ব্যক্তিত্ব

বিজ্ঞানে শিল্প, শিল্পে বিজ্ঞান খুঁজে পেয়েছিলেন ভিঞ্চি

অলর্ক বড়াল Sep 16, 2023 at 8:18 pm ব্যক্তিত্ব

সর্বকালের সেরা চিত্রকরদের একজন – সাধারণ জনমানসে এটাই তাঁর পরিচিতি হলেও আদতে তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়ন করতে বসলে অভিধানের বিশেষণ কম পড়ে যায়। তিনি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। একাধারে চিত্রকর, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী, ভাস্কর, স্থপতি ও সঙ্গীতজ্ঞ এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষটি যেমন তাঁর কর্মনৈপুণ্যে পরবর্তী প্রজন্মকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তেমনই শারীরবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, মানচিত্র, জীবাশ্মবিদ্যার মত বিষয়ে যুগান্তকারী চর্চার দিক খুলে দিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত ‘নোটবুক’-র মাধ্যমে।

মানবতাবাদী আদর্শের এই প্রাণপুরুষ তাঁর বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে শিল্প ও বিজ্ঞানের মাঝের বিভেদের রেখাটিকে প্রায় অস্পষ্ট করে দিতে পেরেছিলেন। বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগে তিনি তাঁর শিল্পীসত্তার বিকাশ ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর কাছে বিজ্ঞান ও শিল্প ছিল যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ। তাঁর সমকালের অন্যান্যরা যখন অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে কর্মসম্পাদনে বিশ্বাসী ছিলেন, তখন লিওনার্দো প্রতি পদে নতুন নতুন পরীক্ষানিরীক্ষায় নিয়োজিত।


সালটা ১৪৩০। লিওনার্দো মানবমস্তিস্কের দুটি ছবি আঁকলেন। একটি উল্লম্বছেদে অন্যটি অনুভূমিকভাবে। দুটিতেই উল্লম্ব ও অনুভূমিক রেখাঙ্কন এসে মিলিত হয় যে স্থানে সেটিকে তাঁর সমকালে মস্তিস্কের sensus communis বা ‘কমন সেন্স’-র স্থান বলে মনে করা হত। তাঁর মানবদেহের অন্তর্ভাগের চর্চা ও তাঁর চিত্রকলা একে অপরকে যারপরনাই পুষ্ট করেছিল। 

রেনেসাঁ যুগের অগ্রভাগে জন্মানো দ্য ভিঞ্চি বড় হয়েছিলেন মানবতাবাদের ধ্যানধারণায় যা মূলত গঠিত ছিল প্রাচীন গ্রিক-রোমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক-বৌদ্ধিক চর্চার ওপর। লিওনার্দো এই ধ্যানধারণাকে সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে পারেননি। ইচ্ছার অভাবে নয় বরং অশিক্ষার কারণেই, নিজের ভাষ্যমতে তিনি ছিলেন ‘sanza lettere’ অর্থাৎ নিরক্ষর। ল্যাটিন ভাষায় দক্ষতার অভাবের জন্য নিজের শিক্ষার জন্য তিনি এক অন্যরকম পথ বেছে নেন। অতীতকালের চর্চার মুখাপেক্ষী না হয়ে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা ও দৈনন্দিন পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করতে লাগলেন। ফলস্বরূপ তিনি মহাকর্ষীয় ধ্রুবক গণনার দ্বারা যেমন প্যারাসুট বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন পাশাপাশি ‘লাস্ট সাপার’ ও ‘মোনালিসা’-র মতন চিত্র আঁকতেও সমর্থ হয়েছিলেন। 

