কবুল না করার বিপদ : দ্বিতীয় পর্ব
কত ‘ছিদ্দৎ’ করা হয়, তবু ‘কমলি ছোড়ে না’। ধর-পাকড়, জুলুম-আটক করে ফাটকে নাহয় পোরা হল, কয়েদি যদি নিজে থেকে অপরাধের কথা স্বীকার না করে তবে তামাম খাটনি বেকার। যে অপরাধের কোনো সাক্ষী নেই সেখানে তদন্তে যতই অপরাধী সন্দেহে কাউকে আটক করা হোক না কেন, আসামি একরার করতে নারাজ হলে তাকে ছেড়ে দিতেই হবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলা ডিটেকশন-ডিডাকশনের আর কোনো দাম থাকবে না। আইনের পথে চলার এই এক মুশকিল। তার হাত এতই লম্বা যে, কখনও অপরাধের গোড়া সুদ্ধু উপড়ে ফেলে, আবার কখনও মুঠো গলে ঝরে গেলেও খেয়াল করে না।
পুলিশি তদন্তের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হল স্বীকারোক্তি আদায়। শারীরিক অথবা মানসিক দুদিকেই নানা কসরত করে তা আদায় করে নেওয়া হয়। ডিটেকশন থেকে ডিডাকশনে পৌঁছনোর এটাই সহজ পথ। কিন্তু আসামি যদি চূড়ান্ত ঢ্যাঁটা হয়? যদি শুরু থেকেই বা শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসে? যদি ক্রমাগত বয়ান বদল করতে থাকে অথবা বিন্দুমাত্র স্বীকার করতে না চায়? তখন কী করণীয়? ডিটেকশনের ধরনে কী বদল আসে?
কথা হচ্ছিল উনিশ শতকে গ্রামবাংলায় কোতোয়ালির ডিটেকশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্ব, আসামির স্বীকারোক্তি আদায়ের কলা-কৌশল সম্পর্কে। ‘মিয়াজান দারোগার একরারনামা’ থেকে তার কিছু নিদর্শন এর আগের পর্বে আমরা তুলে ধরেছি। কিন্তু আসামি যদি হয় মহা-খলিফা তখন সেসব তার কাছে মশার কামড় বই আর কিছু নয়। অল্পক্ষণ একটু জ্বালা করবে ঠিকই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যাবে। আর সাক্ষী সাবুদ না থাকলে বা লোপাট হয়ে গেলে নিজমুখে স্বীকার না করলে তেমন বড় কোনো সাজাও হবে না। সন্দেহের বশে তো যাবজ্জীবন অথবা দ্বীপান্তর হয় না। সেকালে ছোটখাটো চুরির দায়ে জেল-সফর ছিল আকছার ঘটনা। কত চোরের জীবন কেটে গেছে জেলের চৌহদ্দির ভেতর। গিরিশচন্দ্র বসু ‘সেকালের দারোগা কাহিনী’-তে উল্লেখ করেছেন, ইদা জোলা নামে এক চোরের কথা। নিজের জীবনের অর্ধেকটাই সে কাটিয়েছিল জেলের চৌহদ্দিতে। প্রত্যেকবার ছুটির সময় সে সহবন্দিদের উদ্দেশে একটাই কথা বলত, “ভাই দেখিস, তোরা যেন আমার ভাতের হাঁড়িটা নষ্ট করিস্ না, আমি শীঘ্রই ফিরিয়া আসিতেছি।” এবং দিন কয়েকের ভিতরই আবার তার হাঁড়িতে চাল ফুটতে শুরু করত। এই গিরীশচন্দ্র বসু-ই দেখা পেয়েছিলেন, মুন্সী শেখের। থানার ভিতর দাঁড়িয়ে যে বুক ঠুকে বলেছিল, “এই দেখুন যশোর জেলার এক পাপিষ্ঠ মুসলমান দারোগা তামাকের গুল পোড়াইয়া আমার জানুতে চাপিয়া ধরিয়াছিল।