ফিচার

পুরুষ থেকে ধর্ষকের মাঝে যেটুকু ফারাক

শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী Aug 16, 2024 at 1:13 pm ফিচার

সম্প্রতি কলকাতার স্বনামধন্য হাসপাতালে ঘটে যাওয়া চিকিৎসক তরুণীকে অমানবিক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাটি আমাকে লজ্জিত করে, অসহায়তার দিকে ঠেলে দেয়। কেন? মানুষ হিসেবে এই ঘটনার সাক্ষী থাকাই কি যথেষ্ট লজ্জাজনক নয়? তবে, দুঃখের বিষয়– আমাদের চোখগুলি ‘মানুষ’ হওয়ার আগেও স্ত্রী-পুরুষে বাঁধা। তাই, আরও বলি– পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ‘ক্ষমতাবান’, ‘সুবিধাভোগী’ পুরুষ সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে আমি লজ্জিত। সমাজ-প্রবর্তিত পৌরুষের যে ভ্রান্ত ধারণা ধর্ষক ও খুনিদের আবেগকে প্রশ্রয় দেয়, তার আঁচ আমি একসময় নিজের মধ্যে পেয়েছি, সেই পথ পেরিয়ে এসেছি। তাই, শিউরে উঠি।


আমার বয়ঃসন্ধিকাল সংবিধান, আইন কিছুই মানেনি। আঠারো পেরিয়ে ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ হয়ে যাওয়ার বহু, বহু বছর পর অবধিও যৌনতা আমার কাছে ‘নর্মালাইজড্’ হয় নি। বয়েজ স্কুলে পড়তাম; গোদের উপর বিষফোঁড়া – বয়েজ কলেজেও পড়েছি। এখন ফিরে দেখলে বুঝতে পারি – মোটামুটি গলা ভাঙার বা গোঁফের রেখা ওঠার বয়স থেকেই শরীরের প্রতি আলাদা আকর্ষণ অনুভব করা শুরু করেছিলাম। ‘নারী’শরীর, এমনকি নিজের ‘পুরুষ’শরীরের প্রতিও। বলা বাহুল্য – ‘নারী’শরীরের প্রতিই বেশি। নিরাপদ দূরত্ব থেকে একবগ্গা শারীরিকভাবে ‘নারী’কে যেভাবে চেনা যায় (বন্ধুদের সঙ্গে চটুল আড্ডায়, ম্যাগাজিনের ফ্যাশনের পাতায়, ঘণ্টাপিছু পনেরো টাকা দিয়ে সাইবার ক্যাফের নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটে, বিদেশি ছায়াছবির অন্তরঙ্গ দৃশ্যে বা ভোররাতের এফ-টিভিতে), সেভাবেই চিনেছিলাম। সে সময়ে অপরিপক্ব মনে নারীকে যত চিনেছি শরীর হিসেবে, তত কামনা করেছি। আর ততই অপ্রাপ্তি ঠেলে দিয়েছে আরও বেশি চাহিদার দিকে। ক্লাসে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের একে অন্যের সঙ্গে কথা বলা, বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসতে গেলে গায়ে গা লাগা, অসমান পথ পেরোতে গিয়ে একে অন্যের হাত ধরা, দুর্বিষহ ভেঙে পড়ার মুহূর্তে একে অন্যের পিঠে বা কাঁধে হাত রাখা – শরীরী ঔৎসুক্যের বয়সে, হরমোনাল উথালপাথালের সময়ে এই সবকিছু সহজে পার করিয়ে দিতে পারে। পার করিয়ে দিতে পারে বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে কেবল শরীর দিয়ে চেনার ‘ব্লক’টি। হয়তো বা পৌঁছে দেয় সেই মনোভাবে, যেখানে কেবল লিঙ্গ যোনিপথ চায় না, হাত খামচে ধরতে চায় না বুক; যেখানে মন ও অন্তরাত্মা সমন্বিত এক পূর্ণাঙ্গ মানুষের সাহচর্য প্রার্থনা করে আরেক মানুষ, জৈবিক নিয়মে একজনের শরীর ও মনের গঠন পরিপূর্ণ করে আরেকজনকে।

কিন্তু বিধি বাম। আমার জন্য রাখা ছিল কঠিন পথটি। একটি প্রবণতা যেমন বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে ‘ভোগ্য’ হিসেবে দেখতে শিখিয়েছিল আমায়, তেমনই অপর একটি প্রবণতা আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল এইভাবে দেখার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রবল পাপবোধ। তখন ‘অবজেক্টিফাই’ ইত্যাদি শব্দ জানতাম না; তবে এটুকু বুঝতাম – মেয়েদের প্রতি আমার চোখ ও আমার বোধ, দুটি ভিন্ন সুরে বাঁধা। চোখ চাইছে যা, বোধ সচেতন করছে – এ চরম অনুচিত। মেয়ে-বন্ধুদের, এমনকি অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলতেও অপরিসীম সংকোচ ও অপরাধবোধ আসত আমার। যে আমাকে ভরসা করে কথা বলছে, স্থান দিচ্ছে তার জীবনে, প্রতিশ্রুত হচ্ছে সাক্ষাতে, আমিই কি তাকে কোনও মুহূর্তে ‘অন্যভাবে’ ভেবে বসবো না? 

