নারীর স্বাধিকারের আর্তি ভাষা পেয়েছিল ‘আধুনিক ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের জননী’ কমলা দাসের কলমে
গতকাল ছিল নারী দিবস। ৮ মার্চ - এই একটি দিনের অতিরিক্ত উদযাপন আমাদের প্রায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই বিশেষ দিনটির প্রয়োজনীয়তা এখনও এক বিন্দুও কমেনি আমাদের দেশে। তাই আজও নারীর স্বাধিকারের প্রয়োজন ব্যক্ত করার চেষ্টা চলতে থাকে খাতায়-কলম তলোয়ার করে। প্রতিবাদে গর্জে ওঠা এমনই একজন নারীবাদী লেখিকা হলেন কমলা দাস। বিবাহের পূর্বে তাঁর নাম ছিল কমলা সুরাইয়া। পরবর্তী জীবনে কমলা দাস নামে পরিচিত হন।
১৯৩৪ সালের ৩১ শে মার্চ কেরালার মালাবার উপকূলে ত্রিশূর জনপদে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই ডিসেম্বর তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর পিতা ভি.এম. নায়ার ছিলেন মালায়ালাম ভাষার প্রসিদ্ধ দৈনিক সংবাদপত্র ‘মাতৃভূমি’-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর। মা বালামণি আম্মা ছিলেন মালায়ালাম ভাষার এক প্রখ্যাত কবি। মা এবং তাঁর দাদুর কাছ থেকেই তাঁর কবিতার প্রতি প্রেম ও প্রেরণার উৎস। কেরালায় জন্মগ্রহণ করলেও পিতার কর্মসূত্রে কমলা দাশের বেড়ে ওঠা কলকাতায়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মী মাধব দাসের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু বিবাহ-পরবর্তী জীবনের দায়বদ্ধতা তাঁর লেখালিখি বন্ধ করতে পারেনি, বরং স্বামীর সহযোগিতায় ও অনুপ্রেরণায় পাকাপোক্তভাবে চলতে থাকে তার কলম। স্বনাম ছাড়াও ‘মাধবীকুট্টি’ ছদ্মনামে তাঁর অনেক লেখা প্রকাশিত হয়।
তাঁর লেখনীতে প্রধানত উঠে এসেছিল নারীদের যন্ত্রণা- বঞ্চনার কথা। তিনি মাত্র তাঁর ৬ বছর বয়সে মুণ্ডহীন পুতুলদের নিয়ে দুঃখের কবিতা লেখেন। কবিতার ইলাস্ট্রেশনে সাহায্য করতেন তাঁর ভাই। সেই ভাইয়ের সঙ্গেই তাঁর প্রথম থিয়েটার করতে যাওয়া। সেই ছোট্ট বয়সেই বিদেশি থিয়েটার থেকে প্রাচ্যের শকুন্তলার মত নাটকে মঞ্চে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করতে থাকেন তিনি। বিবাহের পর স্বামীর সহযোগিতায় তাঁর কলম অনুপ্রাণিত হলেও ভারতীয় নারীর পরিবারতন্ত্রের জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে নিজের জগৎ তৈরি করা যে সহজ নয় তা-ও জীবন তাঁকে শিখিয়েছিল। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন -
"অন্য কিছু হওয়ার আগে একজন নারীকে প্রথমে ভালো মা ও ভালো স্ত্রী হয়ে উঠতে হয়। আর তার অর্থ হল বছরের পর বছর অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়স অবধি অপেক্ষা করে যাওয়া। আমি অধৈর্য্য ছিলাম, সুতরাং খুব অল্প বয়সেই আমি লেখালিখির সান্নিধ্যে আসি। সম্ভবত সে ক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবতী ছিলাম। সাহিত্যচর্চা মারফত পরিবারে অর্থ সংযোজনের ব্যাপারটিকে সমর্থন করেছিলেন আমার স্বামী। তিনি আমাকে রাত্রে লেখার অনুমতি দিয়েছিলেন। সংসারের সমস্ত কাজকর্ম সম্পন্ন হলে, বাচ্চাদের এবং তাঁকে খাওয়ানোর পর, আমি রান্নাঘর পরিষ্কার করতাম। আমাকে একা বসে ভোর পর্যন্ত লিখে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল আমার স্বাস্থ্যে।"
