বইয়ের খবর

বিষবৈদ্য : অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী পাঠকের জন্য দুরন্ত ‘ডিটক্স’

রোহন রায় Dec 27, 2022 at 7:24 am বইয়ের খবর

...................

বই : বিষবৈদ্য 

লেখক : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য 

প্রকাশনা : জয়ঢাক 

প্রচ্ছদ : ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য 

অলংকরণ :পার্থরঞ্জন দাশ

প্রথম প্রকাশ : এপ্রিল, ২০২২ 

মুদ্রিত মূল্য :  ৩৫০/- টাকা 


মিরাকিউরল নেই। কিন্থুরি গুল্ম আছে। অন্ধকিমূল চূর্ণ আছে। আছে অঙ্গসঞ্জীবনী সালসা। ফ্যান্টাসির গ্যাসবেলুনকে বটানির খোঁটায় বেঁধে রেখেছেন ত্রিলোক আথুরির শিষ্য বিষবৈদ্য সনাতন। সঙ্গে পুরাণ আর ইতিহাসের ককটেল। আনন্দমেলার পাতায় প্রথম যেদিন পড়েছিলাম, সেদিনই বুঝেছিলাম - এ নিছক ‘আগমন’ নয়, ‘আবির্ভাব’।

বাংলায় অ্যাডভেঞ্চার-সাহিত্যকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে চেয়ার ভাগ করে নিতে হয়েছে গোয়েন্দা-সাহিত্যের সঙ্গে। কাকাবাবু, জগুমামা, অনিলিখার মতো চরিত্রকে কোন গোত্রে ফেললে যথাযথ হবে, তাই নিয়ে ধন্দে পড়তে হয়। বিষবৈদ্যকে নিয়ে সেই ধন্দ নেই। অবশ্য ডিটেকশন এখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, তবে সেটা একটা নির্দিষ্ট ফিল্ডের মধ্যেই। একজন আয়ুর্বেদাচার্যকে প্রধান চরিত্র করে এবং প্লটের দিক থেকে গোটা সিরিজকে কেবল বিষাক্ত জীবের খুঁটিতে বেঁধে দিয়ে দেবজ্যোতিবাবু নিজেই নিজের মাঠটাকে ছোটো করে নিয়েছেন অনেকটা। সীমিত পরিধির মধ্যে প্লটের বৈচিত্র্য আনাই ছিল এই সিরিজের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। লেখকের নিজেরই নিজের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ এটা, কারণ ভূমিকায় দেবজ্যোতিবাবু নিজেই জানিয়েছেন, "এটা লেখকের স্ব-সৃষ্ট হ্যান্ডিক্যাপ।" এ যেন এভারেস্টে উঠতে গিয়ে অনেক সহজ সাউথ কলের পরিবর্তে বিপদসংকুল নর্থ কল বেছে নেওয়া। কিন্তু কেন এই স্বনির্বাচিত বাধক?


