কবির হাত শিকলে বাঁধা পড়ে না
একুশে আইনের দেশে ভুল করে কবিতা লিখে ফেলার শাস্তি ছিল খাঁচার মধ্যে ঢুকে মুদির খাতায় টানা একুশ পাতা হিসেবনিকেশ করা। কল্পনার জগতে আকছার গতিবিধি যে মানুষগুলোর, বন্দিদশায় অঙ্ক কষার মতো নীরস কাজ করাটা সেই কবিদের পক্ষে কতখানি মর্মান্তিক, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তার চেয়েও মর্মান্তিক বিষয় হলো এই যে, এ হেন রাজ্যের উপস্থিতি কেবল সাহিত্যের পাতাতেই সীমিত নয়। হ্যাঁ, একুশে আইনের দেশ রয়ে গেছে আমাদেরই আশেপাশে, নানা রূপে, নানা চেহারায়। আর সে দেশের রীতি মেনেই গোটা পৃথিবী কবি ও কবিতার ওপর রাষ্ট্রীয় খবরদারির নজিরও দেখে আসছে স্মরণাতীতকাল থেকে।
ভারভারা রাও আর চেরাবান্দা রাজুকে নিয়ে সদ্য উত্তাল দেশের ক্ষোভের সঙ্গে আমরা এখন সকলেই অল্পবিস্তর পরিচিত। তবে রাষ্ট্র কর্তৃক কবিদের স্বাধীনতা খর্ব করার ইতিহাস নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক ইতিহাসকে ছাপিয়ে আজ প্রথমেই তাই বলব আর এক কবির কথা, যাঁর জন্ম সপ্তদশ শতকের ভারতে। মহারাষ্ট্রে।
ভাষা যখন তার চেনা শরীর, চেনা ধরন আর চেনা বিষয় ছেড়ে অন্য কোনওভাবে নিজেকে প্রকাশের চেষ্টা করে তখন সেই বিচ্যুতি থেকেই জন্ম হয় কবিতার। কবিতার কাজ স্বভাবতই নিয়ম ভাঙা। এদিকে সমাজ তৈরিই হয় নানাবিধ নিয়মের বেড়াজালে। সে প্রত্যাশা করে নিয়মের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য। ফলে কবিতা ও সমাজের মধ্যেকার সম্পর্ক কোনওদিনই খুব একটা মসৃণ নয়। এ সম্পর্ক মসৃণ ছিল না মধ্যযুগের ভারতেও। ইতিহাসের পাতায় সপ্তদশ শতাব্দীর ভক্তি সাধক ও কবি হিসেবে তুকারামের পরিচিতি। ভক্তি আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সংকীর্ণতা, আচার অনুষ্ঠানের আড়ম্বর জটিলতা থেকে মুক্ত হওয়া। স্বভাবতই সহজভাবে ঈশ্বরের প্রতি প্রেমকে সম্বল করে উপাসনায় বিশ্বাসী ভক্তিসাধকদের প্রতি ব্রাহ্মণ্য ক্ষমতাতন্ত্রের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা সদয় ছিলেন না। তুকারাম নিজে ছিলেন অব্রাহ্মণ, তদুপরি কুনবি সম্প্রদায়ে তাঁর জন্ম। রাষ্ট্রের ও সামাজিক নানা রীতিনীতির অর্থহীনতা এবং অন্ধকার দিকগুলির কথা উঠে আসছিল তাঁর লেখা কীর্তন এবং 'অভঙ্গ' নামের কবিতাগুলিতে। তিনি বলতেন, জাতপাতের গুমোর কখনো পবিত্রতার সূচক হতে পারে না। বলতেন, ঈশ্বরের নামই সর্বস্ব, ভক্তের জাতিকুলে কিছুই এসে যায় না। আর এসবের অনিবার্য ফল ছিল সমাজের তীব্র বিরোধিতা। সেইসময় তাঁর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে মামবাজি নামে এক ব্যক্তি তুকারাম সম্পর্কে বহু নিন্দাসূচক কথা প্রচার করেন। অথচ তিনি তুকারামের সাহায্যেই তাঁর নির্মিত মন্দিরে পূজারির কাজ পেয়েছিলেন। শুধু নিন্দেতেই থেমে না থেকে একবার কাঁটাওয়ালা লাঠি দিয়ে তিনি তুকারামকে আঘাত করেন বলেও শোনা যায়। পরে অবশ্য এই মামবাজিই তুকারামের মুগ্ধ ভক্ত ও শিষ্যে পরিণত হন।
