ফেলুদাকে 'ম্যাড়মেড়ে জীব' বলেছিলেন উৎপল দত্ত
ফেলুদা ওরফে প্রদোষচন্দ্র মিত্র, পেশায় প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। ফেলুদাকে নিয়ে বাঙালির যে আবেগ, তাতে কে বলবে ইনি সত্যজিৎ রায়ের লেখা একটি কাল্পনিক চরিত্র। তাঁর চলন-বলন, ব্যক্তিত্ব, কপালের ভাঁজ, চারমিনার খাওয়ার ধরণ, মগজাস্ত্র খাটানোর পদ্ধতি—বাঙালি প্রাণপণে অনুকরণ করে ‘ফেলুদা’ হয়ে উঠতে চেয়েছে। মোট কথা, ফেলুদা মধ্যবিত্ত বাঙালির ইনটেলেকটের সেই আইকন, যাকে নিয়ে কোনো কটূকথা বাঙালি শুনতে চায় না। অথচ সিনেমার মগনলাল মেঘরাজ উৎপল দত্ত মনে করতেন যে ফেলুদা একজন ‘ম্যাড়মেড়ে জীব’। সিনেমায় না পারলেও বাস্তবে তিনি ফেলুদার নামকে ‘বোদনাম’ করলেন। সঙ্গে এও বললেন যে পর্দায় ফেলুদা তাঁর শত্রুকে বৌদ্ধিকভাবে চূর্ণ করতে অপারগ। কিন্তু বাংলা থিয়েটারের অন্যতম প্রাণপুরুষ, অভিনেতা-পরিচালক-প্রাবন্ধিক উৎপল দত্ত নেহাত অকারণে এরকম মন্তব্য করার মানুষ নন। তার উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে শ্রীদত্তের ‘টুওয়ার্ডস আ রেভেলিউশনারি থিয়েটার’ গ্রন্থটির দিকে।
উৎপল দত্তের জীবন ও থিয়েটার, উভয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে রাজনীতি। থিয়েটার তাঁর কাছে বিনোদন নয়, দিন বদলের হাতিয়ার। নিজেকে তিনি বলেন ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’। তাঁর নাটক ও প্রবন্ধগুলোর মধ্যে বামপন্থী রাজনৈতিক তত্ত্বের শ্রেণি (ক্লাস) বা শ্রেণিসংগ্রামের মতো শব্দ অনায়াসে মিশে যায়। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বিচার করার ক্ষেত্রে উৎপল দত্ত চরিত্রটির শ্রেণিগত পরিচয়কেও একটি মাপকাঠি হিসেবে ধরেছিলেন। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি এরকম মন্তব্য করেন।
ফেলুদা ও তোপসে দুজনেই কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তত্ত্বের ভাষায় বলা যায় ‘পেটি-বুর্জোয়া’। ফেলুদার আচার-আচরণ, পোশাক, জীবনযাত্রা, এমনকি মূল্যবোধের মধ্যে মধ্যবিত্ত বাঙালির সমস্ত গুণ মজুত রয়েছে। কিন্তু মগজাস্ত্রের বিচারে ফেলুদা অর্ডিনারি নয়, ‘এক্সট্রা-অর্ডিনারি’। আবার শৃঙ্খলা, অনুশীলন, স্মৃতিশক্তি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় ফেলুদা একাই একশো। ওরকম উচ্চতা আছে আর শারীরিক সক্ষমতাই বা কটা মধ্যবিত্ত বাঙালির আছে? বিশ্লেষণী শক্তি আর বুদ্ধিমত্তায় ফেলুদা বিশ্বের সেরা গোয়েন্দাদেরকেও টেক্কা দিতে পারেন। এখানেই উৎপল দত্তের আপত্তি। ইংরেজি শিক্ষা ও চেতনার দাসত্ব করা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে থেকে এরকম ত্রুটিহীন গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি হতে পারে না। পুরো মাপের সার্থক গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি হতে পারে ইংল্যান্ডের মতো সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী দেশগুলিতে। পরাধীনতার জ্বালা তাদের সহ্য করতে হয়নি, অন্য জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতির আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়তে হয়নি; সবচেয়ে বড়ো কথা পুঁজির কারণে তাদের অন্ন-বস্ত্রের ভাবনা ভাবতে হয়নি। ফলে গোয়েন্দাগিরির মতো বুদ্ধির চর্চা তাদের কাছে অবসর সময়ের শৌখিনতা মাত্র। শার্লক হোমস বা ড. থর্নডাইকের মতো চরিত্র সৃষ্টি করে ইউরোপীয় ‘বুর্জোয়া’ সমাজ এটা প্রমাণ করতে চেয়েছে যে শুধু অস্ত্রের শক্তিতে নয়, বুদ্ধিতেও তাঁরা বিশ্বশ্রেষ্ঠ। শার্লক হোমসের দাদা মাইক্রোফট হোমস ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উচ্চ-পদাধিকারী। হোমসের মক্কেলদের মধ্যে রাজা-বাদশাদেরও অভাব নেই। তাঁকে এবং তাঁর অধিকাংশ মক্কেলকে ডাল-ভাতের কথা ভাবতে হয় না। ফলে মি. হোমস পাইপ, পিয়ানো আর ডিয়ারস্টকার নিয়ে “এলিমেন্টরি, মাই ডিয়ার ওয়াটসন” বলার যথেষ্ট সময় পান।
