ভ্রমণ

ভিতরকণিকায় তিনদিন

অয়ন্তিকা দাশগুপ্ত Dec 18, 2021 at 6:38 am ভ্রমণ

ওড়িশা বলতে এতদিন আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালির মতো আমিও বুঝতাম শুধু পুরীকেই। এতদিন পর্যন্ত মানে এই ২৭ এ ডিসেম্বরের আগে অব্দিও। এর আগে অব্দি প্রত্যেক বছর নিয়ম করে পুরী গেছি, আর কোথাও যাই না যাই। এবারই প্রথম ওড়িশাকে চেনা একটু অন্য ভাবে। সমুদ্র নয় - জঙ্গলে ঘেরা ওড়িশা।

ভিতরকণিকা ওড়িশার একটি ম্যানগ্রোভ অরণ্য , ঠিক আমাদের এখানকার সুন্দরবনের মতো। ব্রাহ্মণী ও বৈতরণী নদীর অববাহিকা অঞ্চল জুড়ে এই অরণ্যের বিস্তৃতি। ভিতরকণিকাকে গন্তব্য ঠিক করার পেছনে কাজ করেছে দুটো কারণ। প্রথমত, ভিতরকণিকা ভারতের বৃহত্তম নোনাজলের কুমির সংরক্ষণ কেন্দ্র। আর দ্বিতীয়ত, এখানে দেখা মেলে প্রায় সাত-আট রকম মাছরাঙা পাখির। তাই ভিতরকণিকায় পৌছানোর আগেই ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল বোট সাফারির। ওখানে সবই মোটরচালিত ভটভটির মতো। আমাদের ৩ দিন সমস্ত ভিতরকণিকা ঘুরে দেখা ওই ভটভটিতেই। মোট ৮ জনের হিসেবে ভটভটির ভাড়া লেগেছে ১৬৫০০ টাকা ।


ভিতরকণিকার জন্য অফিসের লম্বা ছুটি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই । একটি উইকেন্ডই যথেষ্ট । যাঁদের নিজস্ব চারচাকা আছে তারা অনায়াসে তাতে সওয়ার হতে পারেন। আমরা রওনা দিয়েছিলাম ট্রেনে, রাত ১২ টার হাওড়া মাদ্রাজ মেলে। ভোর চারটে এ ট্রেন পৌছায় ভদ্রক। ট্রেন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত পেরিয়ে ওড়িশার সীমানায় প্রবেশের শুরুতেই আসে বালাসোর, তার পরেই ভদ্রক। আমাদের নির্ধারিত বোটের মাঝিদাদাই গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ভদ্রক থেকে জয়নগর জেটি আসার। জেটিতে নির্ধারিত সময়েই অপেক্ষা করছিল আমাদের ভটভটি। খোলা চেকপোস্ট থেকে অনুমতি পত্র গ্রহণ করেই আমরা প্রবেশ করলাম ব্রাহ্মণী নদীবক্ষে। চারপাশের জঙ্গল তখন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। আমরা ততক্ষণে ক্যামেরা হাতে মাঝিদাদাকে জর্জরিত করে দিচ্ছি কুমির, মাছরাঙার দেখা মিলবে কিনা, কতক্ষণে মিলবে ইত্যাদি।