কমলা দাসের কবিতার পরতে পরতে উঠে এসেছে নারীর যন্ত্রণার কথা; উঠে এসেছে সমাজের হাতে নারীর মাতৃত্ব, সতীত্ব, স্ত্রী পরিচয়ের মধ্যেই নারীকে বেঁধে ফেলার এক সূক্ষ্ম কৌশলের কথা। 'এক বিধবার শোকসঙ্গীত' কবিতায় সেই বক্তব্যই ফুটে উঠেছে -
"এটা সবসময়ই ছিল
অন্য কারোর পৃথিবী আমার নয়
আমার ছেলে ও আমার মানুষটা একটা বৃত্ত আঁকছে
যেখানে আমি, স্ত্রী ও মা
তাদের চোখের তৈরি কাঁচের শার্সিতে উঠে চলেছি...। "
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনী 'আমার গল্প'। তার প্রায় ১৫ বছর পর সেই আত্মজীবনীর কিছুটা পরিবর্তন পরিমার্জন করে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয় 'মাই স্টোরি'। যেখানে উঠে আসে নারীর বয়ঃসন্ধি , বিবাহ, যৌনতা, মেনস্ট্রুয়েশন প্রভৃতি বিষয়গুলি। এই বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে নিয়মিত তিনি জার্নাল লিখতে থাকেন, কিন্তু সে পথও সুগম ছিল না। এই বিষয়গুলি সমাজের অন্ধকার ভেঙে বেড়িয়ে এলে স্বভাবতই পুরুষতন্ত্রের ধারক সমাজপতিরা নড়েচড়ে বসেন। তাঁর এই লেখাগুলির পান্ডুলিপি প্রথমে প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। বাধা দিয়েছিল কেরালা সোসাইটি। কারণ এই ধরনের বক্তব্য মেয়েদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিপক্ষে ভাবতে শেখাবে। কিন্তু বেশিদিন কমলাকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। জার্নালগুলি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল খ্যাতি পেল। লেখাগুলি যে মানুষকে ভাবাচ্ছে তারও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল। তাঁর আত্মজীবনীটি পেয়ে গেল 'ক্লাসিক কাল্ট'-এর স্বীকৃতি। জনপ্রিয় হল তাঁর আরেকটি গ্রন্থ 'সামার ইন ক্যালকাটা'। এটি তাঁর ইংরেজি কবিতাগুলির একটি সংকলন যা প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়াও ইংরেজি ভাষায় তিনি লেখেন ‘পদ্মাবতী : দ্য হার্ল্ট এন্ড দ্য স্টোরিজ’, ‘আলফাবেট অফ লাস্ট’ ইত্যাদি। ছেলেবেলার স্মৃতিকে কেন্দ্র করে মালায়ালাম ভাষায় লেখেন 'বাল্যকলাস্মরণকাল'। এছাড়াও প্রকাশিত হয় চন্দনামরঙ্গল ও অন্যান্য গ্রন্থ।
আরও পড়ুন : লিঙ্গবৈষম্যের মোকাবিলায় পুরুষদের সংগঠন : দশ বছরে পা দিল উত্তরপ্রদেশের MASVAW
শুধু নারীবাদী দৃষ্টিকোণের জন্য নয়, সামগ্রিক বিচারেই কমলা দাসকে ‘আধুনিক ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের জননী’ বলে মেনে নিয়েছেন সাহিত্যবেত্তারা। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন তালিকায় তাঁর নাম ছিল। এছাড়াও কেরালার সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার সহ বহু পুরস্কার ও সম্মানে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। কালিকট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডিলিট উপাধি অর্জন করেন।
কমলা দাসের মৃত্যু হয় ২০০৯ সালের ৩১ মে ৭৫ বছর বয়সে পুনের এক হাসপাতালে।
................