ক্যান্সার-কোশের মোকাবিলায় এক্স রশ্মির ভাবনা : এমিল গ্রাবে-ই কি রেডিয়েশন থেরাপির জনক?
১৮৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসে জার্মানির এক বছর পঞ্চাশেক বয়সের অধ্যাপক উইলহেল্ম রয়েন্টগেন কাচের নলের মধ্যে দিয়ে তড়িৎ পাঠাবার বিশেষ এক পরীক্ষায় আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করলেন সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক অদৃশ্য রশ্মি, যার ভেদ করবার ক্ষমতা সাধারণ আলোর চেয়ে অনেক বেশি। দেখা গেল যে এই রশ্মি ভেদ করতে পারে শরীরের চামড়া, কিন্তু পারে না হাড় ভেদ করতে। কয়েক মাসের মধ্যেই এটা স্পষ্ট হল যে এই রশ্মিকে কাজে লাগানো যেতে পারে চিকিৎসার নানা ক্ষেত্রে। তবে ক্যান্সারের মতো মারণ রোগের চিকিৎসাতেও যে এই রশ্মিকে প্রয়োগ করা যেতে পারে আগামী দিনে, এটা প্রথম বুঝেছিলেন আমেরিকার শিকাগো শহরের এক একুশ বছর বয়সী ডাক্তার। তাঁর নাম এমিল হারম্যান গ্রাবে (Emil Herman Grubbe, ১৮৭৫ – ১৯৬০ খ্রি)।
এক্স রশ্মি যখন ইউরোপে আবিষ্কৃত হচ্ছে, গ্রাবে তখন শিকাগোর এক মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। তাঁদের পারিবারিকভাবে একটি ছোট ইলেকট্রিক বাল্ব তৈরির কারখানা ছিল, যেখানে পড়াশুনোর পাশাপাশি অবসর সময়ে তিনি নিজেও যেতেন এবং ওই কাজে হাত লাগাতেন। কিন্তু গতানুগতিকভাবে শুধু বাল্ব তৈরিতে লেগে না থেকে একসময় তাঁর মনে হল যে এবার একটু অন্য ধরনের আলো-উৎপাদক জিনিস তৈরির দিকে মন দিলে কেমন হয়? এ জন্য তিনি নানা ধরনের দেশি-বিদেশি বৈজ্ঞানিক পত্রপত্রিকা পড়া শুরু করলেন, আর ওই সময় একটা জিনিসের বর্ণনায় তাঁর চোখ আটকে গেল। জিনিসটার নাম ক্রুকস টিউব, ব্রিটেনের বিজ্ঞানী উইলিয়াম ক্রুকস এবং আরও কয়েকজনের প্রচেষ্টায় এই যন্ত্রটি তৈরি হয়েছিল ১৮৭০-৭৫ সালের দিকে। কাচের নলের মধ্যে অল্প চাপে আটকে রাখা গ্যাসের মধ্যে দিয়ে বেশি পরিমাণে তড়িৎ পাঠিয়ে গ্যাসকে আহিত করে তোলবার এই যন্ত্রে তৈরি হত ক্যাথোড রশ্মি, যা পরে ইলেকট্রন কণার স্রোত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ক্রুকস নলের মধ্যে গ্যাসীয় পদার্থ অনেক সময় উজ্জ্বল আলো ছড়াত, যেরকম আলো আজকাল টিউবলাইটে আমরা দেখতে পাই। এই নল নিয়ে পরীক্ষা করেই উনিশ শতকের শেষ দিকে একাধিক আবিষ্কার হয়েছিল।
গ্রাবে সাহেব এই ধরনের নানা সাইজের আর আকারের ক্রুকস টিউব তৈরি করলেন বিক্রির জন্য। পাশাপাশি খবরের কাগজ থেকে এক্স রশ্মি তৈরির খবর পেয়ে তিনি সে কাজেও হাত লাগালেন। নিজেই এক্স রশ্মি তৈরি করে নিজের বাম হাত সেই রশ্মির সামনে রেখে ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর তুলতে লাগলেন হাড়ের ছবি। প্রতিদিন তাঁর হাতে একই জায়গায় পড়তে লাগল অদৃশ্য রশ্মি, একটানা দু-সপ্তা। কিন্তু সমস্যাটা দেখা দিল তার কিছুদিন পর। তিনি খেয়াল করলেন এই কাজ করতে গিয়ে তাঁর বাম হাতে বেশ কিছু জায়গায় ফোঁড়া হয়েছে। পাশাপাশি চুলকানিও হচ্ছে। প্রথম দিকে তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না কেন এমনটা হচ্ছে, তবে কিছুদিন পর তাঁর কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। অদৃশ্য এই কণার স্রোতই তাঁর হাতে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে!
গ্রাবে যে কলেজে পড়তেন, সেই হ্যানিম্যান মেডিকেল কলেজের কয়েকজন চিকিৎসক-অধ্যাপককে বললেন এই পুরো বিষয়টা। তখন তাঁদের মধ্যে একজন, নাম জে ই গিলম্যান তাঁকে খুব চমৎকার একটি কথা বললেন। ওই কথাটাই সেদিন যেন আগামী দিনে এক্স রশ্মির সাহায্যে ক্যান্সার আক্রান্ত কোশকে ধ্বংস করবার পথে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিল। তিনি বললেন, যদি এক্স রশ্মির প্রভাবে সুস্থ হাতে এইরকম ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে, তাহলে তো ক্ষতিকর কোশকেও এই রশ্মি পারে ধ্বংস করতে!
