বিবিধ

বাঘমামার পদাবলী

পথিক মিত্র Dec 2, 2022 at 9:40 am বিবিধ

"তুমি যে ঘরে কে তা জানত?"

মনে পড়ে 'হীরক রাজার দেশে'-র সেই আইকনিক দৃশ্যটা? গুপি গান গেয়ে থামিয়ে রাখছে বাঘমামাকে, আর বাঘাদা সেই ফাঁকে তুলে নিচ্ছে হিরে। আসলে সত্যজিৎ রায়ের বাঘকে নিয়ে বরাবরই একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। বাঘের দেখা আমরা 'ছিন্নমস্তার অভিশাপ'-এও পাই, যেখানে সুলতানের সঙ্গে মাঝরাস্তায় আচম্বিতে মোলাকাত হয়ে যায় জটায়ুর। 'রয়েল বেঙ্গল রহস্য'-তে বাঘ স্বমহিমায়। শুধু তাই নয়, সন্দেশের বহু সংখ্যার প্রচ্ছদেও কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে উঁকি মেরেছেন Panthera tigris। এমনকি সত্যজিৎবাবুর নাকি আক্ষেপ ছিল যে তিনি ঠিকঠাক একটা বাঘের অভাবে 'ছিন্নমস্তার অভিশাপ' সেলুলয়েডে আনতে পারলেন না। 

আজ কিন্তু VFX-এর কৃপায় বাঘমামাকে খুব সহজেই ছবিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি আমরা। রিচার্ড পার্কারকে মনে আছে? 'লাইফ অফ পাই'-এর সেই বিখ্যাত বাঘ, যার সঙ্গে সমুদ্রের বুকে  একটি নৌকাতে পাড়ি দিয়েছিল পাই। সেই ছবিতে ছবিতে কিন্তু নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভয়াল ইমেজ থেকে বেরিয়ে প্রায় একটা দার্শনিক স্তরে উঠে এসেছিলেন বাঘমামা। VFX জানা সত্ত্বেও দেখবেন কীরকম একটা মায়া পড়ে যায় রিচার্ড পার্কারের উপর। আসলে ভারত ও তার আসে পাশের দেশগুলিতে বাঘ নিয়ে প্রচুর উপকথা, গল্প, ইতিহাস, মিথ জড়িয়ে আছে। তারই নানান ঝলক আমরা পাই। একদিকে রুডইয়ার্ড কিপলিং'দা জঙ্গল বুকে' বাঘ 'শেরখান'-কে এক হিংস্র খলনায়ক হিসেবে দেখিয়েছেন, তো অন্য দিকে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর তাঁর "টুনটুনির বই" এর বেশ কিছু গল্পে বাঘমামার সাথেই প্রভূত মশকরা করেছেন। কিন্তু শেরখানই বলুন বা নরহরি দাশই বলুন বাংলা ও ভারতের সাহিত্যে বাঘ কিন্তু ফিরে ফিরে এসেছে। টুনটুনির বই এর 'বাঘ-বর', গল্পে অদ্ভুত ভাবে পায়ে নাগরাই, গায়ে জোব্বা, মাথায় টুপি পরা বরবেশী বাঘের চেহারা যে বেশ খোলতাই হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। আমার আবার খুব প্রিয় ‘বোকা বাঘ’ গল্পের খোঁটায় বাঁধা বাঘটি। ছেলেবেলার নস্টালজিয়া হয়ে গেছে ছবিটা। সঙ্গে ক্যাপশানটিও খাসা- "বাঘ বললে, হি হি, হিহি, হিহি।" লীলা মজুমদার একবার লিখেছিলেন, গপ্পো হিসেবে নাকি তিনটি বিষয় একেবারে অব্যর্থ। এদের নিয়ে গল্প বাঁধলে সে-গল্প জমতে বাধ্য। ভূত, চোর আর বাঘ।  জিম কর্বেট সাহেবের 'ম্যানিটার্স অফ কুমায়ুন'- এও কিন্তু চিতাবাঘের ভয়াল রূপের দুর্ধর্ষ বর্ণনা পাওয়া যায়। মোদ্দা কথা আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সাথেই কিন্তু বাঘ প্রগাঢ়ভাবে জড়িয়ে আছে।