ভিতরকণিকায় আমাদের এই ৩ দিনের ঠিকানা ছিল ডাংমালের ভিতরকণিকা নেচার ক্যাম্প। বানীভবন কটেজের দুটি খোলামেলা ঘরে আমরা গুছিয়ে বসি। ভটভটিতে প্রায় ঘন্টা খানেক সওয়ার হয়ে আমরা এসে পৌঁছই সেখানে। পথে ততক্ষণে সাক্ষাৎ পেয়ে গেছি ১০ ফুটের এক কুমিরের। নষ্ট করার মতো সময় তখন নেই। সকাল পৌনে ১০ টা নাগাদ আমরা রেস্ট হাউস অঞ্চলে আসি। ঘরে পৌঁছানোর দুটি রাস্তা, একটা বাঁধানো আরেকটা জঙ্গলের রাস্তা। সদ্য এসেছি, অয়ডভেঞ্চারের নেশা তখন পেয়ে বসেছে। ক্যামেরা হাতে নিয়ে জঙ্গলের পথ ধরলাম।পাশের কর্দমাক্ত জমিতে দেখা পেলাম অনেক মাড স্কিপার আর মনিটর লিজার্ড বা পাতি বাংলায় যাকে আমরা গোসাপ বলি। হুজুগের বশে বুঝিনি তখন আমার লিগামেন্ট ছেঁড়া পা, এবং জুতোর জন্য জঙ্গলের পথ বড্ড কঠিন হবে। পথ বলতে ওটা ঘাসজমি, আর কাদামাটি , সেই কাদায় প্রতি পদে পা ঢুকে যাওয়ার জোগাড়। সঙ্গীদের সহায়তায় কোনোক্রমে ঘরে এসে উঠলাম। একটু জিরিয়ে নিয়ে ১২.৩০ টার মধ্যে দুপুরের খাবার দিতে বলে আমরা তৈরী হয়ে নিলাম দুপুরের নৌকা ভ্রমণের জন্য। কারণ আলো কমে এলে ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ নেই। কেন সে কথায় পরে আসছি।


দুপুরে রেস্ট হাউসের ক্যাণ্টিনে ভাত, আলু উচ্ছে ভাজা, দুই রকম সব্জি, ভেটকি মাছ সহ লাঞ্চ সেরে রওনা দিলাম ভটভটিতে। রেস্ট হাউসের চত্বর এতটাই বড় যে তার মধ্যেই টোটো চলার ব্যবস্থা আছে। যে কেউ প্রয়োজনে সে সুবিধা নিতেই পারেন। ভটভটিতে চড়ে প্রথম দুপুরেই দেখা পেলাম BLACK CAPPED KINGFISHER বা কালোমাথা মাছরাঙার, যাকে দেখার জন্য সবচেয়ে বেশি উদগ্রীব ছিলাম। এর পর একে একে ছোট বড় নানা আকৃতির কুমির, গোসাপের দেখা মিলতে লাগল। প্রায় পলকহীন ভাবে কেটে গেল রূদ্ধশ্বাস দেড় ঘন্টা । আলো কমার সাথে সাথে গতিপথ বদলে আবার ফিরলাম রেস্ট হাউসে। ওখানে প্রত্যেক কটেজের জন্য একজন করে কেয়ারটেকার থাকেন। আমরা আসা মাত্রই তিনি জানালেন বিকেলের চা, পকোড়া তৈরী, আমরা যেন ক্যান্টিনে গিয়ে সেগুলো খেয়ে নিই। রেস্ট হাউসটি জঙ্গল মধ্যবর্তী এলাকায় হওয়ায় অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার খোলামেলা পরিবেশ হয়ে ওঠে বন্য জন্তুদের চারণভূমি। বন্য শুকর, চিতল হরিণ, নেকড়ে যখন তখন করতে পারে আক্রমণ, তাই সন্ধ্যের পর ঘরের বাইরে খাওয়া, বা ঘুরে বেড়ানো মনুষ্য জাতির জন্য নিষিদ্ধ। রাতের খাবার তৈরী হলে কেয়ারটেকাররাই মাথায় হেডলাইট জ্বালিয়ে এসে নিয়ে যাবেন আমাদের ক্যান্টিনে। সেই যাত্রাপথে দেখা মিলবেই বন্য জন্তুদের, অধিকাংশেরই চোখ জ্বলছে অন্ধকারে। পশুটি যে কী, সবসময় ঠাওর করা না গেলেও তাদের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।


