নিঃশব্দের তর্জনী : শঙ্খ ঘোষের কবিতায় প্রতিবাদ
রাত্রে ঘুমোবার আগে ভালবাসবার আগেপ্রশ্ন কর কোন দল তুমি কোন দল
এও লিখেছিলেন তিনি। এবং কোনও দলে না থেকে চিরকাল উঁচিয়ে রেখেছিলেন নিঃশব্দের তর্জনী। ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে কতিপয় না বিকিয়ে যাওয়া মেরুদণ্ড প্রতিবাদ করতেন, তাঁদের অগ্রণী ছিলেন শঙ্খ ঘোষ।
প্রতিবাদ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, প্রতি পূর্বক বদ্ ধাতু+ ঘঞ্ (অ) প্রত্যয়। অর্থাৎ বিরুদ্ধ বাচন। কে জানত সেই বাচন যদি ঢাকা থাকে অনুচ্চকিত স্থৈর্যে তাহলে তা হয়ে ওঠে আরও তীব্র! আরও কঠোর। শঙ্খ নিজে বলেছিলেন, “লিখতে হবে নিঃশব্দের কবিতা এবং নিঃশব্দ কবিতা”। তাঁর বন্ধু অলোকরঞ্জনও বলেছিলেন, “শব্দের ভিতর অন্তঃশীল নৈঃশব্দ্যই তাঁর উপাস্য একটি শর্ত”। কিন্তু সেই নৈঃশব্দ্য দিয়েই চুঁইয়ে পড়ে প্রতিবাদী সরবতা। উচ্চকিত না হয়েও যিনি সরব থাকতে পারেন, তিনি শঙ্খ ঘোষ।
এই মানুষটিই তো এ আমির আবরণে লিখবেন, একজন কবি যতই নিজের গভীরে নামতে থাকেন ততই সবার হয়ে ওঠেন। যদিও তা রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে। কিন্তু কবি শঙ্খ ঘোষও কি তা নন?
এ কথা সত্যি, শঙ্খের কবিতায় প্রতিবাদ চল্লিশ-দশকের কবিদের মতো উচ্চকিত নয়। বাংলা কবিতা: মেজাজ ও মনোবীজ-এ জহর সেনমজুমদার লিখলেন, “চল্লিশ দশকের বেশ কয়েকজন কবির কবিতায় যে প্রবল এবং অনিবার্য সমকালমনস্কতা, পঞ্চাশে এসে তা যখন প্রায় ধূসর– তখনই মর্ম নিংড়ানো ব্যর্থতাকে সমষ্টির চৈতন্যে মিলিয়ে দেবার আকুতিসহ শঙ্খ ঘোষের আবির্ভাব”। অর্থাৎ শঙ্খ ঘোষের কবিতা আত্মের হয়েও সমগ্রের। তাঁর অমোঘ হাতিয়ার নৈঃশব্দ্য।
বস্তুত এই নৈঃশব্দ্যই শঙ্খের কবিতায় গড়ে তুলল এক প্রত্যাখ্যানের আখ্যান।
১৯৪৯ থেকে ১৯৫৪-এর মধ্যে লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ দিনগুলি রাতগুলি-তে যখন শঙ্খ লেখেন, “মানচিত্র রেখা ,তুমি দেশ নও মাটি নও তুমি”– তখন এই শব্দগুলি কেবল দেশভাগের বিষাদস্মৃতি নিয়েই সুখী থাকে না। প্রত্যাখ্যান করে রাষ্ট্রযন্ত্রের কৃত্রিম মানচিত্ররেখাগুলিকে। অস্বীকার করে সমস্ত কাঁটাতার। এই প্রতিবাদেরই অন্যতর ভাষ্য রচিত হয় যমুনাবতী কবিতায়। স্বাধীনতার পর পেরিয়ে গেছে চারটি বছর। “দেশের মানুষের কাছে তার খবর এসে পৌঁছেছে। কিন্তু খাবার এসে পৌঁছয়নি তখনও”। ১৯৫১ সাল। খাদ্যের দাবিতে কোচবিহারে মিছিল হয়। পুলিশের গুলিতে মারা যায় ষোলো বছরের এক কিশোরী। “স্বাধীন দেশে স্বাধীন পুলিশের হাতে স্বাধীন এক কিশোরীর কত অনায়াস সেই মৃত্যু”। এই কিশোরীই হয়ে ওঠে যমুনাবতী সরস্বতী। যমুনাবতী কবিতার শেষে যখন শঙ্খ ঘোষ লেখেন,
'যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ গিয়ে
নিভন্ত এই চুল্লিতে বোন আগুন ফলেছে।'
তখন তা বিপ্লবের আগুনপথের দিকেই যেন ইঙ্গিত করে।
স্বভাবতই এই কবিতাগুলি সাময়িক- রাষ্ট্রনৈতিক বিভিন্ন ক্ষতের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে। এভাবেই জন্ম নেয় “ইন্দ্র ধরেছে কুলিশ’, ‘হাসপাতালে বলির বাজনা’, ‘রাধাচূড়া’, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’, ‘বিকল্প’, ‘হাতেমতাই’-এর মতো একের পর এক বিস্ফোরক কবিতা।
তারাপদ আচার্য বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে বলেছেন, “সম্পূর্ণ প্রতিবাদী কবিতার সংকলন এটি”। এক অর্থে অবশ্য শঙ্খের প্রায় প্রতিটি কবিতার বইয়ে কিছু না কিছু প্রতিবাদের কবিতা আছে।
বস্তুত, ‘মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়’, ‘বাবরের প্রার্থনা’ এবং ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’ প্রতিবাদী শঙ্খের দৃঢ় সংহত প্রকাশ। নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিত, রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার, এই সবই ঠাঁই করে নিয়েছে এইসময় লেখা তাঁর কবিতায়।
