দ্য শো মাস্ট গো অন
যখন ছোটবেলায় 'The Show Must Go On' কথাটা প্রথমবার শুনেছিলাম, খুব ভালো লেগেছিল। বিশেষ করে একটু বড় হতে কথাটার পিছনে ভাবনাটা যখন বুঝেছিলাম, তখন। একজন শিল্পীর মান, সম্মান, জীবন, স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত জীবন, জীবিকা, আত্মীয়-পরিজন যার সঙ্গে যা খুশি হয়ে যাক, শো বন্ধ হওয়া চলবে না। সোজা কথায়, শিল্পের জন্য, শিল্পগ্রাহকদের জন্য শিল্পীর আত্মত্যাগের একটা চরম নিদর্শন।
প্রসঙ্গত বলি, পবিত্র সরকার তাঁর 'নাটমঞ্চ নাট্যরূপ' বইটিতে একটি অংশে নাট্যকার ব্রেখটের ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বলেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের 'পবিত্র মুহূর্তে', দেশের জন্য আত্মত্যাগ বিষয়ে একটা রচনা লিখতে দেওয়া হয়েছিল ব্রেখটের স্কুলে। মাত্র পনেরো বছরের ব্রেখট, ফুটবল খেলার বয়েসে এমন একখান লেখা লিখলেন, যে স্কুল থেকে বহিষ্কার হতে হতে বেঁচে গেলেন। কেন? কী এমন লিখলেন তিনি? তিনি লিখলেন কোনো আত্মত্যাগকে বীরত্বের পরাকাষ্ঠা হিসেবে দেখানোর আগে, আমাদেরকে তার পিছনের রাজনীতিটা নিয়ে ভাবতে হবে।
আমরা মধ্যমেধার মানুষ বলে এভাবে ভাবতে আমাদের পনেরো না, পঁচিশ বছর লেগে যায়। কিশোর ব্রেখটের ভাবনাটা শিল্প ও শিল্পীর প্রসঙ্গে আজ খুবই প্রাসঙ্গিক লাগে। বুঝতে পারি এই 'Show Must Go On' ভাবনার উত্থান, আসলে শিল্পের ধনতান্ত্রিক ধারণার নিগড় থেকে হয়েছে। বলা যেতে পারে, ধনতন্ত্র যেভাবে শিল্পকে দেখতে চেয়েছে, এটা তারই একটা দিক মাত্র। যদি প্রশ্ন করেন "কেন শো বন্ধ হওয়া যাবে না?" উত্তর পাবেন - শো না চললে মুনাফা আসবে না যে! অর্থাৎ, যে কোনো ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় যেহেতু মুনাফাই শেষ কথা বলে, অতএব মুনাফার খাতিরে ধনতান্ত্রিক যুগের শিল্পকর্মও শুধু নিরলস উৎপাদন করে যায়। এহেন ব্যবস্থায় কী কী গুরুত্বপূর্ণ? বিরতিহীন উৎপাদন, উৎপাদিত সামগ্রীর বাজার তৈরি করা, উপযুক্ত বিপণন ইত্যাদি। কারণ এই সকলকিছুই মুনাফা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক। তাহলে কী কী গুরুত্বহীন? উৎপাদনকারীর (এক্ষেত্রে শিল্পীর) সঙ্গে বিক্রিত পণ্যের ঘনিষ্ট যোগাযোগ, শ্রমের সঙ্গে পণ্যের যোগাযোগ, শ্রমিকের স্বার্থরক্ষা, উৎপাদিত দ্রব্যের গুণমান, উৎপাদনের প্রয়োজন ভিত্তিক সমবন্টন। এই সবগুলি গুরুত্বহীনের তালিকায় কারণ এগুলি কোনোটাই মুনাফা বাড়াতে সাহায্য তো করেই না, উল্টে অনেক সময় সেই পথে বাধা সৃষ্টিও করে থাকে। অন্যান্য সকল ইন্ডাস্ট্রির মতোই কলাভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
যে বাক্যটি দিয়ে নিবন্ধটা শুরু করেছিলাম, সেই বাক্যটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে শিল্পীর জন্য এক নীরব নির্দেশ--- শিল্পের উৎপাদনটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়াই তোমার একমাত্র চিন্তা। উৎপাদনের বিপণন, তার বাজারমূল্য, তোমার মজুরি, তোমার শ্রমের সঙ্গে দর্শক-পাঠকের সম্পর্ক, বন্টনের মূল্যবোধ এসব কোনোটাই তোমার মাথাব্যথার কারণ নয়। এগুলো শুধু মালিকপক্ষের ভাবনা নয়, এই সবকিছু নিয়ে ভাবার অধিকারটুকুও কেবলই মালিকপক্ষের কুক্ষিগত। তাই এই সকল বিষয়ে না তোমার দাবিদাওয়ার কোনো জায়গা আছে, না সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো পরিসর আছে, না নিজের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার কোনো সুযোগ আছে। এক কথায় শ্রমের ফসল, তার বাজারে অবস্থান, বাজারে তার স্থায়িত্ব ও বাজারমূল্য সবকিছু থেকে শ্রমিকের সম্পূর্ণ বিযুক্তিকরণ।
