নিবন্ধ

জান আছে তাই গানও আছে

বিবস্বান দত্ত April 21, 2021 at 10:50 am নিবন্ধ

ফ্যাসিজম, নিওফ্যাসিজম, পোস্টফ্যাসিজম এই তাত্ত্বিক প্রস্থানগুলির নামকরণ হয়তো বদলেছে সমাজ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত অনুসারে। কিন্তু এদের প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে এক অদৃশ্য সুতো। অতিদক্ষিণপন্থী উগ্রজাতীয়তাবাদের এক অনিবার্য স্বৈরাচার। যা নির্মাণ করে চলে একরৈখিক ন্যারেটিভ। বিভিন্নতা অস্বীকৃত হয় তাতে। ক্ষমতাকেন্দ্রে এসে বসে একের ভুয়ো দর্শন। বহুস্বরকে দাবিয়ে দেওয়াই যার লক্ষ। উমবের্তো একো ২২ জুন ১৯৯৫ সালে The New York Review of Books এ UR-FASCISM নামের এক প্রবন্ধ লেখেন। সেইখানে একো ফ্যাসিবাদের চোদ্দটি লক্ষণ চিহ্নিত করেন।

The cult of tradition– ঐতিহ্যের প্রতি অন্ধ আনুগত্য।

The rejection of modernism– আধুনিকতার বিরোধিতা।

The cult of action for action’s sake– লড়াইয়ের জন্যই লড়াই।

Disagreement is treason– শাসকের সিদ্ধান্তের প্রতি অসম্মতি মানেই বিশ্বাসঘাতকতা।

Fear of difference– বৈচিত্র‍্যে ভীতি।

Appeal to social frustration– সামাজিক হতাশাকে ব্যবহার

The obsession with a plot– একটি নির্দিষ্ট আখ্যানের প্রতি অতিদুর্বলতা। এর ভেতরেই একো রাখেন জেনোফোবিয়া বা পররাষ্ট্রভীতিকে। নিজের দেশের সমস্ত বিপর্যয়ের জন্য দায়ীদায় অন্য কোনও শত্রু রাষ্ট্র, এমন বিশ্বাস ফ্যাসিবাদীর চারিত্র্য হয়ে ওঠে।

এ ছাড়াও একো ফ্যাসিজমের আর যে যে বৈশিষ্ট্য তুলেছিলেন তা হল–

The enemy is both strong and weak

Pacifism is trafficking with the enemy

Contempt for the weak

Everybody is educated to become a hero

Machismo and weaponry

Selective populism

Ur-Fascism speaks Newspeak.

বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়েও বোঝা যায়, মূলত সমস্ত বিরোধী স্বরের প্রাতিষ্ঠানিক কণ্ঠরোধ, অন্য বা অপর মতের প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞা, যা কিছু আপাতভাবে বীরত্বব্যঞ্জক নয়– যেমন অপর-যৌনতা প্রভৃতিকে অস্বীকার, জটিলতাকে প্রত্যাখ্যান প্রভৃতিই ফ্যাসিস্টের চারিত্র্য।

ওয়াল্টার ল্যাকুয়ার আবার উগ্র জাতীয়তাবাদ, লিঙ্গবৈষম্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভোটে কারচুপি, সর্বোচ্চ নেতাকে দেবতার মতো করে মহিমান্বিত করা, সংবাদমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ প্রভৃতিকে ফ্যাসিস্ট লক্ষণ বলে ব্যখ্যা করেন।

বস্তুত গবেষক এবং ঐতিহাসিকেরা একটা জিনিসের প্রতি বারবার জোর দিয়েছেন। হিটলার মুসোলিনির পতনের হাত ধরেই ফ্যাসিবাদ পৃথিবী থেকে দূর হয়নি। ফ্যাসিবাদ বস্তুত এমন এক প্রবণতা যা হয়তো মানুষের অবচেতনের উগ্র আধিপত্যকামিতার বহিঃপ্রকাশ।

