'ছেলে' আর 'মেয়ে' হওয়ার সিলেবাস বদলাবে না?
অনেকেই পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে পুরুষ, আর নারীবাদের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক খোঁজেন। ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্ট করে বললে এইরকম দাঁড়ায় যে, পুরুষ মানেই সে পুরুষতান্ত্রিক আর মেয়ে, মানে নারী– অর্থাৎ সে তো নিশ্চয়ই নারীবাদী। সেখান থেকে এই ধরনের কথাগুলো উঠে আসে যে, "মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সাথে এরকম করতে পারল", বা, “মেয়েরাই মেয়েদের বড় শত্রু”। এরকম কথাগুলো আসলে এই জায়গা থেকে আসে যে, মেয়ে হিসেবে জন্মেছে মানে তার নিজের জেন্ডার আইডেন্টিটির লোকজনের প্রতি সহমর্মিতাবোধ থাকবে। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। পুরুষতন্ত্র এবং নারীবাদ দুটোই নিজের চারপাশকে দেখার এবং বিচার করার আলাদা আলাদা দর্শন, এবং তার সঙ্গে সেই দর্শনে বিশ্বাসীদের লিঙ্গ-পরিচয়ের সম্পর্ক থাকা বাধ্যতামূলক নয়।
এই ব্যাপারে কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে :
দর্শনের সাথে লিঙ্গপরিচয়ের কোন সম্পর্ক নেই বলেই মেয়েদের স্কুলের একজন শিক্ষিকাও কোনও মেয়ের স্কার্টের দৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তি করে সেই মেয়েটিকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিতে দুবার ভাবেন না। ক্লাস সিক্স বা সেভেনের কিশোরীকেও বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে তার শরীর ঢেকে রাখার জিনিস। একটা নির্দিষ্ট ‘বিপদসীমা’র বাইরে হাত বা পা দেখে ফেললেও তার চরিত্রস্খলন হয়। তাকে খারাপ মেয়ে হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যায়। এবং এই ধরনের কথাবার্তা শুনতে শুনতে একসময় সেই মেয়েটি বিশ্বাস করতে শুরু করে– তার সঙ্গে যাবতীয় যা খারাপ ঘটনা ঘটছে, তার জন্য সে নিজে দায়ী। প্রতিটা মলেস্টেশনের ঘটনায় সে আরও গুটিয়ে যেতে থাকে। আশেপাশে সমান তালে চলতে থাকা ভিক্টিম ব্লেমিং তার সেই ভয়ের পালে যে হাওয়া দেয়, সে তো বলাই বাহুল্য। সে ভাবতে শেখে, তার পোশাক-আশাক, চাল-চলন, আচার-আচরণ ঠিক নয় বলেই তার গায়ে লোকে তার অনুমতি ছাড়া হাত দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, বা, হয়তো, তার দোষেই তার মলেস্টারদের মধ্যে এই পারভার্সন জেগেছে। আমার মনে হয় না, একই বয়সি কোনও বাচ্চা ছেলের হাফপ্যান্টকে কেউ তার চরিত্রবিচারের মাপকাঠি বলে ভেবেছে বলে।
পিরিয়ডস হলে কী কী নিষেধ মেনে চলা উচিত, সেই শিক্ষাও মেয়েদের তাদের পূর্বনারীরাই দিয়ে থাকেন। স্বাভাবিক একটা শারীরিক প্রক্রিয়াকে তাদের স্বাভাবিকভাবে নিতে শেখানো হয় না। অবচেতনে নিজের শরীরকে নোংরা ভাবতে শেখে তারা। ছেলেরাও তাই দ্যাখে– মেয়েদের এই বিষয়গুলো সামনে আসতে দিতে নেই, কিন্তু পিছনে এই নিয়ে হাসাহাসি করাই যায়। আমায় আমার এক বন্ধু বলেছিল (সে ছেলেদের স্কুলে পড়ত), পিরিয়ডসের সাথে তাদের প্রথম পরিচয় নাকি অশ্লীল চুটকির সূত্রে। এত লুকোচুরি আছে বলেই বাস্তবের সাথে আন্দাজের দূরত্বও বাড়ে।