তবে শুধু ফিল্ম বা সাহিত্য বলছি কেন, বাঘমামা কিন্তু আমাদের ধর্মের সাথেও গভীরভাবে যুক্ত আছেন। যদিও আমাদের বাঙালিদের কাছে দশভূজা দেবী দুর্গা সিংহের পিঠে করে আসেন, তবে উত্তর ভারত ও মধ্য ভারতে কিন্তু শেরাওয়ালি মাতার পুজোর চল আছে, যাঁর বাহন বাঘ। 'জয় মাতা দি' বলে এই দেবী অম্বিকারই জয়ধ্বনি করা হয়। শিবপুরাণ মতে আরও একটি মজার গল্প আছে। মহাদেব শিব একবার পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে একটি জঙ্গলে যান। তখন তিনি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে চলাফেরা করতেন। সেই জঙ্গলে তাঁকে  দেখে জঙ্গলে উপস্থিত ঋষিপত্নীরা মোহিত হয়ে যান। এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়ে ঋষিগণ যোগবলে একটি বাঘ সৃষ্টি করেন শিবকে বধ করার জন্য। তাঁরা মহাদেবের আসল পরিচয় সম্বন্ধে অবগত ছিলেন না। সেই বাঘ মহাদেবকে আক্রমণ করলে মহাদেব তাকে বধ করে তারই ছালটি বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন। সেই ভাবে দেখতে গেলে দেবাধিদেব মহাদেবই কিন্তু বিশ্বের সর্বপ্রথম পোচার!

দক্ষিণ ভারতের দেবতা আইয়াপ্পা বা মানিকন্দনের সঙ্গেও কিন্তু বাঘের মিথ জড়িয়ে আছে। মহারাজা রাজশেখরের পত্নী নিজের পুত্রের সিংহাসনের লোভে রাজার পালিত পুত্র মনিকন্দনকে বাঘের দুধ আনতে জঙ্গলে পাঠান। তাঁর ধারণা ছিল মণিকন্দন  বাঘের হাতে মারা পড়বেন। কিন্তু তিনি অনেক অসুর বধ করে এক বাঘিনীর পিঠে চড়ে, তাঁর বাচ্চাদের নিয়ে রাজ্যে ফিরে আসেন। তারপর থেকেই সবরিমালাতে মণিকন্দনের উপাসনার প্রচলন শুরু হয়।

সুন্দরবনে বনবিবির পূজা প্রচলিত। এই দেবীর সাথেও বাঘের যোগ অতি প্রত্যক্ষ। দেবী নাকি দুঃখী নামক এক রাখাল বালককে বাঘের হাত থেকে বাঁচিয়ে এক ডাকিনীকে হারিয়েছিলেন। তারপর থেকেই নাকি বাঘের কাছে নরবলির প্রথা বন্ধ হয়। তবে বাঘের উপর সওয়ার এই বনবিবি দেবী কিন্তু নিজেই এক বিরল দৃষ্টান্ত। সুন্দরবনের মানুষের জীবিকা অনেকটাই বন-নির্ভর। কাঠ বা মধু আনতে তাদের বনে যেতেই হয়। আর বনে তো বাঘমশাই। তাই যাওয়ার আগে বনবিবির পুজো করাটা সুন্দরবনের অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে। আরো অদ্ভুত হলো এই দেবীর পূজা হিন্দু ও মুসলমানরা সমবেতভাবে করেন। এমন নিদর্শন বিশ্বের আর কোনো স্থানে আছে বলে তো আমার জানা নেই। আর এর কৃতিত্ব রয়াল বেঙ্গল টাইগারেরই। মহারাষ্ট্রের ওয়ার্লি আদিবাসীদের মধ্যেও বাঘের খুব খাতির বহু যুগ ধরে। তাদের বিখ্যাত 'ওয়ার্লি আর্ট'-এ বাঘমশাইকে দেখতে পাবেন বারবার। বাঘদেবতার পুজোয় প্রতি বছর তাঁরা তাঁদের উৎপাদিত শস্যের একটা অংশ দিয়ে থাকেন অর্ঘ্য হিসেবে। তাঁরা আবার বাঘদেবকে উর্বরতার প্রতীক হিসেবেও দেখেন। তাই ওয়ার্লি জাতির যে কোনো বিয়েতে লাল হলুদ জামা পরে কপোত-কপোতী পালঘট দেবীর মন্দির দর্শন করেন। লাল হলুদ এখানে ইস্ট বেঙ্গল নয়, বাঘের প্রতীক।


ইস্টবেঙ্গলের কথাই যখন উঠল তখন বলে রাখা ভালো যে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের লোগোতেও কিন্তু দেখতে পাবেন আমাদের প্রিয় বাঘমামাকে। উল্লেখ করার মতো বিষয় যে,  ২০১০ সালের কমনওয়েলথ গেমসের ম্যাসকট ছিল 'শেরা' নামে এক হাসিখুশি বাঘ।