এরপরে গ্রাবে ব্যাপারটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। ওই চিকিৎসকদের মধ্যে আরও একজন, তাঁর নাম রিউবেন লুডলাম, তিনি তখন চিকিৎসা করছিলেন পঞ্চান্ন বছরের এক মহিলার। তাঁর ব্রেস্ট ক্যান্সার। বাঁচবার আশা খুব কম। রোজ লি নামে ওই মহিলার বুকে এর আগে দু-বার সার্জারি করা হয়েছিল, তাতেও সারেনি। এবার তিনি নিজেই সাহসী হয়ে এগিয়ে এসে জানালেন, তিনি রাজি গ্রাবে-র কাছে এই নতুন ধরনের চিকিৎসার সাহায্য নিতে।
সেইমতো একদিন তিনি এলেন গ্রাবে সাহেবের কারখানায়। বুক পেতে বসলেন এক্স রশ্মির সামনে। একটা সিসার প্লেট রাখা হল তাঁর বুকের ওপর, যাতে রশ্মি খুব বেশি জায়গায় পড়তে না পারে। এরপর ক্রুকস টিউবটিকে বুকের তিন ইঞ্চি ওপরে রেখে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে একবার দু-বার নয়, পরপর আঠেরো দিন ধরে রোজ তাঁর ওপরে প্রয়োগ করা হতে লাগল এক্স রশ্মি। তখনও কেউ জানতেন না কী হতে পারে এর পরিণতি। ঠিক কত পরিমাণে রশ্মি ওই কোশের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে, সেটাও তখন অজানা। তবু সেদিন আরোগ্যের জন্য যেভাবে রোজ লি এক্স রশ্মিকে নিজের শরীরে গ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, সাময়িকভাবে কিছুটা যন্ত্রণা কমলেও শেষ পর্যন্ত রোজ লি বাঁচেননি, পরের মাসেই তাঁর মৃত্যু হয়। এঁর কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যু হয় গ্রাবে আর যে একজন রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন এই একই উপায়ে, তাঁরও। তবে তাঁর পক্ষে স্বান্তনা ছিল এই যে তাঁর কাছে পাঠানো হত একেবারে লাস্ট স্টেজের রোগীদের। যাঁদের বাঁচবার সম্ভাবনা এমনিতেই প্রায় শূন্য। পরের দিকে অবশ্য প্রাথমিক স্টেজে থাকা রোগীদের পাঠানো হয়েছিল তাঁর কাছে, আর তাঁদের অনেককেই তিনি সারিয়েও তুলেছিলেন।
তবে গ্রাবে তাঁর এই প্রথম দিকের পরীক্ষার ফলাফলের কথা এরপরে প্রায় তিন বছর পর্যন্ত প্রকাশ করেননি কোনো পেপারের আকারে, কোনো জার্নালেই। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে যেহেতু তখনও তিনি ডাক্তারি পাশ করেননি, তাই তাঁর পরীক্ষাকে তখন প্রকাশ করলে কেউ হয়তো গুরুত্ব দিতেন না। তবে ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে তিনি যখন প্রকাশ করলেন তাঁর সেই পুরনো পরীক্ষার ফলাফল (যদিও তার বেশিরভাগটাই ব্যর্থতার ইতিহাস), ততদিনে এক্স রশ্মির সাহায্যে আরও অনেক ডাক্তারই এইভাবে চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছেন। কেন এতদিন চুপ করে ছিলেন, এর অন্য একটি ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় যে গ্রাবে যেহেতু ছিলেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার, তাই অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারেরা পাছে ঝামেলা করেন, তাই তিনি মুখ খোলেননি।
সত্যিই কি তিনি রেডিয়েশন থেরাপি-র জনক? পরে গ্রাবে-র এই প্রথম হওয়ার দাবি নিয়ে বহু বিতর্ক জন্ম নিয়েছিল। পরবর্তীকালে গ্রাবে নিজের চেম্বারে এই পদ্ধতিতে বহু রোগীর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, উপার্জন করেছিলেন বহু অর্থও। মৃত্যুর আগে সেই সব অর্থ দান করে দিয়েছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি নিজের একটি প্রামাণ্য জীবনী যাতে লিখিত হয়, সে জন্যেও তিনি তাঁর ইচ্ছাপত্রে অনুরধ জানিয়ে গিয়েছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান পল হজেস (Paul Hodges) বিস্তর খেটেখুটে পরে গ্রাবে-র একটি জীবনী লিখেছিলেন বটে, তবে তিনি নিজেও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, গ্রাবে কি সত্যিই রেডিয়েশন থেরাপি ব্যাপারটা প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন?
#Émil Herman Grubbé #x-rays # cancer #radiation therapy #silly পয়েন্ট