মেয়েদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়াই পাখির চোখ?
অতি সম্প্রতি আর.জি.কর হাসপাতালে যে নারকীয় ধর্ষণ ঘটে গিয়েছে, তার বিভীষিকা এখনও তাড়া করে ফিরছে। কখনও দুঃস্বপ্ন হয়ে ঘুমের মধ্যে হাঁটাচলা করছে, কখনও দিনের বেলার শুনশান পথে শিউরে উঠছি। ঘটনার বাস্তবতা এখন আর দূরের রাজ্যে দাঁড়িয়ে নেই, একদম ঘরে ঢুকে এসে দখল নিয়েছে। তাই, একটু দূরের কথা বলি আজকে।
***
বোজ্যাক বসনিয়ার শিক্ষার্থী, যে জাগ্রেবে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু রোজগারও করে। ওর বয়স পঞ্চাশের উপরে। ওর সামনে ওর আট বছরের মেয়ে আর স্ত্রীকে বারবার ধর্ষণ করা হয়েছে। মেয়েটা তিনদিন রক্তাক্ত হয়ে পড়েছিল, সৈনিকরা তার সঙ্গে খেলতে থাকল। এর মধ্যে ও কখন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে জানা যায়নি। বোজ্যাক সেই জায়গাটা দেখাল যেখানে ওর স্ত্রী হৃদরোগে আর অবসাদে মারা গিয়েছিল। 'লাইফ মাস্ট গো অন' বলে বোজ্যাক ঝাপসা চোখে হাসে আর পরবর্তী যুদ্ধ ক্যাম্প দেখতে নিয়ে যায়। মেয়েকে হারিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে ওর স্ত্রী যিশুখ্রিস্টের কাছে নিজের অনুচ্চারিত পাপের জন্য সারাদিন ক্ষমা চাইত। ওর পাপ কী ছিল? এর উত্তরে বোজ্যাক বলত, 'মেয়ে হওয়া'...।”
***
১৯৯২-এর এপ্রিলের সেই দিন এখনও ভুলতে পারেনি হাসেসিস, অনেক সংকোচ আর ইতস্তত ভাব নিয়ে ও নিজের কথা রেকর্ড করাচ্ছে।
হাসেসিসের সেই দিনটা ভালোই মনে আছে, যেদিন সার্ব সৈনিকরা ওকে উইজেগ্রাদের পুলিশ স্টেশনের চোরাকুঠরিতে নিয়ে যায়।
“ওখানে আমি মিলান লুসিক আর স্ট্রেজো লুসিককে দেখলাম। আমি মিলানকে ভালো করেই চিনতাম। ও চাকু দেখাতে দেখাতে বলল- ‘কাপড় খোল।’ মনে হচ্ছিল ও ঠাট্টা করছে। কিন্তু সত্যি করেই এই পুরোনো সার্বিয়ান প্রতিবেশী অন্যান্য সৈনিকদের মতোই আমাকে অপমান করতে কোমর বেঁধেছিল।”
হাসেসিস কতদিন ওই চোরাকুঠুরিতে ছিল, সে ঠিক মনে করতে পারে না এখন। দিনের একটা সময় ওকে খাবার দেওয়া হত। পরবর্তী দিনগুলোতে তো এমন হয়েছিল যে সার্বিয়ান প্রতিবেশীটির আসার আওয়াজ শুনলেই ও জামাকাপড় খুলে নিজেই মেঝের উপর শুয়ে পড়ত। অত্যাচার যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই ভালো। সার্ব সৈনিকদের পদ্ধতি এত ভয়ানক ছিল যে হাসেসিস ঠিক করে নিয়েছিল যে কোনও সৈনিক এলেই সে তাড়াতাড়ি আপনিই নিজেকে পরিবেশন করে দেবে। এক সৈনিকের হয়ে গেলেই আরেক সৈনিককে ইশারা করা হত। এইভাবে ও মার খাওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখছিল। ও বলল যে, ওর আশা ছিল একদিন না একদিন এই অত্যাচার শেষ হবে আর ও নিজের ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছে ফিরে যেতে পারবে।
লিলিয়ান জিজ্ঞেস করল, তোমার খুব কষ্ট হত, না? হাসেসিস জবাব দিল, যখন আমি ওদের নীচে শুয়ে থাকতাম, ওরা অত্যাচার করত, তখন মনে হত আমি যেন একটা নালা যার মধ্যে দিয়ে নোংরা বয়ে যাচ্ছে। একদিন না একদিন এর শেষ হবেই। আমার মেয়ের নিষ্পাপ চেহারাটাই আমার মনকে মজবুত করে রেখেছিল। অবশ্য বাড়ি ফেরার পর আমার স্বামী আমাকে তালাক দিয়েছিল, কারণ আমি বিছানায় বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যেতাম। কিন্তু এখন আমি আরও পরিশ্রম করি, নিজের শিশুদের একটা ভালো জীবন এনে দেওয়ার জন্য।”