পরের দিন ভোর বেলা উঠে বসে আছি, আরেক সঙ্গীর সঙ্গে আমার বার্ডিং এ বেরোনোর কথা রেস্ট হাউস সংলগ্ন জমিতে। শীতের কুয়াশা আর জঙ্গলের গভীরতা ভেদ করে আলো এসে আমাদের ছুঁতে ছুঁতে বেজে গেল প্রায় ৬ টা। ঘন্টা খানেক অসংখ্য ছোটো ছোটো পাখিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটলাম। ক্যামেরায় ধরে রাখলাম তাদের। Streak Throated woodpecker , common Iora, Tyga Flycatcher, Coal tit, Black- rumped Flmaeback Woodpecker, Brown Goshawk প্রভৃতি অসংখ্য পাখি। বাকি সঙ্গীদের তাড়া লাগিয়ে প্রাত ঃ রাশ শেষ করে ফের পালা ভটভটিতে সওয়ার হওয়ার। আশ্চর্য ব্যাপার সেদিন কুমির দর্শন একটু কমই হল। Greater Egret বা purple Heron বাদে সেভাবে কোনো পাখির দেখাও মিলল না। যদিও ভিতরকণিকা কুমিরের রাজ্য হিসেবেই প্রসিদ্ধ তবু কুমিরের দেখা পাওয়া যাক না যাক আরকেজনের দেখা মিলবেই , সে হল টিয়া পাখি। হাজারো হাজারো টিয়া পাখি মাথার ওপর সারাদিন টি টি করে উড়ে বেড়াচ্ছে, গাছের মগ ডালে সভা বসাচ্ছে । বলাই বাহুল্য আমার মতো পক্ষীপ্রেমীদের কাছে এ এক চোখ জুড়ানো ব্যাপার। সে যাই হোক পাখি কুমিরের দিক ছেড়ে সেদিন আমাদের ভটভটি যাওয়ার কথা অন্য এক বালুতীরে, মোহনায়। জনশূন্য এক সমুদ্র তীর, নাম উড়াবালি সমুদ্র সৈকত। নদী পেরিয়ে সমুদ্রে পড়তেই ভটভটি নাচতে লাগল ঢেউয়ের তালে তালে, লিখতে গেলে এখনও দোলা লাগছে। সে এক লাল কাঁকড়ার দেশ, বোঝাই যায় মানুষের পদচিহ্ন থেকে এ তীর বহুদূরে। তাই বুঝি সবকিছু এমন সহজ সুন্দর। ওখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফেরার পালা। কারণ উড়াবালি সৈকতে পৌঁছতে সময় লেগে যায় বেশ অনেকটাই। ধীরে ধীরে সূর্যাস্তের রং ছুঁয়ে ফিরে আসি রেস্ট হাউসে। ততক্ষণে সেখানে দখল নিয়েছে এক বন্য শুকর, শৃঙ্গযুক্ত ও শৃঙ্গবিহীন অনেক হরিণ, প্যাঁচার দল।


ভিতরকণিকায় শেষ দিন আমাদের প্রাপ্তির ঝুলি উপচে পড়েছে। সকালেই দেখা মিলেছে Brown Winged Kingfisher, Collared Kingfisher এর। কুমিরের কান্না দেখার সৌভাগ্য মানুষ বলে আগেই হয়েছে, কিন্তু সেদিন দেখেছি কুমিরের হাসি। ১৬ ফুট, ১৭ ফুটের কুমিরের দেখা মিলেছে। আরও বুঝলাম যে গতকাল রবিবার হওয়ায় ভিতরকণিকাতে পর্যটকদের উৎপাত একটু বেশিই ছিল, তাই কুমির এবং পাখিরা গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছিল। প্রকৃতি ও পশুদের এত কাছ থেকে এভাবে আর কোনোদিন দেখেছি বলে মনেই পড়ে না।



..................... 

[সমস্ত ছবির কপিরাইট লেখকের] 


#ভ্রমণ #Travel #Bhitarkanika National Park #Odisha #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal #অয়ন্তিকা দাশগুপ্ত

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

53

Unique Visitors

217960