কিন্তু এর একটি নির্দিষ্ট ডিসকোর্স রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। নাৎসিরা কালচারাল বলশেভিজমের ((Kulturbolscbetvismus) বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করে। অথচ মজার ব্যাপার হল, নাৎসিদের অপছন্দের সাংস্কৃতিক পরিসরগুলি কোনও দিক থেকেই বলশেভিক ছিল না। কারণ সেগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নেও একইরকমভাবে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিল। সাহিত্য শিল্প সংগীতে আধুনিকতাবাদ, মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি জিনিসগুলি নাৎসিরা যেমন ভালো চোখে দেখেনি, তেমনিই বলশেভিকরাও দেখেনি। কারণটা খুব পরিষ্কার। যা কিছু মানুষের মনে মুক্তচিন্তার খোরাক জোগায়, তাকে সমস্ত রাষ্ট্রই ভয় পায়। সমস্ত রাষ্ট্রই সবসময় রাষ্ট্রদ্রোহিতার ভূত দ‍্যাখে। কারণ একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাচার এই সমস্তই আদপে ভীষণ ভীতু। সে জানে যে-কোনো সময়, সামান্য ফুৎকারে উড়ে যেতে পারে সে। অস্ত্রের থেকেও, পররাষ্ট্রের থেকেও তাই মুক্তচিন্তা, যুক্তি, বুদ্ধি, সর্বোপরি মুক্ত সংস্কৃতিকে সব রাষ্ট্রই ভয় পায়। কারণ, হয়তো রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যেই পরম অনিবার্যতায় যুক্ত হয়ে পড়ে ফ্যাসিবাদী কলকব্জা। নাৎসিরা বই পুড়িয়েছিল, সমস্তরকম "decadent art"-কে সরিয়ে দিয়েছিল জার্মানির বুক থেকে, বিদেশে বেচে দিয়েছিল বহু শিল্প। জার্মানির সাংস্কৃতিক জীবনকে হতেই হবে বিশুদ্ধ আর্য ভাবধারার বাহক, জার্মানির ধ্রুপদি সংস্কৃতির মহিমা বারবার গেয়ে যেতে হবে সুতীব্র সুরে, এমনই ছিল হিটলারের বাসনা।

আরও পড়ুন


তবে কি শুধু হিটলার? বুদ্ধিজীবী বিরোধিতার স্বর তীব্র হয়ে উঠেছিল আমেরিকাতেও। যদিও তার প্রেক্ষিত ছিল আলাদা। এই বিষয়ের ওপরেই বই লিখে পুলিৎজার পেয়েছিলেন Richard Hofstadter। বইয়ের নাম Anti-intellectualism in American Life।

যে-কোনো ক্রিয়ারই থাকে সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া। ফ্যাসিজম যদি শিল্পের ওপর আগ্রাসী হয়ে ওঠে তবে শিল্পও চুপ থাকবে না। সে দেখিয়ে দেবে লাঠির মুখে গানের সুর। হয়তো, কবি বিভাস রায়চৌধুরীর ভাষা ধার করে বলতে চাইবে,

রাষ্ট্র তোমার অনেক পুলিশ
আমার শব্দ। শব্দ আনি?
বাঙালের ছেলে কবিতা লিখছি
এটাই আমার চোখরাঙানি।

১৯২৮-এ টি এস এলিয়ট লিখলেন ইতালীয় ফ্যাসিবাদের ওপর চারটি পাঁচটি লেখার এক সুদীর্ঘ রিভিউ। যা প্রকাশিত হল Criterion-এর ডিসেম্বর সংখ্যায়। J. S. Barnes-এর The Universal Aspects of Fascism (1928), Aline Lion-এর The Pedigree of Fascism (1927), Gaetano Salvemini-র The Fascist Dictatorship in Italy(1927), Luigi Sturzo-এর Italy and Fascism(1926), Luigi Villari-এর The Fascist Experiment (1926) এই “literature of Fasism” ফ্যাসিবাদের বিস্তৃত ব্যাখ্যা।

