বইয়ের খবর

মূলস্রোত চেনেনি যে মাটিকে : সামাজিক-সাংস্কৃতিক বীক্ষণে অভিমন্যু মাহাতর কাব্যগ্রন্থ ‘মাটি’

অর্পণ দাস Feb 6, 2021 at 5:23 am বইয়ের খবর

বই : মাটি কবি : অভিমন্যু মাহাত প্রকাশক : সিগনেট প্রেস

এই তো করোনাভাইরাস অতিমারীর কিছুদিন আগের কথা। গোটা ভারতবর্ষ উত্তাল নাগরিকত্ব বিলের ঘটনা পরম্পরায়। সত্যিই তো, কারা ভারতবর্ষের নাগরিক? আধার-ভোটার-পাসপোর্ট কী দিয়ে প্রমাণ করব যে আমি ভারতবর্ষের নাগরিক? অবশ্য আমরা সবাই জানি যে, এগুলোর কোনোটাই না। আর্য জাতির বর্ণ সংকরের প্রতিনিধি হলেই আমি নিরাপদ নাগরিক! কিন্তু তার আগে? মানে এই গর্বোদ্ধত আর্য সভ্যতার প্রতিষ্ঠার আগে? যারা ভারতবর্ষের অরণ্যে-পর্বতে হাজার-হাজার বছরের অধিবাসী, সেই আদিবাসীরা যদি আমার-আপনার ‘নাগরিকত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন তোলে? ভয় পাবেন না, আমরা তো মূল স্রোতের মানুষ। বাড়াবাড়ি করলে দেব সেনা লেলিয়ে। ওদের দিকে সহানুভূতির রুটি ছুঁড়ে দিয়ে, ওদের গবেষণার বিষয় করে রেখে নিজেকে ধন্য ভাবে আজকের ভারতবর্ষ। তাই একই ভূখণ্ডে থেকেও ওঁরা আমাদের কাছে কত অচ্ছুৎ, কত অচেনা। কবি অভিমন্যু মাহাতো ভারতের সেই চিরকালীন ভারতবর্ষের প্রতিনিধি। যিনি ‘মাটি’ কাব্যগ্রন্থে তাঁর  পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ প্রান্তের রক্তবর্ণ রুখা-শুখা মাটির কাছে আমাদের নিয়ে যান। কবিকে ধন্যবাদ তিনি তাঁর আদিভাষা কুড়মালির পাশপাশি মূলস্রোতের ভাষা বাংলাকেও গ্রহণ করেছেন তাঁর কাব্যচর্চার জন্য। আজকের অভিমন্যু বৈষম্যের সমস্ত চক্রব্যূহকে ভেঙে এগিয়ে চলেছেন তাঁর কাব্যচর্চার আকরকে খোঁজার লক্ষ্যে।

অভিমন্যুর হাত ধরে ফিরে আসি প্রাচীন ভারতবর্ষে। যার প্রতিটি পংক্তি, প্রতিটি শব্দ ‘আমাদের’ সভ্যতার ফুসফুসকে একটা অচেনা সুগন্ধি বাতাসে ভর্তি করে দেয়। যার ‘বাহির’-এর সাথে আমাদের সামান্য পরিচয় থাকলেও, অন্দর সম্পর্কে আমরা একেবারেই অনভিজ্ঞ। অভিমন্যু আমাদের নিয়ে যান প্রতিটা ঘরে ঘরে। আলাপ করিয়ে দেন প্রতিটা মানুষের সাথে। আমরা অবাক হয়ে দেখি,

“কুড়মি বউয়ের গালে ক’ছটাক লজ্জা মিশে আছে

খিল জমি এসবও ভেবে দেখে

দূর থেকে দূরে রাতচরা পাখির

চঞ্চল আলপনা।


নাগর ডাক দাও হে

দেখবে কি করুণ রাত্রির সিঁদুর...।” (জমি)

কিন্তু ডাক দেয় ‘জঙ্গল পার্টির’ গামছা দিয়ে মুখ ঢাকা মানুষগুলো। রাতের অন্ধকারে তারা বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে আসে, সঙ্গে মুখ না খোলার হুমকি। ভাতের লোভে আর ভয়ে অনেকেই যোগ দিল তাদের সঙ্গে। কোথাও একটা বিশ্বাসও ছিল যে এতদিনের অবহেলার থেকে হয়তো একটা মুক্তি মিলবে। তারপর শুরু হল অপারেশন গ্রিন হান্ট—পাতি কথায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। তাদের কুচকাওয়াজে হলুদ হয়ে গেল বাবুই ঘাস। তুষের আগুনে ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে গেল সমকাল। অনর্থক সন্দেহে ভর্তি হয়ে গেল জেল-গারদ। সেই রাগ, ঘৃণা থেকেই কবি লেখেন,