বিষয়টা কীরকম সেটা কয়েকটা উদাহরণ দিলে বোঝানো সহজ হবে। ধরুন আপনি একজন গায়ক, কোনো অনুষ্ঠানে আপনি পারফর্ম করতে যাবেন, এখন আপনারই অনুষ্ঠানের টিকিট কত হবে সেই বিষয়ে মতামত পোষণের আপনার কোনো অধিকার নেই। এমনকী আপনার নিজের উপযুক্ত পারিশ্রমিক কত সেটা নির্ধারণেও আপনার মতামতের থেকে বাজার অর্থনীতিতে সেই মুহূর্তে গায়কের এবং আপনার মতো গায়কের অবস্থান বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আপনার উৎপাদন করা শিল্প কার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে হবে আর কার নয়, সে বিষয়ে আপনার মতামত মূল্যহীন। যার মানে দাঁড়াল এটা যে, আপনার বাঁধা শ্রোতা কারা হবেন, সেটা আপনি বিন্দুমাত্র নির্ধারণ করতে পারবেন না।
বা ধরুন আপনি একজন লেখক বা সমালোচক। আপনি যেখানে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছেন, সেই অনুষ্ঠানের এন্ট্রি ফি কত, সেই নিয়ে আপনি হয় মাথাই ঘামালেন না, বা ঘামালেও আপনার মতামত নেওয়া হল না। ধরুন একদিন এমন ব্যাঙ্গাত্মক বাস্তবের সামনে এসে দাঁড়ালেন যে আপনার বক্ত্যবের বিষয় দলিত শ্রেণীর মানুষজন, এদিকে এন্ট্রি ফিয়ের ধাক্কায় একেবারে প্রিভিলেজের চূড়ায় বসা লোকজনরা হল ভরিয়ে দিল। আপনার শিল্পচর্চার অন্যতম উদেশ্যটাই ব্যাহত হয়ে গেল। আপনি যাদের কাছে আপনার শিল্পের মাধ্যমে পৌঁছতে চান আপনি সেটাই পারলেন না। আপনার নিজের রাজনীতির চোখে চোখ রাখতে পারলেন না নিজেই।
এবারে এই শিল্পীর রাজনীতি আর আদর্শের প্রসঙ্গেই আসছি। আচ্ছা, শিল্পীর স্বাধীনতা ঠিক কতরকমভাবে খর্ব হতে পারে? তার বিষয়-চয়নের উপর সমাজ বিশেষে খবরদারি, তার রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি সরকারবিশেষে বিদ্বেষ, তার মনোভাবের উপর রাষ্ট্রবিশেষে ব্যান ঘোষণা। ব্যাস? শুধু এইটুকুই? এইসব বহু চেনা রাস্তাগুলো ছাড়াও শিল্পীকে ক্ষমতার তলায় আনার আরো অন্তত একটা প্রধান রাস্তা তো আছেই। আর সেই রাস্তা একেবারেই উৎপাদন-ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত। একজন উৎপাদক হিসেবে স্রেফ উৎপাদন প্রক্রিয়ার ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে শিল্পীর বিচরণের অধিকার বেঁধে দেওয়াটাও শিল্পীর প্রতি ক্ষমতার চোখরাঙানির একটা নিয়মমাফিক নিদর্শন। সোজা কথায় ধনতান্ত্রিক সমাজে কলাকেন্দ্রিক শিল্পক্ষেত্রে বিষয়টা নেহাতই শ্রমিকের বিযুক্তিতে আটকে থাকেনা, শিল্পীর স্বাধীনতা ও অধিকার হরণের মধ্যেও ঢুকে পড়ে।
কীরকমভাবে হতে পারে এই প্রকার স্বাধীনতা হরণ ? ধরুন আপনি যে ফিল্ম সংস্থা, প্রকাশনা সংস্থার ( বা অন্য যে কোনো সংস্থা) পৃষ্ঠপোষকতায় আপনার শিল্পকে বাজারে আনছেন, সেই সংস্থার কোনো প্রক্রিয়া বা কোনো নীতি যদি আপনার আদর্শবিরোধী হয়, তাহলে কী আপনার শিল্পদ্রব্যের ক্ষেত্রে তাদেরকে নিজেদের ঘোষিত নীতি পালন করা থেকে নিরস্ত করতে পারবেন ? প্রশ্নটি জটিল এবং এর কোনো একমুখী উত্তর হয় না।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। 'শো মাস্ট গো অন' কথাটার মধ্যে আরও একটি অনুসঙ্গ আছে--- শিল্পীর জীবনের ব্যক্তিগত আর সর্বজনীনের দ্বন্দ্বের অনুসঙ্গ। এক শিল্পীর জীবনের দিক থেকে কী কী গুরুত্বহীন এই মুনাফা ব্যবস্থার কাছে? মান-সম্মান, জীবন, স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত জীবন, জীবিকা, আত্মীয়-পরিজন, আদর্শ, মানসিকতা এবং এমন সকল কিছু যা মুনাফার রাস্তায় বাধা তৈরী করে। ধনতন্ত্রের কাছে শুধু এসবকিছু মূল্যহীন নয়, সে বিরতিহীন উৎপাদনের স্বার্থে এই সবকটা ব্যক্তিগত জিনিসকে পণ্য বানিয়ে ফেলতে চায়, যা বিক্রি করে শিল্পী উৎপাদন চালিয়ে যাবে।