আরও পড়ুন
‘নতুন দিনের আলো’- বাজেয়াপ্ত বই
শিল্প বা শিল্পীর বিরুদ্ধে কোনও একক মানুষের বিরোধিতার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের বিরোধিতা। আর তুকারামের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্য ক্ষমতাকাঠামোর সেই মুখ হয়ে দেখা দিলেন রামেশ্বর ভট্ট। সাধারণ মানুষের বোঝার মতো করে প্রাকৃত ভাষায় বেদের ব্যাখ্যা করেছিলেন তুকারাম। অথচ সেইসময় কট্টর হিন্দুদের কাছে সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় বেদের চর্চা গুরুতর অপরাধ। তাই রামেশ্বর তুকারামের সব কবিতার পাণ্ডুলিপি নদীর জলে ডুবিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। কথিত আছে ডুবিয়ে দেওয়ার পর তাঁর সে সব লেখা নাকি অলৌকিকভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
জলে ডোবা পাণ্ডুলিপির ফিরে আসার ঘটনা হয়ত কল্পনা। কিন্তু বাস্তবেও কেবল কবিতা লেখা পৃষ্ঠা নষ্ট করে কবিতাকে মুছে ফেলা যায় না পৃথিবী থেকে। তা অক্ষত, অবিনাশী রয়ে যায় ভক্তপাঠকের মনে। তুকারামের কবিতাও বেঁচে ছিল, বেঁচে আছে বহিনা বাঈয়ের মতো অজস্র অনুরাগী ভক্তের হৃদয়ে।
রাষ্ট্রের পক্ষে কবিদের অপ্রয়োজনীয় মনে করে আদর্শ রাষ্ট্র থেকে আগেভাগেই কবিদের দূরে রাখতে চেয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের গুরু প্লেটো। আজ পর্যন্ত কোনও রাষ্ট্র থেকেই কবিসমাজকে একেবারে নির্বাসিত করা যায়নি ঠিকই, কিন্তু একেবারে উল্টোপথে হেঁটে গিয়ে কালচারাল অ্যাপারেটাস হিসেবে কবি বা কবিতাকে ব্যবহারের অসংখ্য উদাহরণও ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। ঘটমান বর্তমানেও।
রাষ্ট্র থেকে কবিদের সরিয়ে ফেলার কথা বলতে প্রথমেই মনে আসে স্প্যানিশ কবি লোরকার কথা। স্পেনে দক্ষিণপন্থী দলের উত্থানের সময়ে সরকারের রোষদৃষ্টিতে পড়েন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার পক্ষপাতী লোরকা। গ্রানাডার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা এতটাই অস্থির ছিল যে কেউই সেখানকার মেয়রের দায়িত্ব নিতে চাইছিলেন না। লোরকার আত্মীয় মন্তেসিনো এই পদে বসার সাতদিনের মধ্যেই খুন করা হয় তাঁকে। আর এই হত্যার পরের দিনই ১৯৩৬ এর ১৮ আগস্ট গ্রেপ্তার হন লোরকা। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯ আগস্ট।
"Then I realised I had been murdered
They looked for me in cafes, cemeteries and churches
...But they did not find me."