“কখনও দুই ঠ্যাং ফাঁক করে দাঁড়ায় সরকারি উর্দি

আমাদের জন্ম, খোলস খুলে নিয়ে যায়

নষ্টবাড়ি, দাসত্ব হাতকড়ি…

…কারা যেন করাত চালায়, আমাদের ধরে আছে ঋণের শরীর”

  (আমাদের)

তাদের জন্ম, মৃত্যু, জীবিকা, উৎসব, প্রেম সবই নির্ণীত হতে থাকল এই দুই দলের শকুনি নজরের সামনে। দুই দিকেই শক্তিশালী বিপদ, আর মাঝে খুড়োর কলের মত মায়াময়ী পুনর্বাসন প্যাকেজ। মানুষ নয়, যেন খবরের কাগজের খোরাক হয়ে জীবন কাটতে থাকে অসহায় মানুষের। কবি লেখেন,

“আমরা শুনতে চাই না খসে পড়া দেওয়ালের স্লোগান

আমরা দেখতে চাই না প্রভাতি কাগজে উন্নয়নের বিজ্ঞাপনী ফর্দ”

      (জঙ্গলমহল)

রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রদ্রোহী কেউই এই মাটিকে চেনে না। চেনে না মূলস্রোতের মানুষরাও। মাটিতে বীজ ছড়িয়ে ভাত খোঁজার অর্থ তারা জানে না। জানে না গরম ভাতের জন্য অপেক্ষা কতটা লোভনীয়। 

কিন্তু যুগ যুগান্তরের এত অত্যাচার, এত দারিদ্র এই মানুষগুলোর মুখের হাসিকে ম্লান করতে পারেনি। কোনো হা-হুতাশ নেই, অনুযোগ নেই, দোষারোপের টেনিস খেলা নেই। পুরনো স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কবি নিঃসঙ্কোচে বলেন, “এই তো সেদিন ধানের মৃদু খামার ভরে যেত/ গাঢ় উচ্চারণে।” ছোটো খামার বাড়িও ভালোবাসার বিশ্বাসে পূর্ণ হয়ে উঠতো। এই সেদিনও হতো সেটা, আজ আর হয়না, কিন্তু তাতেও যেন কোনো আফসোস নেই। তাই “শেষবেলায় পাঁচ ভাইবোন আমরাও/ কাঁথার উপর ছড়িয়ে দিই/ বাটা হলুদ।” এই ক্ষতস্থানে হলুদ ছড়িয়ে দেওয়ার অর্থটা বুঝে নিতে আমাদের খুব একটা কষ্ট হয়না। আসলে কষ্ট হয় এই খাদ্যাভাবটাকে মেনে নিতে। কিন্তু ওরা হাসি মুখে সব কিছুকে মানিয়ে নিতে শিখে ফেলেছে। এটাই বোধহয় মাটির গুণ, মাটির মতই সহিষ্ণু তারা।

আরও পড়ুন : ভারভারা রাওয়ের জেলজীবনের আখ্যান : ‘CAPTIVE IMAGINATION’

কবি অভিমন্যু এই ‘নেই’-এর দেশের মানুষ। কিন্তু ‘না’-এর মধ্যেও যে কতটা পূর্ণতা থাকতে পারে তা তাঁর কবিতায় বুঝিয়েছেন অভিমন্যু। জঙ্গলের মানুষ আসলে ‘দরদিয়া হাত’ - “... অকস্মাৎ/ থেমে গেলে তাল... পাশেই পাবে/ দরদিয়া হাত”। এদের অপূর্ণতাকে পূর্ণ করেছে প্রকৃতি নিজে। আদরে আবদারে, প্রেমে উৎসবে জঙ্গল দু-হাত মেলে তাদেরকে আলিঙ্গন করেছে। অভিমন্যুর কবিতায় সেই জঙ্গললালিত সংস্কৃতি, ভাষা, আচার, আচরণ উঠে এসেছে। আমাদের ‘ছৌ’ তাঁর কাছে হয়ে যায় ‘ছো’। অনাহার তাঁর কাছে নৈমিত্তিক, উৎসব তাঁর কাছে নিত্য। কত সাবলীল তাঁর উচ্চারণ,

“ছেঁড়া মুখোশের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়েছে জোছনা

জোছনার ভেতর আরেক পালা, আরেক আসর

বিষাদ ভরা এক চোখ বন্ধ করি” (ছো)

এই বিষাদকে ঘোচানোর জন্যই আসে আমন ধানের উৎসব। যা এলে তাঁর যোগীবাবার গোঁফটা হাসিতে ভরে উঠতো, মাটির পাত্রে হাঁড়িয়া নেচে উঠতো। আর ‘ঝুনপুকির গোলবাটি’ হাতে তাঁর মা ভাদুগীতে যেত। আর খোলা এক চোখে কবি লালদানার ভাতের স্বপ্ন দেখতেন - 

