কলাবতীদের কিসসা : ভারতীয় মহিলা-ক্রিকেটের অগ্নিপরীক্ষার গল্প
বই - ফ্রি হিট : দ্য স্টোরি অফ উইমেন্স ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ালেখক - সুপ্রীতা দাসপ্রকাশক - হার্পার কলিন্সপ্রথম প্রকাশ - ২০১৮মূল্য - ৪৯৯/-..................
........................................
মতি নন্দীর চরিত্র কলাবতীকে মনে আছে? ফণী ঘোষের ইনফর্মাল কোচিং সেন্টার থেকে সে যায় বাবুদার পেশাদার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, দাপুটে উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে সে বাংলার হয়ে খেলে। আটঘরা আর বকদিঘির মিলেনিয়াম ম্যাচে তাকে খেলতে দেখা যায় ছেলেদের সঙ্গে, রোগা কালো কলাবতীকে কোনমতেই সুশ্রী বলা যায় না। অনেক ছক ভেঙেছিলেন মতি নন্দী, শুধু একটা জোরের জায়গা রেখেছিলেন কলাবতীর জন্য। কলাবতী ছিল আটঘরার জমিদারবাড়ির একমাত্র বংশধর, তার কাকা সত্যশেখর বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার। রাজশেখর সিংহ মা বাপ মরা নাতনির খেলাধুলোর পিছনে এতো কাঠখড় পুড়িয়েছিলেন তার প্রথম কারণ অবশ্যই এটা যে, খরচ করবার মত অর্থ এবং সময় দুটোই তাঁদের ছিল।
কিন্তু ভারতবর্ষের সব মেয়েদের তো আর বইয়ের কলাবতীর মত ভাগ্য হয় না! যে দেশে ক্রিকেট শুধু একটা খেলার গণ্ডী ছাড়িয়ে ধর্মের তকমা পেয়েছে অনেক আগেই, সেই ভারতে মেয়েদের ক্রিকেট খেলার রাস্তা আগাগোড়াই থেকেছে নানারকম কাঁটায় ভরা। সেই বিড়ম্বিত যাত্রার গল্পই তুলে ধরেছেন সুপ্রীতা দাস, মানবীবিদ্যার পরিভাষায় যে বইকে ‘হারস্টোরি’ আখ্যা দেওয়া যেতেই পারে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার প্রমাণ রয়েছে বইটির পাতায় পাতায়, মহিলা ক্রিকেটারদের প্রতি বঞ্চনার নানারকম কাহিনিতে। সহজবোধ্য ঝরঝরে ভাষায় একের পর এক অধ্যায়ে তিনি বর্ণনা করেছেন ভারতে মহিলা ক্রিকেটের যাত্রাপথের বিভিন্ন পর্ব। সত্তরের দশক নাগাদ মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে ক্রমশ জনপ্রিয় হতে শুরু করলেও মেয়েদের ক্রিকেটের জন্য বরাবরই বরাদ্দ থেকেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখরাঙ্গানি। ইতিহাসের সেই প্রথম অধ্যায়ে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা মানে ঘরে বাইরে প্রতিকূলতা, ঘরোয়া টুর্নামেন্টে খেলবার সময় যাতায়াত চলত ট্রেনের প্যান্ট্রি কারে, বাথরুমের সামনে বসে। উইমেন্স ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সে সময় একেবারেই ভাঁড়ে মা ভবানী হাল, কালেভদ্রে ম্যাচ জুটত ডায়না এদুলজি, শান্তা রঙ্গস্বামী, শুভাঙ্গি কুলকার্ণির মত প্রথম প্রজন্মের ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটারদের। নিঃসন্দেহে বলা যায়, নিয়মিত ম্যাচের অভাবে অন্তত দশ বছরের ক্রিকেট জীবন হারিয়েছেন এঁরা। পূর্ণিমা রাও, অঞ্জুম চোপড়ার ক্ষেত্রেও ছবিটা একই, এঁরা না পেয়েছেন উন্নতমানের প্রশিক্ষণ, না পরিকাঠামো, না কর্তাব্যক্তি বা দেশের মানুষের কোনোরকম উৎসাহ। যে সময় ভারতীয় ক্রিকেটের মহাতারকা এবং বিপণন জগতের সেরা বাজি হিসেবে উঠে আসছেন সচিন তেণ্ডুলকর, সেই একই সময় ভারতবর্ষের কোন মেয়ে হাতে ক্রিকেট ব্যাট তুলে নিলে তাকে শুনতে হচ্ছে, ‘মেয়ে হয়ে ক্রিকেট খেলে হবেটা কি? ভবিষ্যৎ কোথায়?’ সত্যিই তো, রেলওয়েজের গুটিকতক চাকরি বাদ দিলে অন্নসংস্থানের জায়গা কোথায় মেয়েদের ক্রিকেটে? তা সত্ত্বেও বেয়াদব মেয়েরা কিছুতেই হাল ছাড়ে না, সাতসকালে ট্রেন বাসের লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে কিটব্যাগ কাঁধে সেই চাকদা থেকে কলকাতার বিবেকানন্দ পার্কে প্র্যাকটিস করতে আসে ঝুলন গোস্বামী নামে তালঢ্যাঙা এক মেয়ে, ইডেনের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার দাপুটে ফাস্ট বোলার ক্যাথরিন ফ্রিৎজপ্যাট্রিককে দেখে তার মাথায় ঢুকেছে ক্রিকেটের ভূত। অন্যদিকে হায়দ্রাবাদে উঠে আসছে আরেক বিস্ময় প্রতিভা মিতালি রাজ, প্রশিক্ষণ নিচ্ছে পূর্ণিমা রাওয়ের কোচ সম্পত কুমারের কাছে। বঞ্চনা অবশ্য চলেছে পুরোদমে, মহিলা জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের দেওয়া হচ্ছে পুরনো ছেঁড়া খাটো জার্সি, সেলাই করে নিলেও ত্রাউজার এসে থেমে যাচ্ছে ঝুলনের মোজার কাছাকাছি। ম্যাচের পর ম্যাচ খেলে আসার পর পায়ের ব্যথায় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমোতে যাচ্ছেন মিতালি রাজ, কারণ দলের সঙ্গে তো কোন ফিজিওই নেই! অথচ এই সময় সৌরভের উদ্যোগে পুরুষ দলে আসা বিদেশি ফিজিও লিপাস আর ল্য রুকে নিয়ে সংবাদপত্রে সে কি হইচই। অস্ট্রেলিয়ার কাছে বিশ্বকাপ ফাইনালে দুরমুশ হবার পরেও অ্যাম্বিভ্যালিতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট পাচ্ছেন সচিন সৌরভেরা, আর ভয়ানক খারাপ পরিকাঠামো নিয়েও সেই একই বিশ্বকাপ ফাইনাল অবধি যাওয়ার পরে মহিলা দলের জুটছে শুধুই বঞ্চনা। সৌরভ যখন ভারতীয় ক্রিকেটে কিংবদন্তির জায়গা নিচ্ছেন, সেই একই সময় ভুলভাল চিকিৎসায় কেরিয়ার প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে জাতীয় দলের দাপুটে বোলিং অলরাউন্ডার রুমেলি ধরের, প্রিয়াঙ্কা রায়ের কপালে জুটছে শুধুই উপেক্ষা। বিসিসিআই মহিলা ক্রিকেটের দায়িত্ব নেবার পরেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি তেমন কিছুই, উল্টে দুমদাম কোচ বদলের ফলে দলের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে আইপিএল আয়োজন করা বোর্ড প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাসনের মুখে শুনতে হয়েছে ডায়না এদুলজিকে, "মহিলাদের ক্রিকেট খেলার কোন মানেই হয় না, নেহাত আইসিসি জোর করেছে বলে তোমাদের বোঝা বইতে হচ্ছে।" অবশেষে অনুরাগ ঠাকুরের আমলে এসে পরিস্থিতি একটু একটু করে বদলাতে থাকে। মিতালি রাজের দল ২০১৭ বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌছনোর পর অবশেষে নড়েচড়ে বসতে থাকে সারা দেশ, আলোচনা শুরু হয় হরমনপ্রীত, স্মৃতি মন্ধানা, দীপ্তি শর্মা নামগুলোকে নিয়ে। অথচ এই বিশ্বকাপের পরেও বিদেশ সফরে গিয়ে ঠিকঠাক খাবারের অভাবে ভুগতে হয়েছে গোটা দলকে, অনেকেই বাধ্য হয়েছেন খালি পেটে বা দুটো কলা খেয়ে রাতে শুতে যেতে। মহিলা ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্তরে থাকা খেলোয়াড় যা বেতন পেতেন, তা ছিল সর্বনিম্ন স্তরে থাকা পুরুষ ক্রিকেটারের অর্ধেকেরও কম। এতদিন পর অবশেষে সমবেতন নীতি চালু করেছে ভারতীয় বোর্ড, ধুমধাম করে উদযাপিত হচ্ছে উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগ। কিন্তু সেই লিগেই খেলোয়াড় ক্যাচ মিস করায় তির্যক ‘উইমেন…’ মন্তব্য করে যখন বরখাস্ত হন পুরুষ ধারাভাষ্যকার, অথবা রান না পাওয়ায় স্মৃতি মন্ধানাকে নিয়ে চলতে থাকে অনায়াস রসিকতা, "রান আর কী করবে, মহিলা হয়ে অত টাকা পেয়ে ওর মাথা ঘুরে গেছে", তখন বেশ বোঝা যায়, রামায়ণের সীতার মতো এ দেশের মহিলা ক্রিকেটারদেরও বারবার দাঁড়াতে হয় অগ্নিপরীক্ষার সামনে। হার্পার কলিন্স প্রকাশনার মানের কথা মাথায় রেখেও তাই বলতে ইচ্ছে হয়, এ বইয়ের দাম খানিক কমালে বাস্তবের এই কলাবতীদের লড়াইয়ের গল্পগুলো এ দেশের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা আরও সহজ হবে বৈকি।
..................
#India women's cricket #Free Hit: The Story of Women's Cricket in India #Suprita Das #Harper Collins #silly পয়েন্ট