এখন যারা দর্শনগতভাবে বা জীবিকাগতভাবে ধনতান্ত্রিক শিল্প ধারণার ঝান্ডাধারী, তারা বলবেন--- শুধু টাকা নয়। মানুষের ভালোবাসা, কাজের জন্য আত্মত্যাগ ইত্যাদি। মজাটা হল, ওসব আমরাও ভেবেছি স্কুল কলেজে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়। শিক্ষকরা বলতেন জ্ঞান অর্জন করাই আসল, জীবনদৃষ্টি তৈরি করা আসল ইত্যাদি। কিন্তু জ্ঞান অর্জন করেও কম নম্বর পেলে তারাই দু-ঘা দিতেন। মোদ্দা কথা, তারাও জানতেন, আমরাও জানতাম, ভালো পড়াশুনো করার পিছনে ব্যাক্তিগত ভালোলাগা যাই থাক, বাস্তবে নম্বরটাই আসল। কারণ একটা নব্য-উদারবাদী সমাজে নম্বরই সরাসরি টাকায় অনুবাদিত হয়। অবশ্য আজকের বঙ্গদেশে ভালো নম্বর থাকলেও যে সৎপথে টাকা কামানো যায় না সেটা বুঝতে আমাদের আরো একটু বড় হতে হয়েছিল।
যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। ধনতান্ত্রিক শিল্পের মূলেও তাই-ই আছে। মানুষের ভালোবাসা, কাজের জন্য আত্মত্যাগ এসব শিল্পীর ব্যক্তিগত জিনিস, গ্রামসির কথা অনুসারে বললে সুপার স্ট্রাকচার বা বহিরঙ্গের সজ্জা। বাজারের কাছে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার পিছনে একটাই কারণ। মুনাফা। শো চলতে হবে কারণ তোমার মুনাফা চাই, তোমার যারা স্পনসর, যারা তোমায় ঠেলে স্টেজে তুলল, তাদের মুনাফা চাই। সবার মুনাফা চাই। তাই "Show Must Go On" !
শিল্প হবে মানুষের জন্য ? ছো ! শিল্প হবে মুনাফার জন্য !
শিল্প হবে কারণ ধনতন্ত্রর চাকাটাকে ঘড়-ঘড় করে ঘুরিয়ে যেতে হবে, যেতেই হবে। আর ওই চাকার ভারী ওজনের নীচে পিষে মরবে শিল্পীর মান, সম্মান, জীবন, স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত জীবন, জীবিকা, আত্মীয়-পরিজন সবকিছু। আর চাকার পিছনে লাগানো নিকাশী নল দিয়ে শিল্পীর রক্ত-ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে আসবে মুনাফা।
শিল্পের এই ধনতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরে এসে একটু যদি শ্রমকেন্দ্রিক দৃষ্টি থেকে দেখি আমরা তাহলে দেখতে পাবো শিল্পীরা আসলে শ্রমিক। ধনতন্ত্র আমাদেরকে শিল্পীদের এই মূল পরিচয়টাই ভুলিয়ে ছেড়েছে। তারা শিল্পী, তাদেরও শোষণ হয়, তাদেরও ব্যক্তি পরিসর বিক্রি হয়, তাদেরকেও তাদের শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন (গ্রামসির কথায় "Alienation of Labour") করে মুনাফা লোটে লোকে। মুনাফার চাকার তলায় নজরুল মঞ্চে যে মানুষ পিষে মারা গেলেন গত বছর, তিনিও একজন শ্রমিক। পয়সাওলা, সেলিব্রেটেড, প্রিভিলেজড শ্রমিক, কিন্তু শ্রমিক।
আর যদি শিল্পীর এহেন আত্মত্যাগ দর্শক, শ্রোতা, পাঠকের জন্য হত, তাহলে সে আত্মত্যাগের পেছনে একটা মূল্যবোধের জায়গা থাকতো | কিন্তু ধনতান্ত্রিক শিল্প কাঠামোয় শোষিত এক শুধু শিল্পী হননা | কনজিউমার তথা ভোগকারীরাও হয়ে থাকেন | আপনার কষ্টার্জিত পয়সায় কেনা টিকিটের কত অংশ শিল্পীর হাতে যায়, আপনার দেওয়া অর্থের কত অংশ প্রান্তিক কোনো শিল্পী পান, আদৌ পান কিনা, এসব আপনি কোনোদিন জানতে পারেন না, পারবেনও না। উৎপাদক আর উপভোক্তা দুজনেই শোষিত হয়। লাভের গুড় এক খেয়ে যায় মালিক পিঁপড়ে।
ভুল বলে লোকে যে, গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ হচ্ছে অলিম্পিক| গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ আসলে স্বয়ং ধনতন্ত্রের চাকার ঘূর্ণনটা।
............