***
উপরের দুটি আত্মকথন ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধর্ষিতা নারীদের। ক্রোয়েশিয়া এবং বসনিয়ার বিরুদ্ধে এই পুরো যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল নাগরিকদের জীবনটাকেই দুরমুশ করে দেওয়া, যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়। তাহলেই বৃহত্তর সার্বিয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে পারে। এই দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধে কোথাও সার্বিয়ার লোকেরা শোষিত হয়েছে, কোথাও বসনিয়ার লোকেরা আর কোথাও ক্রোয়েশিয়ার লোকেরা- কিন্তু যে নারীদের পুরো জীবনটাই একটা যুদ্ধে পরিণত হল, শান্তি চুক্তি স্থাপিত হওয়ার পরেও যারা যুদ্ধকে প্রতিটা মুহূর্তে নিজের দেহের উপর চলাফেরা করতে টের পেয়েছিল, এই আত্মকথনগুলিতে তারই স্বাক্ষর।
***
“ধর্ষণ ছিল নিকৃষ্টতম অস্ত্র; যা আমাদের মানবিক অনুভূতি বা আবেগকে পশুর চামড়ার মতো গা থেকে খুলে নিয়েছে, এবং ভবিষ্যতের ভাবনাকে (ইয়াজিদি সমাজে প্রত্যাবর্তন, বিয়ে, মা হওয়া, সুখে শান্তিতে বসবাস) অসম্ভবে পরিণত করেছে। এর বদলে তারা মেরে ফেলুক বরং, চেয়েছিলাম আমরা।”
লিখছেন ২০১৮ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া নাদিয়া মুরাদ। কুর্দিভাষী গোষ্ঠীর এই নারী পরবর্তী কালে নানা বক্তৃতায়, বিবৃতিতে বলেছেন- 'সব কিছুর চেয়ে বেশি আমি যা চাই, তা হল, বিশ্বে আমার মতো গল্পওয়ালা শেষ মেয়েটি যেন আমি হই।' আত্মজীবনীর নামও তিনি দিয়েছেন 'দ্য লাস্ট গার্ল: মাই স্টোরি অফ ক্যাপটিভিটি অ্যান্ড মাই ফাইট এগেনস্ট দ্য ইসলামিক স্টেট’।
***
“তারপর হঠাৎ একদিন বাবা এলেন, কিন্তু আমার মাথায় রাখা বাবার হাতও তো তেমন কোনও আশ্বাস দিল না।
মুখ তুলে বললাম, বাবা, এখন কি তোমার সঙ্গে আমি যাব? অফিসে বলতে হবে।
বাবা একটু থেমে ইতস্তত করে বললেন, না মা, আজ তোমাকে আমি নিতে পারব না। বাড়িঘর মেরামত হচ্ছে। তোমার মামাও এসেছে। কালী আসবে জামাইকে নিয়ে। ওরা চলে গেলে আমি তোমাকে নিয়ে যাব মা।
আস্তে করে বাবার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলাম। ঠিক আছে বাবা, তুমি আর এসো না। বাবা না না বলে আমতা আমতা করতে লাগলেন।
...বাবা আবারও এসেছেন, কিন্তু আমাকে নেবার কথা বলেননি। দাদা এসেছে কলকাতা থেকে আনা শাড়ি নিয়ে। এমনকি শ্যামলদাও এসে বীরাঙ্গনা দেখে গেছে। দাদা অবশ্য একটা কথা বলে গেল যা বাবা মুখ ফুটে বলতে পারেননি। দাদা বলল, আমরা যে যখন পারব তোর সঙ্গে দেখা করে যাব। তুই কিন্তু আবার হুট করে বাড়ি গিয়ে উঠিস না। আমার মুখের পেশিগুলো ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছিল। দাদা সেদিকে একনজর তাকিয়ে চট করে বলল, তা ছাড়া আমাদের ঠিকানায় চিঠিপত্র লিখবারও দরকার নেই। তুই তো ভালোই আছিস। আমিও চাকুরি পেয়েছি, সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছি, তা দিয়ে বাড়িঘরও মেরামত হয়েছে। ওপরে দুটো ঘরও তোলা হয়েছে।
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালাম। ওর দিকে আর তাকাইনি।”
(একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণধর্ষিতা, তারা ব্যানার্জির আত্মকথন। সূত্র: "আমি বীরাঙ্গনা বলছি"- নীলিমা ইব্রাহিম।)
***
এ লেখার মূল প্রশ্ন ছিল- ধর্ষণই কেন? বা একটু উলটে দিয়ে, কেনই বা ধর্ষণ?