শুধু খেলাধুলো নয়, রাজনীতিতেও কিন্তু বাঘবাবাজীর অবাধ বিচরণ। মহারাষ্ট্রের শিবসেনা দলের পতাকায়  আছে বাঘের মুখ। সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক দলের প্রতীক ছিল এক লম্ফমান বাঘ। এমনকি শ্রীলঙ্কার ত্রাস LTTE ( Liberation Tigers of Tamil Elam) দলের প্রতীকেও বাঘের মুখ। দেখা যায়, যেখানেই একটা বেপরোয়া সাহসের প্রতীক খোঁজা হয়েছে, অগ্রাধিকার পেয়েছেন বাঘমামাই।


ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকা বাঘ যে একদিন endangered species হতে পারে তা হয়তো একশো বছর আগে ভাবাই যায়নি। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে চোরাশিকারিদের উৎপাত ভয়ানক বৃদ্ধি পায়। ২০০৬ সালের বাঘসুমারিতে দেখা যায় ভারতে আর মাত্র ১৪১১ টি বাঘ অবশিষ্ট। টনক নড়ে প্রশাসন ও সরকারের। ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। নেওয়া হয় নানা কর্মসূচী। খুশির খবর, ২০১৮ সালের সেন্সাসে বাঘের সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ২৯২৭।

এই উপলক্ষ্যে 'মছলি'-র কথা বলা দরকার। রনথম্বর অভয় অরণ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার মছলি বিভিন্ন নামে বিখ্যাত। যেমন, Queen Mother of Tigers, Tigress Queen of Ranthambore, Lady of the Lakes, Crocodile Killer ইত্যাদি। শেষের উপাধিটি সে পেয়েছিল একটি ১৪ ফিটের কুমিরকে শায়েস্তা করে। মছলি জঙ্গলে ২০ বছর বেঁচে ছিল। তাই প্রাকৃতিক জঙ্গলে এটি একটি অতি বিরল দৃষ্টান্ত। শুধু তাই নয়, মছলি পাঁচ বার গর্ভবতী হয়ে সব মিলিয়ে মোট এগারোটি শাবকের জন্ম দিতে সক্ষম হয়। সাধারণত বাঘেরা তিনবারের বেশি গর্ভবতী হয় না। মছলির মৃত্যুর পর বনবিভাগ ও স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে সসম্মানে দাহ করে। সত্যিই বাঘেদের রানিই ছিল মছলি।


সবশেষে আমার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা না লিখে পারছি না। জায়গাটা হল থাইল্যান্ডের ফুকেট শহর। আমরা গেছি মধুচন্দ্রিমা করতে। খোঁজ পেলাম এক অদ্ভুত জায়গার। টাইগার কিংডম। এরকম কোনো জায়গা যে বাস্তবে থাকতে পারে সে বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না আমার। তা কী আছে সেখানে? নাম শুনেই আন্দাজ করা যায় প্রচুর বাঘ। বিভিন্ন বয়স ও প্রজাতির। কিন্তু মজাটা আসলে সেখানে নয়। এখানে বাঘেরা বিড়াল বা কুকুরছানার মতো আপনার সাথে খেলবে। অবশ্যই কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারিতে। আপনি একটি চার বছরের ২০০ কিলো ওজনের বাঘের লেজ ধরে ছবি তুলছেন, এই কথাটা ভাবলেই পেটের ভিতর কীরকম খালি-খালি লাগে না? এখানে আপনি সেই অভিজ্ঞতাই পাবেন।  এক্ষেত্রে বলে রাখি, অনেকেই বলেন বাঘগুলোকে ওষুধ খাইয়ে ঝিমিয়ে রাখা হয়, কিন্তু এটা মিথ্যে রটনা মাত্র। আসলে বাঘগুলোকে জন্ম থেকে ট্রেনিং দেওয়া হয়, আর অতিরিক্ত খাওয়ানো হয়, তাই তাদের শিকার-স্পৃহা তৈরি হতে পারে না। তবে চার বছর হয়ে গেলে আর তাদের সাথে এভাবে মেলামেশা করা যায় না। সুরক্ষা জনিত কারণে তাদের তখন খাঁচাবন্দি করা হয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, দশ-বারোটা পুঁচকে বাঘের বাচ্চাকে একটি ভ্যান-খাঁচায় ভরে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বড় খাঁচায়, ট্রেনার কোলে নিয়ে, লেজ টেনে খাঁচায় ঢোকাচ্ছে তাদের, এ দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন। ঠিক যেন বাচ্চাদের স্কুলভ্যান।  

তবে তার নিজের চারণভূমিতে তার যা swag সেটা চিড়িয়াখানা বা ফুকেটের নকল বাঘশালায় পাবেন না, বলাই বাহুল্য। 

.............................. 

#

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

53

Unique Visitors

217960