মেয়েদের সাথে মলেস্টেশনের ক্ষেত্রে যেমন একটা বিশেষ সিস্টেম এটাই বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে যে, এই ঘটনার জন্য ভুক্তভোগী নিজে দায়ী, তেমনই ছেলেদের ক্ষেত্রে তাদের ছোট থেকে বোঝানো হয় তাদের শক্ত হতে হবে। কাঁদা যাবে না। একদম আলাদা করে বলা থাকে ‘মেয়েদের গায়ে হাত তোলা যাবে না’। এরকম আরও অনেক কিছু। তাদের ছোট থেকেই মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়– তারা সবল, মেয়েরা দুর্বল। যে সিস্টেম বাচ্চা ছেলেদের বারণ করে মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে, তারা কিন্তু মেয়েদের ছেলেদের গায়ে হাত তুলতে বারণ করে না। কিন্তু ছোট থেকে দুর্বল হিসেবেই গণ্য হতে হতে, মেয়েরা ছেলেদের চোখে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকেই পর্যবসিত হয়। ‘ভদ্রবাড়ির ছেলেরা’ মেয়েদের গায়ে অনেক ক্ষেত্রেই হাত তোলে না বটে, কিন্তু নিজেদের তারা এই দুর্বল প্রাণীদের ‘saviour’ ভাবতে শেখে।
একইভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে মলেস্টেশনের পর ভিকটিম ব্লেমিং থাকলেও, হ্যারাসমেন্ট যে হয়েছে সেটা একরকম মেনে নেওয়া হয়, সাধারণত। উলটোদিকে, ছেলেদের অনেকের সঙ্গেই একই ধরনের ঘটনা ঘটলেও, তারা বলতে সাহস পায় না। একে তো ছেলেদের তো শক্তপোক্ত হওয়ার কথা, সেক্ষেত্রে, এই ঘটনার টার্গেট তারা কীভাবে হতে পারে? শারীরিক বা মানসিকভাবে যথেষ্ট শক্ত হতে না পারা, বা সেন্সিটিভ হওয়া মানে ছেলেটার পুরুষত্বে ঘাটতি থাকা, এমনটা এখনও অনেকে মনে করেন; সেই ‘দোষে’ মেয়েলি বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। এটা যে সম্মানজনক বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় না, তা তো বলাই বাহুল্য। অথচ, ছেলেদের অভব্যতা, অশ্লীলতা, বা, রুক্ষতা কিন্তু প্রায় সবার কাছেই ‘আহা, পুরুষমানুষ!’-এর ছায়ায় প্রশ্রয় পায়।
দ্বিতীয় কারণটাও প্রথমটার সাথে সম্পর্কিত। মেয়েদের ক্ষেত্রে ধর্ষণ বা নির্যাতনের খবরকে যথেষ্ট সিরিয়াস খবর হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু কোনও ছেলের সাথে হওয়া শারীরিক অত্যাচার কিন্তু এখনও সামাজিক মাধ্যমে মিম মেটিরিয়াল বলেই পরিগণিত।
ছেলে আর মেয়েদের কথা বললাম। কিন্তু এই দুই বাইনারির বাইরে আরও যে-সব লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষ আছেন, এখনও সমাজের একটা বড় অংশ তাঁদের অস্তিত্বও স্বীকার করতে চায় না। তাঁদের জন্য এই লড়াইটা আরও অনেক কঠিন।
আসলে ছোট থেকেই এভাবে বাচ্চাদের মনে একটা বিভেদের বীজ বপন করে দেওয়া হয়। আমাদের মূলত ছেলে আর মেয়ে এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করে বড় করা হয়ে থাকে। সমাজ তাদের জন্য আলাদা আলাদা জগৎ, আলাদা আলাদা কর্তব্য ঠিক করে রেখেছে। এই দুই শ্রেণির একটিকে সমাজ তাদের আরোপিত Superiority-র ফ্রেমে আঁটাতে ব্যস্ত, অন্যরা যাতে আবার তাদের inferiority-র খাঁচা থেকে বেরিয়ে না পড়ে, সেদিকেও তাদের কড়া নজর থাকে।
