যশোর রোডের গাছ : কোর্টের সাম্প্রতিক রায় নিয়ে দু-এক কথা
গতকাল, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ছিল পরিবেশকর্মীদের জন্য একটা হতাশার দিন।
যশোর রোডের বারাসত থেকে বনগাঁ পর্যন্ত অংশে ৩০৫টি শতাব্দীপ্রাচীন গাছ কাটার অনুমতি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
২০১৮ সালে গাছ কাটায় স্থগিতাদেশ দিয়েছিল আদালত। গতকাল ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে আদালত জানিয়েছে, জনস্বার্থে গাছগুলি কাটতে হবে। সঙ্গে আশ্বাসবাণী জুড়ে দিয়েছে যে ৩০৫টি গাছ কাটার আগে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে ১৫০০টি গাছ লাগাতে হবে। অর্থাৎ একটি গাছপিছু পাঁচটি গাছ লাগাতে হবে। তা সত্ত্বেও হতাশার দিন বলছি কেন? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা বলব।
দেশ ভাগের পর এই যশোর রোড ধরেই উদ্বাস্তুরা এসেছিলেন কাঁটাতারের এপারে। ফলে এই যশোর রোডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশভাগ ও তৎপরবর্তী স্মৃতি। নস্টালজিয়ার জন্য বর্তমানের অসুবিধা তুচ্ছ করতে হবে, এমন নয়। কথাটা পরিবেশ নিয়ে। গাছ নিয়ে।গাছ কাটার ক্ষেত্রে এই ধরনের অঙ্গীকার আগেও আদালত বা প্রশাসনের তরফ থেকে অনেক হয়েছে। তার কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, খোঁজ নিলে কর্তাব্যক্তিদের বড়সড় লজ্জার মুখে পড়তে হবে। গাছ লাগিয়েই দায় শেষ হয়ে যায় না। তাকে বড় করে তুলতে বিস্তর খাটনি লাগে। তাছাড়া যদি ধরেও নিই, কোনও অলৌকিক সোনার কাঠির ছোঁয়ায় সত্যিই ১৫০০ গাছের চারা খুব যত্ন করে লাগানো হল, দেখভালও করা হল, তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ যতটা অক্সিজেন দিতে পারে, নতুন চারাদের ততটা অক্সিজেন দিতে সময় লাগবে বহু বছর। তাই পরিবেশবিদ ও উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা অনেক বেশি জোর দিতে বলছেন পুরনো গাছ বাঁচানোয়। দেখা গেছে যে চারাগাছের বেঁচে থাকার হার পঁচিশ শতাংশ। অর্থাৎ, চারটে গাছ লাগানো হলে জলের অভাব, পোকামাকড়ের আক্রমণের মতো প্রতিকূলতা পেরিয়ে টিকে থাকতে পারে মাত্র একটা গাছ। আবার একটা গাছের পূর্ণবয়স্ক হয়ে ওঠার জন্য পনেরো থেকে তিরিশ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তার মানে অক্সিজেনের জোগান বা কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের উদ্দেশ্যে গাছ লাগানো হলে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হতে সময় লাগবে প্রায় দু’দশকেরও বেশি। ততদিনে দূষণ কোন জায়গায় পৌঁছবে, ভেবে দেখা হয়েছে?
এই রাস্তায় যানজট হয়, মানুষজনের অসুবিধা হয় সেকথা ঠিক। তার জন্য এই প্রাচীন গাছগুলোকেই বলি করা হল।
আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে কিন্তু দফায় দফায় নানা টেকনিকাল রিপোর্ট দিয়ে নানা বিকল্পের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই হেরিটেজ গাছ গুলির বাস্তুতান্ত্রিক মূল্য, রেলের ওভারব্রিজের বদলে টানেল, অটো-বাসের দাঁড়াবার জায়গা বদল এরকম বিষয়গুলো পেশ করা হয়েছে বহুবার। সুপ্রিম কোর্টের নির্ধারিত বিশেষজ্ঞ দলের পক্ষ থেকেই স্বীকার করা হয়েছিল যে, যশোর রোডের দু-ধারের এই প্রবীণ গাছগুলির একেকটির বাস্তুতান্ত্রিক মূল্য টাকায় মাপা যাবে না। তা সত্ত্বেও তারা কাটা পড়ছে। তাঁদের বাঁচিয়ে কোনোভাবে উন্নয়নকে রাস্তা করে দেওয়া গেল না।
তবে নিজে ব্যক্তিগতভাবে 'যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটি'-র সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে বলতে পারি, আমাদের আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে গেল না। আমরা জানি স্থানীয় গুন্ডারাজের কতটা বিরোধিতা সহ্য করে দীর্ঘ সময় আমাদের আন্দোলন টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। এই একটা গাছের জায়গায় পাঁচটা গাছ লাগানোর অঙ্গীকার প্রশাসন কতটা সদিচ্ছার সঙ্গে পালন করবে, তার দিকে আমাদের কড়া নজর থাকবে। গর্বের সঙ্গে এটাও বলতে চাই যে, আদালতের রায় যা-ই হোক, যশোর রোডের গাছ বাঁচাও আন্দোলন বাংলার সচেতন মানুষের কাছে একটা বলিষ্ঠ বার্তা দিতে পেরেছে। বহু মানুষ নানাভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ পরিবেশ-আন্দোলনগুলোর মধ্যে একে গণ্য করতে কারোর দ্বিমত থাকার কথা নয়। এই আন্দোলন শেষ হয়নি। লড়াই চলছে, চলবে।
..................
#Jessore Road #Supreme Court #Tree #silly পয়েন্ট