কিন্তু ফেলুদার সংসার চলে কী করে? কৈলাশ চৌধুরী, দীননাথ লাহিড়ী বা রঞ্জন মজুমদারের মতো ‘জাঁদরেল’ মক্কেল আর কয়জন? মুকুল ধরের বাবা সুধীর ধরের মতো মানুষই তো বেশি। নয়তো অধিকাংশই ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়া মামলা। ফেলুদা যে মধ্যবিত্ত বা ‘পেটি-বুর্জোয়া’ শ্রেণির যুবপ্রতিনিধি, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষে তারা রুটি-রুজি নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। তারা অবসর সময়ে বুদ্ধিবিদ্যার চর্চা করে না। বরং পাড়ার রকে বসে আড্ডা মারে বা ময়দানি ফুটবল নিয়ে তর্ক করে। এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে একজন সর্বগুণসম্পন্ন ‘শখের গোয়েন্দা’ উঠে আসা সম্ভব নয়। উৎপল দত্তের নিজের ভাষায়,
“সত্যজিতের ফেলুদা তার শ্রেণি-উৎসের কারণেই এক ম্যাড়মেড়ে জীব। বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা বা সূত্রকে যুক্তিসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করার খ্যাতি, আর যার হোক, অন্তত নিম্নমধ্যবিত্তের নেই।”
তা সত্ত্বেও কেন সত্যজিৎ রায় ফেলুদা চরিত্র সৃষ্টি করলেন, উৎপল দত্ত তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সত্যজিৎ রায়ের অধিকাংশ সিনেমার চরিত্ররাই ‘পাতি-বুর্জোয়া’ শ্রেণির। তাঁদের গতে বাঁধা জীবন, অসার ব্যক্তিত্ব, ক্ষুদ্র স্বার্থের লড়াইয়ের মধ্যে তিনি প্রকৃত ‘মানুষ’-এর সন্ধান করেন। এভাবেই ‘মহানগর’ বা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র একক ব্যক্তির সমস্যা সারা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে মহাকাব্যিক হয়ে ওঠে। তার জন্য সত্যজিৎ রায়কে তাঁর সমস্ত প্রতিভা একত্রিত করতে হয়। ফলে তিনি যখন ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমা করেন, তখন বুঝে নিতে হবে তিনি মধ্যবিত্ত জীবনের ক্লান্তিকর একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। ফেলুদার জন্মও সেভাবেই। তবে ফেলুদাকে আপন শ্রেণি-চরিত্রের তুলনায় বেশি প্রতিভাশালী রূপে গড়ে তুলতে গিয়ে তাঁর মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব দেখা গেছে। উৎপল দত্তের মতে সেই কারণে ফেলুদা “ডিটেকটিভই নয়, বড়ো জোর রোমাঞ্চ কাহিনির নায়ক”। হালকা পাঠের জন্য ফেলুদা ঠিক আছে, তবে সিনেমায় তাঁকে রক্তশূন্য চরিত্র মনে হয়েছে।
উৎপল দত্ত বিদ্বান ব্যক্তি; তাঁর প্রতিভা ও পড়াশোনা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস আমাদের নেই। তবে অন্তত ফেলুদার বিষয়ে আমরা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের বিরোধিতা করব। ফেলুদার সিনেমা-উপন্যাসকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেই তাঁর প্রতিভা ও সাহসের উৎস জানা যায়। সিনেমায় স্পষ্ট বলা আছে তাঁদের “বংশটাই যে ডানপিটের”। ফেলুদার বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র মাত্র ১০ বছর বয়সে শেয়ালের গর্তে হাত ঢুকিয়ে শেয়ালছানা বের করে আনত। ফলে সাহস জিনিসটা ফেলুদা পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছে। আবার এটাও ভুলে গেলে চলবে না অধিকাংশ প্রতিভাবান বাঙালির জন্মই মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁরা রকে বসে আড্ডা মারলেই যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন হবে না, সেটা উৎপল দত্ত কীভাবে ভাবলেন? তিনি কি ফেলুদার স্রষ্টা স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের নামটা ভুলে গেছিলেন? বাস্তবের ফেলুদা তো তিনিই। নিম্নমধ্যবিত্ত অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উঠে এসে তিনি যদি বিশ্বজয় করতে পারেন, তাহলে ফেলুদাকে কেন তিনি সর্বগুণসম্পন্ন করে তুলবেন না? তা সত্ত্বেও তিনি ফেলুদাকে শিকড় থেকে তুলে ফেলেন না। ফেলুদা তোপসের মাথায় গাট্টা মারেন, লালমোহনবাবুকে নিয়ে মজা করেন, দেশ ঘুরতে ভালোবাসেন আর ভালো মিষ্টির সন্ধান পেলে তো কথাই নেই। এই জন্যই তো সাহিত্যের প্রদোষচন্দ্র মিত্র আমাদের ‘দাদা’ হয়ে উঠতে পারেন। সাহিত্য হিসেবে তার অনেক দোষত্রুটি আবিষ্কার করা যায়। কিন্তু তত্ত্ব দিয়ে কি আর ভালোবাসা মাপা যায়? কিছু সম্পর্কে ‘লজিক’ নয়, ‘ম্যাজিক’ কাজ করে। ফেলুদা সেরকমই একজন মানুষ।
...................
#satyajit ray #utpal dutt #feluda