খাঁচার ভিতর অচিন পাখি: 'গোরা' এবং উত্তর-অধুনাবাদ
রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাসগুলির একটি। ‘গোরা’-কে নানাভাবে পাঠ করা হয়েছে - গ্রহণ করা হয়েছে মহৎ উপন্যাস হিসেবে, চিহ্নিত করা হয়েছে বিদেশী উপন্যাসের অনুকরণ হিসাবে। কিন্তু অধিকাংশ আলোচনা কাহিনি, বর্ণনা, শিল্পরূপ বিশ্লেষণ অথবা রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচেতনার বিবরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গভীর বা নিবিড় পাঠ এখনও সেভাবে করা হয়নি। এখনও স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি ‘গোরা’-র বহুমাত্রিক সংকেতের প্রান্তর।
দুটি পরস্পর-প্রবিষ্ট কারণেও ‘গোরা’ পাঠের গুরুত্ব এখন প্রবল। দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতার পুনরুত্থানের ফলে জাতি গঠনের ক্ষেত্রে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের বাধ্য করছে উপন্যাসটির কাছে ফিরে যেতে। জাতিগঠনের যে ভিন্ন চৈতন্য, যে ভিন্ন নকশা রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছিলেন, তা গোরার মধ্যে প্রবলভাবে উচ্চারিত। একই কারণে জরুরি হয়ে পড়েছে আধুনিকতার প্রসঙ্গটি পুনর্বিবেচনার। আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের যে সরল দ্বিভাজন সামাজিক বিজ্ঞান বা রামমোহন রায় থেকে ভারতীয় সমাজচিন্তা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে তা এখন প্রায় বর্জিত। কিন্তু ‘গোরা’-র ক্ষেত্রে প্রত্যয়দুটিকে অনেক বাস্তবোচিতভাবে ব্যবহার করা যায়। পার্থ চ্যাটার্জী (১৯৮৬) উপনিবেশের পরিসরে আত্মিক সংস্কৃতিকে জাতীয়তাবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি অবশ্য উপন্যাসকে আলোচনার পরিসরে আনেননি। কিন্তু উপন্যাসের জমিনেও বিস্তার লাভ করে ক্ষমতার লড়াই। তার মধ্যে প্রবেশ করে সাম্রাজ্যবাদ, কাজ করে প্রতিঘাত। এডওয়ার্ড সাইদের ভাষায় বুর্জোয়া সমাজের সাংস্কৃতিক নির্মাণ হিসেবে উপন্যাসকে সাম্রাজ্যবাদ থেকে ভিন্নভাবে চিন্তাই করা যায় না (Said, 1993)। একইভাবে, লেখক বা চিন্তকের সামাজিক পটভূমি বা জীবনচক্রকে বাদ দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে অনুধাবন করার কথা চিন্তাই করা যায় না। বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথের জন্য প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতে বৃটিশ শাসনের কথা বলতে গিয়ে ১৮৫৩ সালে মার্কস লিখেছেন : “হিন্দুস্থান হল প্রাচ্যের আয়ারল্যান্ড ... কামনার এক জগতের সঙ্গে দুর্দশার এক জগতের এই বিচিত্র মিলন তা হিন্দুস্থানের প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্যেই সূচিত।” (মার্কস এবং এঙ্গেলস, ১৯৭১:৩৬)। কিন্তু এই পুরনো জগত ভেঙে দিয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসন।
“ইংল্যান্ড ভারতীয় সমাজের সমগ্র কাঠামোই ভেঙে দিয়েছে...পুরনো জগতের বিনাশ অথচ নতুন কোন জগতের অনুপস্থিতি হিন্দুদের বর্তমান দুর্দশার উপর এক বিশেষ ধরনের বিষাদ নির্মাণ করে দিয়েছে। ইংরেজ শাসন হিন্দুস্থানকে তার সমগ্র প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সমগ্র অতীত ইতিহাস থেকে পৃথক করে দিয়েছে।” (অনুবাদ প্রবন্ধকারের। তুলনীয় মার্কস এবং এঙ্গেলস, ১৯৭১ : ৩৮)।
