়...
বিন্যা এই সবকিছুর চাইতে আলাদা --- কিছুটা আরণ্য, স্বপ্নিল, পরীবৎ। প্রেতের আনাগোনা যেই পাথরে, সেই পাথরের কাছ থেকে, বুড়ো গাছেদের থেকে, তরুণ ঘাসের থেকে বিন্যা ছেঁচে নেয় এক আদিম সারল্য, সময় ও ঘটনার প্রবহমানতার প্রতি এক ঔদাসীন্য, পাহাড় ও জঙ্গলের জন্য এক টান --- আর এইই তাকে আর সবার চাইতে আলাদা, মোহময় করে তোলে।
কাজেই, যখন তিন, চার, পাঁচদিন কেটে যায়, তাকে খুঁজে পাই না পাহাড়ের ঢালে, হতাশ প্রেমের সমস্ত ব্যথায় জর্জরিত হই আমি। আমাকে কি ও ভুলে গেছে, চলে গেছে অন্য কোথাও? কেউ কি আমাদের একসঙ্গে দেখে ফেলেছিল, তাই ওকে বাড়িতে আটকে রেখেছে? ওর কি শরীর খারাপ? নাকি আর নেইই...?
কোথাও গিয়ে যে তার কথা জিজ্ঞেস করব, উপায় নেই। হয়তো গ্রাম থেকেই বার করে দেবে আমায়। উল্টোদিকের পাহাড়ে ওদের গ্রাম, শ্লেট-রঙের চাল দেওয়া বাড়ির দঙ্গল, পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ধাপে উঠে যাওয়া জমি। এখান থেকে সেই মাঠে চলেফিরে বেড়ানো শরীরগুলো দেখতেও পাই, কিন্তু সে বহু দূর, এত ছোটো যে খালি চোখে চিনতে পারব না কাউকেই। এখান থেকে প্রায় একশো মাইল দূরে তার মায়ের গ্রামে বিন্যা গেছে, একটি ছোট ছেলে আমায় জানায়।
অতএব, গভীর চিন্তায়, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি হেঁটে চলি ওক-বনের মধ্য দিয়ে, কোনও পাখির ডাকই আর কান অবধি এসে পৌঁছয় না --- মিষ্টি শিস দেওয়া সেই থ্রাশ, তীক্ষ্ণকন্ঠী বার্বেট, বা ঘুঘুর মৃদুস্বর। আনন্দ আমায় প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করে। কিন্তু দুঃখে আমার সব চিন্তাই অন্তর্মুখী। আমার চিন্তায় ঘুরপাক খায় সময়ের আর পরিস্থিতির এই ছলচাতুরি; মনে হয় বছরের পর বছর বয়ে যাচ্ছে, এভাবেই বয়ে গেছে, যেন ভাঁটার টানে ফিরে যাওয়া ঢেউ; শুধু নিঃসঙ্গ তটে রেখে গেছে আমায়, ভেসে আসা কোনও ধ্বংসাবশেষের মতো। কিন্তু সেই সময়েই, শিস দেওয়া সেই থ্রাশ যেন আমায় উপহাস করে, গিরিখাতের ছায়া থেকে প্রতারকের মতো বলে ওঠে, ‘সময় কিন্তু বয়ে যাচ্ছে না, আসলে বয়ে যাচ্ছি আমি আর তুমি, বইছি আমরা...’
শেষে জোর করে নিজেকে টেনে বের করে আনি বিষাদ থেকে। সেই পাহাড়ের ঢাল, অরণ্য থেকে দূরে থাকি। সেই গ্রামের দিকে তাকাই না। নিজের কাজে মাথা গুঁজে ফেলি, ভাবনায় অনুভূতি রাখি না আর। এর মধ্যে নিবন্ধ লিখেছি একটা, ‘কলসির লোহাগম্বুজের লিপি’; খুবই বিদগ্ধ, খুবই শুষ্ক, খুবই বিচক্ষণ।
কিন্তু রাতে আমায় ছিন্নভিন্ন করে যায় বিন্যার চিন্তা। ঘুম আসে না। আলো জ্বালাই, দেখি, এতদিনকার সেই বুড়িকে সরিয়ে দিয়ে আয়নার মধ্য থেকে বিন্যা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, হাসছে।
[ কভার : www.pinterest.com]
#বাংলা #অনুবাদ #রাস্কিন বন্ড #শুভঙ্কর ঘোষ রায়চৌধুরী #Binya #Friends in Small Places