ধর্ষণ আসলে মন আর মস্তিষ্ক দুটোকে একসঙ্গে আঘাত করার সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র, যেখানে একজন নারীর সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বকে নামিয়ে আনা হয় তার 'যোনি’-তে। যার আঘাত এত তীব্র যে শোষিত, ধর্ষিত ব্যক্তি কখনও সেটা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে না। ক্ষমতা প্রদর্শন আর ত্রাস সৃষ্টির হাতিয়ার এই 'ধর্ষণ', মেয়েটিকে তার শিকড় থেকে, তার পরিবার, তার পারিপার্শ্বিকতা, তার স্বপ্ন, তার আকাঙ্ক্ষা আর ভরপুর আত্মবিশ্বাস থেকে কয়েক যোজন দূরে নিয়ে গিয়ে উপড়ে ফ্যালে, জীবনের স্বাভাবিকতা থেকে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে বেড়ানোই তার অলিখিত নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। আর তাতেই ধর্ষকদের 'শাস্তি দেওয়া’, 'সবক শেখানো'–র প্রকল্প সফল হয়। মেয়েদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার আরও, আরও কার্যকরী যে নীল নকশা খুঁজেছে পিতৃতন্ত্র, ধর্ষণ সেই প্রকল্পে খাপে খাপে বসে গিয়েছে।
কিন্তু কখনও কখনও আবার কেউ কেউ এই প্রকল্পকে ভণ্ডুল করে দেয় অবিশ্বাস্য দুঃসাহসে। যেমন, ইয়াদ্রাঙ্কার (ইনিও ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে গণধর্ষণের স্বীকার হয়েছিলেন) মতে–“ধর্ষণের পর আমি আত্মসম্মান হারাইনি, কারণ আমি তো ওদের কাছে একটা বস্তু ছিলাম, ব্যক্তি নই, ব্যক্তি হিসাবে আমার আত্মসম্মান অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ...আত্মাভিমান হল ধর্ষকের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে থাকা, তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, সে যা করছে তা আমি জানি। জবরদস্তি করে শরীরে আঘাত করা যায়, আত্মসম্মানে নয়।”
নারীমুক্তির পথের লড়াকু সৈনিক কমলা ভাসিন বলেছিলেন, কোনও মেয়েকে ধর্ষণ করলেই যে বলা হয় তার সম্মান চলে গেল, বলি, নারীর সম্মান তার যোনিতে রাখল কে?
মেয়েদের শরীর-মনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য পিতৃতন্ত্রের হিংস্রতা ধর্ষণের ব্লু প্রিন্ট বানাক। মারের মুখের উপর দিয়ে আমাদেরও এ প্রশ্ন জিইয়ে রাখতেই হবে। রোজ।
অলংকরণ : A.I. ( কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনও বুদ্ধিমত্তার কাজই প্রতিবাদ করা)
আরও পড়ুন : যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান
যে আর জি কর-কে চিনতাম, আর যাকে চিনি না/ ব্রতেশ
অ্যাবিউজের যে দীর্ঘ দিনলিপি আমরা জানি/ যশোধরা রায়চৌধুরী
আমাদের পরিবারেই বেড়ে ওঠে ধর্ষক/ সায়নদীপ গুপ্ত
চিন্তা নেই, পিএইচডি হয়ে যাবে!/ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
পুরুষ থেকে ধর্ষকের মাঝে যেটুকু ফারাক/ শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী
মিছিলে পা মেলান, তবে মনে রাখুন…/মুনিয়া দেবলীনা
অন্ধকার পথে একলা হাঁটার স্বাধীনতা চেয়ে…/অঙ্কিতা ভট্টাচার্য
নট অল মেন, কিন্তু.../ রণিতা চট্টোপাধ্যায়
আমরা শিখেছিলাম, চড় মারাই মেয়েমানুষের ওষুধ/ বিবস্বান