আমার জানুর মাংস চড়্ চড়্ করিয়া পুড়িয়া দুর্গন্ধ বাহির হইল, আমি চীৎকার করিয়া ক্রন্দন করিয়াছিলাম বটে কিন্তু একরার করি নাই। পাবনার বিখ্যাত মৌলবী ওয়াসফউদ্দীন দারোগা এক্ষণে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়াছেন; তিনি আমার হস্তের নখের ভিতর কাঁটা ফুটাইয়া দেখিয়াছেন; তাহাতেও তিনি কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই;” অতএব, বোঝাই যাচ্ছে ওসব ছেঁদো কায়দার ইস্তেমালে কোনোদিনও তাকে কাবু করা যাবে না। ভুললে চলবে না, এই থানাতেও অন্যসব থানার মতো তুড়ুমের ব্যবহার ছিল। অথচ সে একটুও টসকায়নি। প্রথমবার যখন তাকে নানা সূত্র মারফত খবর পেয়ে অতর্কিতে পাকড়াও করে আনা হল, তখন দিব্যি সুবোধ বালকের মতো সব কথায় সায় জানালেও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পৌঁছেই তার অন্য মূর্তি। কিছুতেই অপরাধের কথা স্বীকার করে না। ম্যাজিস্ট্রেট খাপ্পা, দারোগা বেকায়দায়। থানায় এসেও একই কথা। এক ফোঁটা জল অবধি খেতে না দেওয়া, দু তিন দিনের উপোস, তুড়ুমের ভয় সব মুষ্টিযোগ ব্যর্থ। বেশি জোরাজুরি করলে দারোগাকেই সরাসরি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসে। স্বীকারোক্তি তো পাবেন না, পারলে চোরাই মাল বের করে, অপরাধী প্রমাণ করে দেখান দেখি।
তুড়ুমের বিষয়ে কিছু কথা এখানে বলে নেওয়া ভালো। সেকালে দৈহিক নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রধান অস্ত্র ছিল তুড়ুম। ক্রাইম কাহিনি ছাড়াও সমকালের একাধিক লেখায় এর উল্লেখ আছে। এমনকি পুরোনো আমলের কলকাতায় সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে অপরাধীকে তার দ্বারা সংঘটিত অপরাধের মাত্রা অনুসারে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তুড়ুমে আটকে রাখার শাস্তি শোনানো হত। তুড়ুমের ঠিকুজি-কুলুজি শোনাবেন গিরিশচন্দ্র বসু-ই। খোদ দারোগা থাকতে অন্য কারও কাছে যাবই বা কেন?
‘তুড়ুম জিনিসটা কি, তাহা বোধ হয় আমার পাঠকগণের মধ্যে অনেকে জানেন না। তুড়ুম শব্দ ফরাসী ভাষা। ইংরাজিতে ইহাকে Stocks বলে। দুইখানা লম্বা ভারি কাষ্ঠ একদিকে শক্ত লোহার কব্জা দ্বারা আবদ্ধ, অন্যদিক খোলা; কিন্তু ইচ্ছা করিলে শিকলের দ্বারা বন্ধ করা যায়। এই খোলাদিকের মাথা ধরিয়া উপরের কাষ্ঠকে উঠান নামান যাইতে পারে। প্রত্যেক কাষ্ঠেই কয়েকটি অর্দ্ধচন্দ্রের ন্যায় এমন ভাবে ছিদ্র করা আছে যে একখানা কাষ্ঠের উপরে দ্বিতীয়খানা পাতিলে দুই ছিদ্রে একখানা গোলাকার ছিদ্র হয়। আসামিকে বসাইয়া কিম্বা শুয়াইয়া তাহার দুই পা একখানি কাষ্ঠের, দুই ছিদ্রের ভিতরে রাখিয়া উপরের কাষ্ঠ দ্বারা তাহা চাপা দিলে পা সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ হয় এবং আসামি আর নড়িতে পারে না। বিশেষ কষ্ট দেওয়ার মানস থাকিলে, পার্শ্ববর্ত্তী দুই ছিদ্রে পা না দিয়া, এক ছিদ্রমধ্যে রাখিয়া অন্তরের দুই ছিদ্রে পা আটকাইলে মানুষের অত্যন্ত ক্লেশ হয়। রাত্রিকালে দুরন্ত আসামিদিগকে নিশ্চিন্তরূপে আবদ্ধ রাখিবার নিমিত্ত সকল থানাতে ইহার এক একটা তুড়ুম ছিল।’ তবে মুন্সী শেখ ভয় না পেলেও তার মা কিন্তু তুড়ুমের ভয় পেয়েছিল। বরকন্দাজ পাঠিয়ে তাকে থানায় তুলে এনে তুড়ুমের সামনে খানিক হম্বিতম্বি করতেই ছেলের কষ্টের কথা ভেবে সে জানিয়ে দেয় চোরাই মালের ঠিকানা। দারোগার বুদ্ধির কাছে মুন্সী শেখ হেরে যায়।