নকশালপন্থী ছাত্র তিমিরবরণ সিংহের মৃত্যুতে কবি লিখেছিলেন, ‘তিমির বিষয়ক দু-টুকরো’। ‘হাসপাতালে বলির বাজনা’ কবিতায় এই কবিই লিখলেন,
‘আমরা সবাই বলেছিলাম: শেষ সময়ের
হাসপাতালে বলির বাজনা। ভাই ছিল ফেরারি’।
‘কিছু না কিছু ছেলে’ কবিতায় কবি লিখলেন,
‘তবু তো দেখো আজও ঝরি
কিছু না থেকে কিছু ছেলে
তোমারই সেন্ট্রাল জেলে
তোমারই কার্জন পার্কে’।
শঙ্খ ঘোষের ‘রাধাচূড়া’, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’ কবিতা দুটি ফিরে এসেছিল ‘নট টু বি প্রিন্টেড’ এই সরকারি শিলমোহর নিয়ে। রাজ্যে তখন জরুরি অবস্থা জারি। এই সময়ই শঙ্খ ঘোষের কলম থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক প্রতিবাদী ভাষ্য।
* পেটের কাছে উঁচিয়ে আছো ছুরি
কাজেই এখন স্বাধীন মত ঘুরি
* খুব যদি বাড় বেড়ে ওঠে
ছেঁটে দাও সব মাথা
* হাতের কাছে ছিল হাতেমতাই
চুড়োয় বসিয়েছি তাকে
… … …
আমার বাঁচা মরা তোমারই হাতে
স্মরণে রেখো বান্দাকে।
* আর তাছাড়া ভাই আমরা সবাই ভেবেছিলাম হবে
নতুন সমাজ চোখের সামনে বিপ্লবে বিপ্লবে
যাবে খোল নলিচা
যাবে খোল নলিচা পাল্টে বিচার করবে নিচু জনে
কিন্তু সেদিন খুব কাছে নয় জানেন সেটা মনে
মিত্র বাবুমশায়
* অল্প দুচারজন বাকি থাকে যারা
তেল দেয় নিজের চরকায়
মাঝে মাঝে খরখরি তুলে দেখে নেয়
বিপ্লব এসেছে কতদূর ( ক্রমাগত)
* মুণ্ডমালায় ওই হেঁটে যায়
দশ বছরের দেনা
বুড়ি শুধু ডাকে ও বাপু ছেলেরা
কেউ কিছু বলবে না?
আরও পড়ুন : কবির হাত শিকলে বাঁধা পড়ে না / সৃজিতা সান্যাল
জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে শঙ্খ লিখেছিলেন ‘বিকল্প’ নামক কবিতাটি।
‘কথা তবু থেকে যায় কথার মনেই
কঠোর বিকল্পের পরিশ্রম নেই’
রাষ্ট্রযন্ত্রের অবদমন, পুলিশি অত্যাচার, নিয়ন্ত্রণ-উত্তর স্বাধীনতাপর্বের অবশিষ্ট সময় ধরে যে ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাস রচিত হয়েছে তার অপরিবর্তনীয় সত্য। এই সময়ের ছাপ ও তাপ ধরে রাখে শঙ্খ ঘোষের কবিতা।
* সবাই পথ দেবার জন্য কয়েকজনকে সরতে হবে
তেমন তেমন সময় এলে হয়ত আমায় মরতে হবে
বুঝতে পারি
* পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা
যতক্ষণ আমার পুলিশ
বস্তুত, যতবারই শাসকের আগ্রাসন তীব্র হয়েছে ততবারই শঙ্খ ঘোষ প্রতিবাদ করেছেন। একদম নিজস্ব স্বকীয় ভঙ্গিতে। কবিতায় বুনে তুলেছেন বিরুদ্ধতার স্বর। তা সে খাদ্য আন্দোলন হোক, নকশাল আন্দোলন হোক, সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম ভাঙর হোক, অথবা CAA-NRC। কবি এখানে কেবল দ্রষ্টা নন।
সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের পর তিনি লেখেন ‘মাওবাদী’, ‘সবিনয় নিবেদন’, ‘শবসাধনা’, ‘বহিরাগত’র মতো কবিতা।
আবার তিনিই তো লিখতে পারেন,
‘দেখ খুলে তোর তিন নয়ন
রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে
দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।’
NRC আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তিনিই লিখলেন ‘মাটি’–
'গোধূলি রঙিন মাচা, ও পাড়ায় উঠেছে আজান
এ-দাওয়ায় বসে ভাবি দুনিয়া আমার মেহমান।
এখনও পরীক্ষা চায় আগুনসমাজ
এ মাটি আমারও মাটি সেকথা সবার সামনে কীভাবে প্রমাণ করব আজ।'
গতকাল মারা গেলেন তিনি। তবু রইলেন। নিঃশব্দের তর্জনী নিয়ে। বিবেকের মতো। প্রত্যয়ী দার্ঢ্যে। ফ্যাসিবাদী জুজুরাও চিরকাল মনে রাখবে, একজন শঙ্খ ঘোষ ছিলেন।
.......................................
#Shankha Ghosh #শঙ্খ ঘোষ #কবি #প্রবন্ধকার #poet #bengali poet #সাহিত্যিক #স্মৃতি #শ্রদ্ধা #বিবস্বান দত্ত #সিলি পয়েন্ট #জুজু #সিরিজ #রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন-বিরোধী লেখাগুচ্ছ