শুরু হল অবদমনের খেলা। নিজের প্রতি ঘৃণা, গা গুলিয়ে ওঠা রাগ থেকে ধাক্কা মেরে আড়ালে পাঠাতে শুরু করলাম শরীরী সমস্ত ‘ফ্যান্টাসি’কে। দূরে সরাতে থাকলাম নিজেকে সমস্ত স্বাভাবিক যোগাযোগ, কথাবার্তা থেকে। কিন্তু শরীরের ভিতরে যেসব ‘কেমিকাল লোচা’ হয়ে চলেছে, তার সঙ্গে এত সহজে পেরে উঠব কেন? নারীকে কেবল শরীররূপে দেখব না – নিজের কাছে এ কথা রাখতে গিয়ে একসময়ে আকৃষ্ট হয়েছি পুরুষ-শরীরের প্রতিও। কাম ও বিবেকের যুগপৎ দংশন – একটির প্রবল প্রকাশেচ্ছা ও অন্যটির সংযমের শমন, দুইই আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে দীর্ঘদিন। অনেক, অনেক পরে যখন এই ঝড় থেকে বেরিয়ে এসে পিছন ফিরে ঝড়টিকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, দেখেছি – স্বাভাবিকতাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার শিক্ষা যদি আমি নিজেকে দিতাম আরও আগে থেকে, সমাজ যদি সেই পরিসর রাখত আমাদের জন্য, আমাদের কারোরই পরিণতমনস্কতার দিকে যাত্রাপথটি এতটা কণ্টকাকীর্ণ হত না হয়তো।

কলকাতার এবারের এই ঘটনায় দৃঢ় প্রতিবাদ আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক। হাল-না-ছাড়া, দমে-না-যাওয়া মনোভাব আশান্বিত করছে। উপযুক্ত বিচার প্রার্থনা করি আমরা সকলেই। কিন্তু আমাকে ভাবায় একটি প্রশ্ন – পাপী না হয় ধরা পড়বে; কিন্তু পাপের কী হবে? এই লেখা আমি যখন লিখছি, বা যখন এটি প্রকাশিত হচ্ছে, বা যখন আপনারা পড়ছেন এই লেখা, তখনও – আমরা নিশ্চিত জানি – এই দেশের অগণিত প্রান্তে অসংখ্য নারী ধর্ষিত হচ্ছেন, বা প্রাণভয়ে আপস করে নিজেই নিজের শরীর তুলে দিচ্ছেন পুরুষের হাতে, বা খুন হচ্ছেন। বা আর কিছু না হোক, অন্ততপক্ষে লালসামাখা দৃষ্টির শিকার হচ্ছেন। এই দৃষ্টি, এই মনোভাব রক্তবীজের মতো বেড়ে চলেছে। সেই পাপের সদুত্তর কী হতে পারে? 

আমি যা বুঝি, তা আমায় জানিয়ে যায় – এর উত্তর আইনের পাতায়, বা কোনও পাঠক্রমে রাখা নেই। কামের বীজ আমরা বহন করি প্রত্যেকে। এ তো শ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজ এক মজার কুঠি – একদিকে সে কামেচ্ছার স্বাভাবিকতায় ঘৃতাহুতি দেয়, অন্য দিকে তাকে ‘পাপ’ বলে চিহ্নিত করে, অথচ তা প্রশমনের কোনও পথ বলে দিয়ে যায় না। তাই, সেই দায়িত্ব পড়ে থাকে আমাদেরই হাতে – পুরুষদের হাতে কিছুটা বেশি। বয়ঃসন্ধির মুহূর্ত থেকে শুরু করে ‘কাম’কে, ‘শরীর’কে স্বাভাবিকতার ভাষ্যে নিয়ে আসার দায়িত্ব সমষ্টিগত স্তরে ও ব্যক্তিস্তরে একান্ত আমাদের। মানুষের মনে ভাবনার ‘ইনলেট’ বন্ধ করা, বা ইচ্ছাকে অবদমন করার বোকামি থেকে বেরিয়ে এসে আমরা একটু প্রাপ্তবয়স্ক হই? নতুন প্রজন্মের কাছে ‘অস্বস্তিকর’ প্রসঙ্গগুলিকে নিয়মিত আলোচনায় ক্ষুধাতৃষ্ণার মতো স্বাভাবিক করে তুলি। এরই মধ্য দিয়ে সামাজিক ও নৈতিক পাঠ তাদের জীবনে প্রবেশ করুক। আমরা যারা এই পথ এড়িয়ে নয়, পেরিয়ে এসেছি, আমরাই কিন্তু আগামীদিনের ‘enabler’ – মানুষের না ধর্ষকের, সেইটিই প্রশ্ন। যা-ই হয়ে উঠি না কেন আমরা, সেও একটি অভ্যাস। 

অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র এবং বিবস্বান

আরও পড়ুন : যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান

                     যে আর জি কর-কে চিনতাম, আর যাকে চিনি না/ ব্রতেশ

                      আমাদের মিছিল/ জুঁই নিয়োগী

                      অ্যাবিউজের যে দীর্ঘ দিনলিপি আমরা জানি/ যশোধরা রায়চৌধুরী

                    আমাদের পরিবারেই বেড়ে ওঠে ধর্ষক/ সায়নদীপ গুপ্ত

                    চিন্তা নেই, পিএইচডি হয়ে যাবে!/ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য


#we want justice #R G Kar Medical College #স্পর্ধা

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

24

Unique Visitors

208848