বস্তুত বিশ শতকের তিরিশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই সমস্ত পৃথিবী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একজোট হতে থাকে। ১৯৩১-এ জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ, জার্মান গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে হিটলারের ক্ষমতায় আসা এবং নাৎসি শাসন, ১৯৩৫-এ ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণ ইত্যাদি দেখেই সমস্ত পৃথিবী জুড়ে বুদ্ধিজীবীরা একজোট হচ্ছিলেন। ১৯৩৫-এর ২১ জুন প্যারিসের hall of Mutualite-তে সারা পৃথিবীর ২৪০ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে গড়ে ওঠে World Congress of Writers for defense of Culture। শিল্পের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিরোধী স্বরগুলো তুলে আনাই ছিল তাঁদের লক্ষ‍্য। ১৯৩৭-এ রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠিত হল League against Fascism and war। ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের থেকে শুরু করে অরণি পত্রিকা– বাংলার ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতার ঐতিহ্য খুব উজ্জ্বল।

আসলে ফ্যাসিবাদের মূল লক্ষণগুলির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল শিল্পের প্রতি অমোঘ ভীতি। কারণ সমস্ত আধিপত্যের ভিত নড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা শিল্পের আছে। ফ্যাসিস্টদের মুক্তচিন্তা-বিরোধিতার তাত্ত্বিক কারণগুলো সেইখান থেকেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আবার পৃথিবীতে বারবার শিল্পী-সাহিত্যিকরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। মারা গেছেন। তবু কথা বলা থামাননি। অন্ধকার সময়ে অন্ধকারের গান বুনে গেছেন পরম মমতায়। রাষ্ট্র তাঁদের দিকে ছুড়ে মেরেছে কারাদণ্ড, তবু ভয় পাননি তাঁরা। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন অনেকে। তবু তাঁরা বেঁধে গেছেন প্রত্যাখ্যানের আখ্যান। ফ্যাসিবাদের ন্যারেটিভের পাশে সেই কাউন্টার ন্যারেটিভগুলি মিলিয়ে পড়লে বোঝা যায়, যতদিন রাষ্ট্রীয় শোষণ ঠিক ততদিনই বিপ্লব। যতদিন বিরুদ্ধ স্বরকে স্তব্ধ করার প্রক্রিয়া ঠিক ততদিনই সত্যজিতের চরণদাস। যে হীরক রাজের সামনে বলে উঠবে– গান শেষ আর জান শেষ তো একই কথা রাজামশাই।


কৃতজ্ঞতা–
Fascism : past, Present , Future, Walter Laqueur, OXFORD UNIVERSITY PRESS
UR-FASCISM , Umberto Eko, (http:/nybooks.com/articles/1856).


[ কভার ছবিঃ অর্পণ দাস ]

#বাংলা #নিবন্ধ #ফ্যসিবাদ #রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বিরোধী লেখাগুচ্ছ #fascism #নিওফ্যাসিজম #পোস্ট ফ্যাসিজম #The New York Review of Books #UR-FASCISM #উমবের্তো একো #ওয়াল্টার ল্যাকুয়ার #হিটলার #মুসোলিনি #Kulturbolscbetvismus #decadent art #Richard Hofstadter #Anti-intellectualism in American Life #বিভাস রায়চৌধুরী #টি এস এলিয়ট #J. S. Barnes #The Universal Aspects of Fascism #Aline Lion #The Pedigree of Fascism #Gaetano Salvemini #The Fascist Dictatorship in Italy #Luigi Sturzo #Italy and Fascism #Luigi Villari #The Fascist Experiment #literature of Fasism #hall of Mutualite #World Congress of Writers for defense of Culture #League against Fascism and war #ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘ #অরণি পত্রিকা #জুজু #রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন-বিরোধী লেখাগুচ্ছ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

44

Unique Visitors

219187