সমাজের চোখে যেহেতু মেয়ে হওয়ার কিছু নির্দিষ্ট মাপকাঠি আছে, সেহেতু যেসব মেয়েরা সেটার সাথে ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না, বয়ঃসন্ধির সময় তারা অনেকেই একটা অদ্ভুত দোলাচলে ভোগে। মেয়েরা ‘ন্যাকা’ হবে, তারা কথায় কথায় কাঁদবে, তারা দুর্বল, তারা বিনা কারণে ঝগড়া করে, খেলাধুলার ব্যাপারে তাদের খুব একটা আগ্রহ নেই, এইরকম একটা ধারণা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব বাচ্চাদের মাথায় ঢুকে যায়। তখনই কারও কারও মনে হতে থাকে যে, তারা বাকি মেয়েদের মতো নয়। কারণ, বাকি মেয়েদের মতো হওয়া মানে তো ‘নিকৃষ্ট’ কিছু বৈশিষ্ট্য বয়ে চলা। নিজের জেন্ডার আইডেন্টিটিকে inferior ভাবার দিকে আরেক পা এগোয় তারা। কোন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষ কীরকম হবে, কী পছন্দ করবে– সবকিছুই তার ছোটবেলা থেকেই ঠিক করে রাখা থাকে। যে কারণে চোখে পড়ে, একদম ছোটবেলা থেকেই ছেলে আর মেয়েদের জামাকাপড়, এমনকি খেলনা, বা বেশিরভাগ জিনিসপত্রের রং পর্যন্ত আলাদা। রঙের মধ্যেও ‘পুরুষালি’ এবং ‘মেয়েলি’-র সীমারেখা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়।
দীর্ঘদিন ধরে লালিত এই বিভেদ এক-একজনের মনে এক-একরকম প্রভাব ফেলতে পারে। ‘superior’-দের কেউ নিজেকে রক্ষক আবার কেউ নিজেকে ভক্ষক হিসেবে দেখতে শুরু করেন। দুর্বলদের প্রতি এদের অ্যাপ্রোচ আলাদা আলাদা হলেও, এক জায়গায় গিয়ে তারা দুজনেই একই পথের পথিক। রক্ষক এবং ভক্ষক দুই দলই বিশ্বাস করে যে দুর্বলেরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, তারা নিচে থাকার যোগ্য। শুরুতে নারীবাদ আর পুরুষতন্ত্র নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেই সূত্রেই বলি, প্রথম দর্শনটি প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার, সমান সম্মান, সমান সু্যোগে বিশ্বাস রাখে। আর দ্বিতীয়টি পুরুষকে সামাজিক পিরামিডের চুড়োয় বসিয়ে রাখে। এই সিস্টেমে কোনও সমতা নেই। এখানে পুরুষের ‘Provider’ হওয়াটাও কিন্তু বাধ্যতামূলক।
এই ভাবনার শিকল ছিঁড়তে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় যৌন শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। বাচ্চাদের শেখা দরকার, লিঙ্গপরিচয়ের মধ্যে শুধু পুরুষ বা নারীই থাকে না। বড় হতে হতে সবার শরীর কীভাবে বদলাচ্ছে, সেটার সম্পর্কেও স্পষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। যাতে কারও শরীরই কারও কাছে অশ্লীল ‘খিল্লি’ আর ভোগের পরিসরেই সীমাবদ্ধ না থাকে। পাশাপাশি, আলাপচারিতার সময়ে আমাদের এটাও খেয়াল রাখা প্রয়োজন– যেন কারও দুর্বলতা বা কলুষতার কথা বলতে গিয়ে বিশেষ কোনও লিঙ্গপরিচয়ের সঙ্গে তার তুলনা না করে ফেলি।
সেই সঙ্গে, কনসেন্ট বিষয়টার সঙ্গেও সব বাচ্চারই পরিচয় করানো দরকার। যাতে, কেউ তাদের সাথে শারীরিক বা মানসিকভাবে কোনও অন্যায় করলে, তারা সেটাকে ভুল বলে বোঝে, এবং প্রতিবাদ করতে পারে। পাশাপাশি, নিজের শরীরকে সাজানোর ব্যাপারে নিজেদের পছন্দকেই যেন তারা গুরুত্ব দিতে শেখে, যাতে নিজেদের উপর ঘটে চলা কোনও অন্যায়ের জন্য তারা নিজেদের নয়, বরং অপরাধীকেই দায়ী করতে পারে।
ধর্ষণের পর অপরাধ আর অপরাধীর বিরুদ্ধে কথা বলা যত জরুরি, ধর্ষণ ঘটে যাওয়ার আগেই আমাদের ‘ছেলে’ আর ‘মেয়ে’ হয়ে ওঠার চেনা সিলেবাসটাকে খতিয়ে দেখাও কিন্তু কম জরুরি নয়। কে না জানে, প্রিভেনশন ইজ অলওয়েজ বেটার দ্যান কিওর!
...................
#Gender Politics #RG Kar #Reclaim the night #স্পর্ধা #series #silly পয়েন্ট