উত্তর পাওয়া যাবে কাহিনির কঙ্কাল-নির্মাণের দিকে মনোযোগী দৃষ্টি দিলে। আয়ুর্বেদ, আধুনিক বিজ্ঞান, কল্পবিজ্ঞান, ইতিহাস, পুরাণ, লোককথা, কিংবদন্তী - সবকিছুকে এভাবে এক ঘাটে জল খাওয়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। দেবজ্যোতিবাবু সেটাই করেছেন অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে। বন্ধুত্ব না হোক, অন্তত সফল আঁতাত ঘটাতে পেরেছেন। এরা কেউ কারও সীমানা লঙ্ঘন করেনি। এটাই এই সিরিজের সবচেয়ে জোরের জায়গা। বাংলা অ্যাডভেঞ্চার-সাহিত্যে অজস্র  থোর বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোরের মাঝে ইদানিংকালে হাতে-গোনা যে কয়েকটা মৌলিক ভাবনা দেখতে পাচ্ছি, তার মধ্যে একটা এই বিষবৈদ্য-সিরিজ। এই সিরিজের খানচারেক উপন্যাস, দোর্দোবুরুর বাক্স, নিবাত কবচ অভিযান, তক্ষক আর কৌন্ডিণ্যের ধনুক আমার আগে পড়া। অবশ্য এই বইয়ের দুটো বাদে বাকি সব গল্পই না-পড়া ছিল। বিষবৈদ্যের ছ-টা অগ্রন্থিত গল্প ও একটা নতুন উপন্যাসিকা নিয়ে জয়ঢাক থেকে প্রকাশ পেয়েছে এই বই। প্রথম গল্প বইয়ের নামগল্প এবং এই সিরিজের প্রথম গল্প। এছাড়া রয়েছে উড়ন্ত মৃত্যুর দেশে, কালীয়, উ থলেন, হরলালের ছোবল, জোর্মুখেন্দ্র আর সিংহিকা অভিযান। শেষেরটি উপন্যাসিকা। গত শতাব্দীর সাতটি দশক জুড়ে বিন্যস্ত হয়েছে সনাতনের কীর্তিকলাপ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখি, লেখক সময়ের চিহ্নগুলোকে আখ্যানের সাবটেক্সটে  বুনে রেখেছেন নিপুণভাবে। প্রতিটা কাহিনি প্লটের দিক থেকে অভিনব। প্লটহোল নেই। দুরন্ত গতিময় গদ্য। যে-কোনো সমস্যার সামনে বিষবৈদ্য সনাতন 'স্ট্রিট স্মার্ট'। ঝুলি থেকে মোক্ষম দাওয়াইটি তো বেরোবেই, কিন্তু তারও আগে বলতে হয় তাঁর তীক্ষ্ণ ধী-শক্তি, উপস্থিত বুদ্ধি আর বুকের পাটার কথা। ইতিহাস, পুরাণ আর অ্যাডভেঞ্চারের ব্লেন্ডিংয়ের দিক থেকে 'সিংহিকা অভিযান' সম্ভবত 'নিবাত কবচ অভিযান'-কেও ছাপিয়ে গেছে। খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার ফ্লেভারটাকে বিষবৈদ্যের কাহিনিগুলোয় অঙ্গীভূত করে দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানেও সনাতন স্বতন্ত্র। 'টল টেল'-এর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকে তাঁর কাহিনিরা। বিশ্বাস আর অবিশ্বাস, স্বীকার আর অস্বীকারের মাঝের এই ধূসর জায়গাটুকুকে এভাবে ব্যবহার করে নিতে পারা যে-সে লেখকের কাজ না। পরিশিষ্টে পাঠকদের সুবিধার জন্য যুক্ত হয়েছে বিষবৈদ্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, কর্মজীবন, অভিযানের সালতামামি ও ওষুধপত্রের তালিকা। ২২ টি ওষুধের তালিকাটি নিষ্ঠ পাঠকের চমৎকার লাগবে। 


সবচেয়ে বড়ো কথা, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পাঠক এখানে একটা ক্লাসিক ঝাঁঝ পাবেন। কাহিনির কাঠামো নিজগুণেই নন-আর্বান। খুব ভেবেচিন্তেই বলছি, খাঁটি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির কথা ধরলে, বিভূতিভূষণের স্বাদ যদি আজ কোনও সিরিজ ফিরিয়ে দিতে পারে, তবে তা বিষবৈদ্য। পোস্ট লিটারেট সমাজে (অর্থাৎ সে সমাজে মানুষজন বই পড়তে সক্ষম, কিন্তু পড়েন না) এই সময়ের যে-গুটিকয় বই মানুষের মধ্যে পড়ার অভ্যাস আবার ফিরিয়ে আনতে পারে, 'বিষবৈদ্য' নিঃসন্দেহে সেই তালিকায় শুরুর দিকেই থাকবে। গল্পগুলোয় চমৎকার সিনেম্যাটিক উপাদানও রয়েছে। ফিল্ম বা ওয়েব সিরিজের জন্য ভাবলে 'বিষবৈদ্য' দারুণ সফল ফ্র্যাঞ্চাইজি হতে পারে। কুৎসিত, পঙ্গু সব গালগল্পে বাংলার 'থ্রিলার' জঁরটি এখন আক্ষরিক অর্থেই পালাজ্বরে কাঁপছে। পাঠক, বিষবৈদ্য সনাতন আপনাকে দিতে পারেন শুশ্রূষার জলপট্টি। অন্ধকিমূল চূর্ণ দিয়ে সমস্ত টক্সিন ঝেড়ে মুহূর্তে আপনাকে চাঙ্গা করে দেবেন । গ্যারান্টি রইল। আসছে-বইমেলার জন্য লিস্টি বানাচ্ছেন তো? এখনই নোট করে নিন নামটা। মাত্র ৩৫০ টাকায় বিষ ঝাড়িয়ে নিন।  

..............................


 

#বিষবৈদ্য #দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য #বই রিভিউ #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

53

Unique Visitors

217960