Poet in New York কাব্যে লোরকার লেখা এই লাইনগুলিকে যেন সত্যি করার জন্যই মৃত্যুর পর তাঁর কোনও দেহাবশেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও, লোরকা ব্যক্তিগতভাবে কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। উপরন্তু গণতান্ত্রিক এবং জাতীয়তাবাদী দলের অনেকের সঙ্গে তাঁর বেশ বন্ধুতাই ছিল। এমনকি, যে ফ্যাসিবাদী Falangist দলের খবরদারিতে 'Sonnets of Dark Love' তাঁর কাব্যসমগ্র (Obras Completas) থেকে বাদ যায়, সেই দলের দুএকজনের সঙ্গেও তাঁর ওঠাবসা ছিল বলে জানা যায়। ফ্যালানজিস্ট প্রেস থেকে ১৯৩৭-এ লোরকার মৃত্যুর পর প্রকাশিত একটি প্রবন্ধতে লেখা হয় "The finest poet of Imperial Spain has been assassinated."
লোরকা হত্যা তাই স্পেনে বিতর্কিত বিষয় হয়েই রয়ে যায়। প্রেমজনিত ঈর্ষা থেকে তৎকালীন দক্ষিণপন্থী ও ফ্যাসিবাদী দলের অন্তর্বিরোধ - এই সবকিছুকেই তাঁর হত্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দায়ী করা হয়েছে তাঁর সমকামী পরিচয়কেও। তাঁর হত্যার কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল ঠিকই। কিন্তু যে রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিয়ে কবিকে নিশ্চিহ্ন করতে হয়, সে রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী চরিত্র নিয়ে দ্বিধার অবকাশ বোধহয় থাকে না।
শঙ্খ ঘোষ একদা লিখেছিলেন, সত্যি কথা বলা ছাড়া কবিতার অন্য কোনও কাজ নেই। কিন্তু সমাজের পক্ষে, রাষ্ট্রের পক্ষে সত্য সবসময় সহনীয় নয়। সহজ তো নয়ই। তাই কবি যে সত্যি বলে চলেছেন, তা রাষ্ট্রের মনঃপূত না হলে, সরকারি স্বার্থের পরিপন্থী হলে যে কোনও ক্ষমতাকেন্দ্রই বন্ধ করতে চায় কবির কলম। এই ব্যাপারে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজা কিংবা স্বঘোষিত ফ্যাসিবাদী সরকার কিংবা কমিউনিস্ট সরকার কারও মধ্যেই বিশেষ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না।
সরকারের বিপক্ষে সামান্যতম ক্ষোভের আভাস থাকলে তথাকথিত সাম্যবাদী রাষ্ট্রেরও যে 'ফ্যাসিবাদী' হয়ে উঠতে বিন্দুমাত্র দেরি হয় না তার অগণিত প্রমাণ পাওয়া যায় স্ট্যালিন সমকালীন রাশিয়ার ইতিহাসে। এ প্রসঙ্গে বরিস পাস্তেরনাকের কথা আমরা অল্পবিস্তর সকলেই জানি। আজকের আলোচনায় আসবে সেই সময়ের রাশিয়ার অন্য দুই কবিবন্ধুর কথা। ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম এবং আনা আখমটোভা।
ওসিপ এবং আনার মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। ওসিপের স্ত্রী নাদেজদার ভাষায় আনা ছিলেন 'fierce and passionate friend.' ১৯৩৪ সালে স্ট্যালিনকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লেখার 'অপরাধে' গ্রেপ্তার হন ওসিপ। আনাকে জানান মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত তিনি। গ্রেপ্তারের দিনে তাঁর বাড়িতেই দেখা করতে এসেছিলেন আনা। ওসিপের সমস্ত বাড়ি খানাতল্লাশি করা হয়। তছনছ করা হয় কবিতার বই, ট্রাঙ্কে