দ্য ভিঞ্চির চিত্রকলাকে অনেকসময়ই বাস্তববাদী আখ্যায়িত করা হয়। এই বৈশিষ্ট্যটি তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর ‘sfumato’ বা অদৃশ্যায়ন কৌশলের জোরে। এই পদ্ধতিতে হালকা ও গাঢ় রঙের মধ্যে এক অদৃশ্য রূপান্তর তৈরি করা হয় যাতে চিত্রগুলি ফটোগ্রাফের ন্যায় দর্শকের চোখে আবির্ভূত হয়। মানবদেহের নিখুঁত চিত্রোৎপাদনের জন্য চামড়ার নিচে থাকা পেশির সংযোগস্থলের পাশাপাশি হাড় ও অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও নিয়মিত অধ্যয়ন করতেন ভিঞ্চি।  উইন্ডসর ক্যাসেলের রয়্যাল কালেকশান ট্রাস্টের প্রিন্টস্‌ এবং ড্রয়িংস্‌ বিভাগের প্রধান মার্টিন ক্লেটন তাঁর “Leonardo da Vinci: The Mechanics of Man” বইতে লিখছেন যে, ভিঞ্চির প্রথমদিকের আঁকা মানবদেহের চিত্রগুলি ছিল ‘মনযোগহীন’, মানবশরীরের ‘কাঠামোগত, যান্ত্রিক পরিপূর্ণতা’কে স্বীকার করলেও মানবদেহের বিভিন্ন অংশের সংযোগের বিষয়ে দ্য ভিঞ্চির খুব একটা বিশদে ধারণা ছিল না। তিনি বলেছেন, “His status was that of a craftsman, and unsurprisingly he found human material for dissection hard to come by… Many of Leonardo’s early anatomical observations were thus based on a blend of received wisdom, animal dissection, and mere speculation.”

এ-অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, যখন ১৫০৭-০৮ সালের শীতকালে দ্য ভিঞ্চির সামনে তাঁর প্রথম ময়নাতদন্ত করার সুযোগ আসে। বছর ঘুরতেই সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় দশে। সারাজীবনে লিওনার্দো মোট তিরিশেরও বেশি মানবদেহের ময়নাতদন্ত করেছিলেন বলে জানা যায়। ময়নাতদন্তের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে দ্য ভিঞ্চির আঁকাগুলিও তাঁর ধ্রুপদী পুর্বসূরীদের চেয়ে আলাদা আঙ্গিক পেতে লাগল। গ্রিক-রোমানদের মানবদেহের আদর্শরূপ কল্পনার প্রক্রিয়ার থেকে দূরে সরে এসে ভিঞ্চির চিত্রগুলি মানবদেহের প্রকৃত রূপ তুলে ধরতে লাগল। এই দুই পরস্পরবিরোধী দর্শনের সংঘাতেই জন্ম হল দ্য ভিঞ্চির অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’-র। বিজ্ঞান ও শিল্পকলার এই অভাবনীয় যুগলবন্দী রোমান স্থপতি ভিট্রুভিয়াসের লেখা ‘De Architectura’ থেকে অনুপ্রাণিত। সেখানে তিনি বলছেন – 

“Just so the parts of Temples should correspond with each other, and with the whole. The navel is naturally placed in the centre of the human body, and, if in a man lying with his face upward, and his hands and feet extended, from his navel as the centre, a circle be described, it will touch his fingers and toes. It is not alone by a circle, that the human body is thus circumscribed, as may be seen by placing it within a square. For measuring from the feet to the crown of the head, and then across the arms fully extended, we find the latter measure equal to the former; so that lines at right angles to each other, enclosing the figure, will form a square.”

ভিট্রুভিয়াসের এই দিকনির্দেশনার ভিত্তিতে দ্য ভিঞ্চির পূর্বেও অনেক শিল্পী ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’-র ছবি আঁকলেও তা ঐ স্থপতি ত্রুটিপূর্ণ নির্দেশনার কারণে মানবসুলভ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু লিওনার্দো তাঁর মানবদেহের নিরলস চর্চার দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানকে মিশিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর শিল্পকর্মের সঙ্গে। ভিট্রুভিয়াসের বর্ণিত পথে নয় বরং তার বিপরীতে হেঁটে, প্রথমে মানবদেহের সঠিক শারীরবৃত্তীয় উপস্থাপন ও পরে বর্গাকৃতি ও বৃত্তটিকে এঁকেছিলেন লিওনার্দো।

আসলে যেসব গুণাবলী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে একজন যুগান্তকারী বিজ্ঞানী বানিয়েছিল সেই গুণগুলিই তাঁকে একজন যুগান্তকারী শিল্পীও করে তুলেছিল। তাই বোধহয় ইতিহাসবিদ জেমস্‌ অ্যাকারম্যান বলেছেন – 

“He was a protoscientist in the modern sense of what constitutes science, bringing to his investigation of the natural world not only an extraordinary artistic imagination, which led him to innumerable original discoveries, but a unique and idiosyncratic intellectual position that helped him to circumvent the mental blocks of his contemporaries.”  

...........................


#Leonardo da Vinci #Vitruvian Man #লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219123