“অলিপি গীতের কোলাহল কিংবা গোয়ালে গাভীর মমতা ডাকে

রুনুঝুনু কার্তিকের জিংলা শাল আর আশিনলয়ার ধান

ঘুমপাখির মত ঝরে পড়ে।” (কৃষিকর্ম)

বাংলা কবিতায় এরকম স্বপ্নবিভোর চোখে কে কবে বলেছে ‘আশিনলয়ার ধান’-এর কথা? কে কবে বলেছে ‘ফুদুক ফুদুক কুলার বাতাসের কথা’? কেউ বলেনি বলেই বোধহয় তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে আসে অহিরা গীতের কথা, আসে ‘মাদৈল’-এর কথা, আসে টুসুর কথা। আর আবিলতার সাথে বলেন ‘মকর’-এর কথা - 

“আজ মকর

পরব ঢেলে দেয় অজানা সুখনদীর তীরে তীরে

                কিশোরীদের চঞ্চলতা, টুসুগান ও মাদৈলের বোল


                কী আছে এই মকর পরবে। আমার মনে পড়ে

                চৌডলের চারিদিকে অশ্রুকণাময় কিশোরী

                গৈড়টাড়া পিঠার পাশে ফসলের দিন...” (মকর)

এই স্মৃতি কি শুধুই নস্ট্যালজিয়া! নাকি এক অসহায় পাপবিদ্ধ যন্ত্রণা তাঁকে ক্ষত-বিক্ষত করছে? পেশায় সফল সাংবাদিক কবি যে আজ ‘আমাদের’। সেই মাটির থেকে অনেক দূরে তিনি নাগরিকতায় দূষিত। কোথাও একটা শিকড় দুর্বল হওয়ার গন্ধ পান তিনি। অনুভব করেন পাতায় যেন দ্বিমুখী টান। প্রার্থনা করেন, “সেইখানে নিয়ে চলো প্রিয় কাক, যেখানে/ ঝিনুকে পা কেটেছিল তোমার আমার”। কিন্তু তারপরেও তাঁকে ফিরে আসতে হয়। হয়তো ঘুম থেকে জেগে উঠে বহু আর্তনাদের বহু দেনা তিনি শোধ করতে পারবেন না কোনোদিন। তবুও ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে তিনি দেখেন তাঁর মায়ের কাঁথার মধ্যে বিপদের মতো বাড়ছে মাকড়সার ডিম্বাণু। তাই পুরাণের কৃষ্ণপদ ছাপকে তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। দ্বিধাহীন স্বরে তিনি পুনর্জন্মের বাসনা জানান,

                   “তিক্ত ভাত ও ছেঁড়া কাঁথা আমাদের দীর্ঘ পুরাণ।

                     লৌকিক বাদুড় সংসারে

                     আবার আমি জন্মগ্রহন করি।”   (লৌকিক)

এই সব কিছু নিয়েই অভিমন্যুর জীবন, তাঁর ‘মাটি’র কবিতা। এই মাটিতেই কখনও তাঁর খড়কুটোর মত মৃত্যুশয্যা, কখনও নীল নির্বাসনের গলিত আঁধার। কখনও বন্দুক উচিয়ে শাসানি, কখনও জীয়ন কাঠি বাঁশির মন ভোলানো সুর। দারিদ্র্য আর অত্যাচারকে মাথায় নিয়েও মাটিতে পা রেখে শাল বৃক্ষের মত মাথা উঁচু করে বাঁচার মরিয়া প্রয়াসই কবির মত আরও অসংখ্য মানুষের জীবনের সমস্ত অপূর্ণতাকে ভরিয়ে রেখেছে। সেদিন কবির সমস্ত স্বপ্ন পূরণ হবে যেদিন আদিবাসী ছেলেরা নিখরচায় পড়াশোনা করবে, ছৌ নাচ শিখবে, ফুটবল খেলা শিখবে। কবিতা, আঁকার চর্চা হবে, সাহিত্যের আসর বসবে। সেদিনের জন্যই যেন কবি আগে থেকেই লিখে রাখেন,

“এ টুসু দেবী নয়, মাটি নয়, মেয়ে নয়

একটি সুর, একটি গীতবিতান

কাঁদতে কাঁদতে

নদীর জলে লুকিয়ে পড়ে

শোক ও উৎসবে।” (মকর/দুই)


#অভিমন্যু মাহাত #মাটি #সিগনেট প্রেস #বইয়ের খবর #বই রিভিউ #Book Review #অর্পণ দাস #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

26

Unique Visitors

219140