রাখা পাণ্ডুলিপি। গুপ্ত পুলিশের দপ্তরে তাঁকে সহ্য করতে হয় মানসিক ও শারীরিক পীড়ন। "…he toys with the tribute of half men/ he rolls the executions on his tongue like berries." স্ট্যালিন সম্পর্কে এই পঙ্ক্তি লেখার শাস্তি হিসেবে হয়ত তৎক্ষণাৎ মৃত্যুদণ্ডই নেমে আসত তাঁর ওপর। বরিস পাস্তেরনাক, আনা প্রমুখ কবিদের চেষ্টার ফলে সাময়িকভাবে মৃত্যুদণ্ড ঠেকিয়ে রাখা গেলেও তিন বছরের জন্য ওসিপের নির্বাসন হয় উরাল পর্বতের একটি ছোট গ্রামে। তারপর কয়েকবার স্থানান্তরিত করা হয় নির্বাসিত দম্পতিকে। নির্বাসন শেষ হলে ১৯৩৭-এ তাঁদের পাঠানো হল মস্কো থেকে একশো কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। আর ১৯৩৮-এর ২ মে ভোররাতে আকস্মিকভাবে তিনি গ্রেপ্তার হলেন 'Counter-revolutionary activities'-এর অভিযোগে। পুলিশ পরিবেষ্টিত ম্যান্ডেলস্টামকে আর কোনওদিন চোখে দেখার সুযোগ পাননি তাঁর স্ত্রী নাদেজদা, বন্ধু আনা। আনা ১৯৩৯-এর গোড়ায় পেলেন নাদেজদার বৈধব্যের খবর। আর আনার নিজের পরিণতি? ওসিপের সঙ্গে বন্ধুতা এবং কবিতায় রাষ্ট্রের বিরোধিতার ফলস্বরূপ তিনিও সরকারি অত্যাচারের শিকার হন। ১৯৩৩-এ সোভিয়েত বিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে কোনও যোগ না থাকা সত্ত্বেও বন্দি করা হয়েছিল আনার স্বামী পুলিন এবং আনার একমাত্র সন্তান লেভ গুমিলিয়ভকে। এরপর দশ বছরের জন্য লেভকে পাঠানো হয় হোয়াইট সি কানালের শ্রম শিবিরে। আনার কবিতা সংকলন 'ফ্রম সিক্স বুকস'-এর একটি কবিতা স্ট্যালিনের অপছন্দ হওয়ায় বইটির সব কপি দোকান থেকে, লাইব্রেরি থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাঁর কবিতা প্রকাশের ব্যাপারে জারি হয় নিষেধাজ্ঞা।
বিভিন্ন দেশে বিচিত্র সময়পর্বে এভাবেই রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের অঙ্গুলিহেলনে নিষিদ্ধ হয়েছে আনার মতো কবিদের কবিতা। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধাচারণে শেষপর্যন্ত দমিয়ে রাখা যায় না ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা মানুষের স্বর। স্ট্যালিন সমকালীন রাশিয়ায় চূড়ান্ত অন্ধকারময় পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আনা লিখেছিলেন 'রিকোয়ায়েম' কবিতা -
No, Not under the vault of alien skies,
And not under the shelter of alien wings-
I was with my people then,
There, where my people, unfortunately, were.
আকাশকুসুম স্বপ্নের অচেনা কুঠুরিতে নয়, কল্পলতায় গড়া নিরাপদ পক্ষপুটের ছায়ায় নয়, তাঁর কবিতার অক্ষর মিশে রইল সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণায় আর তিনি রইলেন তাঁর আপনজনের অগণিত দুর্ভাগ্যের শরিক হয়ে, এই ছিল আনার শেষ সান্ত্বনা। রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কবিদের অবস্থান সফল হোক, বা না হোক, এটুকুই সম্ভবত তাঁদের শেষতম অহংকার।
কৃতজ্ঞতা-
কিল মারার গোঁসাই, অশ্রুকুমার শিকদার, দীপ প্রকাশন