পরিবারের কাউকে তুলে এনে জেরায় সামিল করে, ভয় দেখিয়ে কথা আদায়, এও ডিটেকশনের আরেক কৌশল। সবার থেকে নিজেকে আড়াল করলেও পরিবারের থেকে মানুষ নিজেকে চট করে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। একবার না একবার ঠিক কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ করে, আর ধরা পড়ে। তেমনিই পরিবারের মানুষটিও কাছের মানুষের গতিবিধি আন্দাজ করতে পারে, অনেক ক্ষেত্রে সমস্তটাই তাদের জানা থাকে। চোরাই মাল তাদের জিম্মায় রেখে অপরাধী নিশ্চিন্তে পিট্টান দেয়। আর দারোগা ‘শিক্ষা বিভ্রাটের’ ফলে ‘অবলা নারীদের মঙ্গলকামনায় চিত্ত ব্যাপৃত করিয়া’ খানাতল্লাশি মুলতুবি রেখে ফিরে আসেন। চোরাই মাল নির্বিঘ্নে পাচার হয়ে যায়। গিরিশবাবুকে ছেড়ে এবার একবার মিয়াজানের দরবারেও ঘুরে আসতে হবে, কারণ তিনিও এই বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিফ ছিলেন। “বেশিরভাগ মামলাতেই তো কী আসামি কী ফরিয়াদি তরফকে দেখা যায় সবকিছু ঢাকাচাপা দিতে ব্যস্ত। ডাকাতির মামলায় একটাই সুযোগ থাকে, যাকে ডাকাত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তার পরিবারের কোনো মেয়েছেলেকে ধরে এনে এই কলটা ব্যবহার করা। ডাকাতরাও এটা এত ভালো জানে যে সচরাচর নিজের বাড়ি যে থানার এলাকায় পড়ে সেখানে তারা ডাকাতি করতে চায় না।” কারণ এই সমীকরণে কান টানলে মাথা আসে, জলের মতন সহজ আঁকে বমাল গ্রেফতার হয় অপরাধী। বাহুবলের চেয়ে বুদ্ধিবলেই কিস্তিমাত করেন দারোগা।
শেষ করব, এই সকল কায়দার কয়েকটি প্রচলিত নামের উল্লেখ করে। কিছু নাম রীতিমাফিক, কিছু নাম ব্যঞ্জনাময়, কিছু নাম যেন কোনো কবির কলম থেকে জন্ম নিয়েছে। The Wicked City গ্রন্থে অধ্যাপক সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় তুলে এনেছেন সেইসব মণি-মুক্তো।
“We hear of the following practices used in the police thanas of Bengal, described in their respective police slang; (i) sarbat khaoano, meaning thrusting urine down the throat; (ii) rule deoa, forcing a rod into the rectum; (iii) shilpakarjya, literally suggesting a work of art, but actually meaning the insertion of needles into the nails; (iv) dalan, meaning pressing on a person’s body with a bamboo log; (v) dolon, in which a person is hung, with his head usually downwards, from a horizontal pole suspended from ceiling; and (vi)krishnachura, (the red-coloured shrub of bougainvillea), the name of a punishment where the hands of the accused are tied behind him, and he is forced to raise them upwards in an extremely painful exercise.”.
একটু একটু বুঝতে পারছেন তো, কেন পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা?
[ পোস্টার : অর্পণ দাস]
#বাংলা #নিবন্ধ #শৌভিক মুখোপাধ্যায় #তদন্ত #দারোগা #গিরিশচন্দ্র বসু #মিয়াজান