এই বিষাদের উপর অবশ্য এক নতুন জগত তৈরি হচ্ছিল। মার্কসের লেখার কিছু আগে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতার প্রান্তেই গড়ে উঠেছিল এক উল্লেখযোগ্য শিল্পকেন্দ্র। ইংল্যান্ডের শিল্পপতিরা তাকে আশংকার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। ‘গঙ্গার তীরে দ্বিতীয় ল্যাংকাশায়ারের দৃশ্য যা ভারতের সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল দিয়ে মূল নগরটিকে’ হারিয়ে দিতে পারত।” (Kling, 1976:31)।
ভারতবর্ষ বিশ্ব-অর্থনীতির সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। এই সম্ভাবনার নায়ক ছিলেন দ্বারকনাথ ঠাকুর, যাকে তুলনা করা যায় যেকোন বিশাল বুর্জোয়া উদ্যোক্তার সাথে। কিন্তু উপনিবেশের পরিসরে বুর্জোয়া বিকাশ সম্ভব ছিল না। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবন সমাপ্ত হয়েছিল বিশাল ঋণের মধ্যে।
ঠাকুর পরিবারের উত্থান-পতন উপনিবেশের সাথে নিয়তির মতো যুক্ত। গঙ্গার তীরে জেলেদের ব্রাহ্মণ থেকে শুরু হয়ে দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিশাল বিত্ত ইংরেজ শাসনের ফলজাত। দ্বারকানাথের দূরদৃষ্টি এবং ইংরেজদের আইন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জমিদার হবার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি পিতার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হাল ধরতে চাননি। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন জনক এবং জননীর পরস্পর-বিপ্রতীপ জগতের ভিতর দিয়ে - এমিল দুরক্যাঁ (১৯৫৪) যাকে বলেছেন আটপৌরে (profane) এবং পবিত্র (sacred) বা ভেবার যাকে বলেছেন আধুনিকতা এবং ঐতিহ্য - এই দুয়ের ভিতর দিয়ে। এই দ্বন্দ্ব থেকে উত্তরণের জন্য তিনি খুঁজেছিলেন আত্মিক শান্তি। দেবেন্দ্রনাথই রামমোহনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আত্মিক ঐশ্বর্যের বিস্তারে।
রবার্ট নিসবেট (১৯৭২) দেখিয়েছেন ইউরোপে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রের উত্তরণের সময় সমাজ, কর্তৃত্ব, পদমর্যাদা, পবিত্র এবং বিচ্ছিন্নতা সামাজিক চিন্তার কেন্দ্রপটে চলে এসেছিল। চিন্তার জগতে সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্নমুখী দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে ছিল দুই সমাজ ব্যবস্থার সংঘাত, শিল্পবিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ নিয়ে দ্বন্দ্ব। সৃষ্টি হয়েছিল ব্যক্তি এবং জাতিসত্তার স্বরূপের মধ্যে বিরোধ। এক কথায়, বিরোধ তৈরি হয়েছিল ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে।
উপনিবেশের পরিসরে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে। ঔপনিবেশিক আধুনিকতা পশ্চিমের আধুনিকতা থেকে ভিন্ন ও বহুমাত্রিক। ফানোঁ উপনিবেশের বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে তিনটি পর্ব শনাক্ত করেছেন। প্রথম পর্যায়ে বুদ্ধিজীবিরা আগ্রাসনকারীর সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিপর্যস্ত হন। তাঁরা অনুসন্ধান করেন, অতিরঞ্জিত করেন ঐতিহ্যকে, লোকজীবনকে। কিন্তু লোকজীবনের সাথে সম্পৃক্ত না থাকার কারণে তাদের চিত্রকল্প নির্মিত হয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার পরিসরে। তৃতীয় পর্যায়ে তাঁরা লোকজীবনের মধ্যে প্রবেশ করেন, জাগ্রত করেন মানুষকে সংগ্রামের জন্য (Fanon, 1974)। অস্মিতার পর্যায়ে উপনিবেশের পরিসরে প্রতিক্রিয়াশীল আত্ম-নির্মিতিরও (reactive identificaiton) তিনটি পর্যায় রয়েছে - অত্যাচারীর দিকে যাত্রা, অত্যাচারী থেকে পশ্চাদপসারণ এবং অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যাত্রা (Bullhan, 1977)। এই ধরনের বিভাজনের একটি অসুবিধা হচ্ছে বাস্তবে কখনও কখনও বিভিন্ন রূপগুলো সম্পৃক্ত থাকে একই সাথে।
দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামমোহন রায় অগ্রসর হয়েছিলেন পশ্চিমের দিকে। রামমোহন রায় মেলাতে চেয়েছিলেন বোস্টন, ব্রিস্টল আর কলকাতাকে। আকর্ষিত হয়েছিলেন প্রোটেস্টান্ট ধর্মের একটি মতবাদ ইউনিটেরিয়ানিসমের প্রতি। রামমোহন রায় ব্রিস্টল থেকে আর ফিরলেন না। তাঁর স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৪৩ সালে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করে। এই ব্রাহ্মসমাজই প্রবলভাবে আত্মস্থ করেছিল পশ্চিমের যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী ভাবনা। যে পার্কারের বই আমরা পরেশ বাবুর ঘরে দেখতে পাই সেই থিওডোর পার্কার ছিলেন অন্যতম এক ব্যক্তিত্ব যাঁর মাধ্যমে এই প্রভাব তৈরি হয়েছিল।
It was the discovery of Parker by the Brahmos--his collected works in Bengali translation in the 1860s--which provided them with a vital and powerful bond of common values and ideas. What was the image of Parker that so moved the progressive Brahmos? Theodore Parker had felt the sudden influence of Emerson in 1840, turned to socially activist Unitarianism in the 1840s, and became its most outspoken and dynamic leader (Kopf, 1997: 27).
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সি.এইচ.এ. ডাল ১৮৫৫ সালে ভারত আসার পর উইলিয়াম চ্যানিং, এমারসন ও পার্কারের সমস্ত লেখার হাজার হাজার কপি ব্রাহ্মদের মধ্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে ১৮৬০ এর দশক থেকে ’পবিত্র’-এর স্বরূপ নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রচণ্ড বিতর্ক। ক্রমশ এই বিতর্ক যুক্ত হয়ে গিয়েছিল অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাহ্ম ধর্মের বিস্ময়কর আধুনিকতার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। ব্রাহ্ম ধর্মের মূল বিশ্বাস হচ্ছে, ঈশ্বর এক এবং অনন্ত এবং তিনি সমস্ত কিছুর স্রষ্টা। তাঁর উপাসনা সমস্ত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সুখের উৎস। এই মূল বিশ্বাসের মধ্যে কর্ম বা পুনর্জন্মের কোনও স্থান নেই। মূল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজ ছিল যথেষ্ট রক্ষণশীল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বস্ত ছিলেন জননীর প্রতিও - ত্যাগ করেননি ঐতিহ্যকে। রবীন্দ্রনাথের জন্ম এবং তাঁর সামাজিকীকরণ এই পরিবেশে।
রবীন্দ্রনাথের সামাজিক পটভূমি নির্মিত হয়েছিল প্রাক-ধনতান্ত্রিক এবং প্রান্তিক ধনতন্ত্রের পরস্পর-প্রবিষ্ট কাঠামোর মধ্যে। ঐতিহ্যগত সমাজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিরালি ব্রাহ্মণ। ঠাকুর পরিবারের জ্ঞাতি-সম্পর্কের নকশার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই অধিকাংশ বিয়ে হয়েছে এই ছোট সম্প্রদায়ের মধ্যে (দেব, ১৩৮৭)। এই প্রান্তিকতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্ম ধর্মের কারণে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ের সময় দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন : “জ্যোতির বিবাহের জন্য একটি কন্যা পাওয়া গিয়াছে এই ভাগ্য--একে পিরালী বলিয়া ভিন্ন শ্রেণীরা আমাদের সঙ্গে বিবাহতে যোগ দেয় না তাহাতে আবার ব্রাহ্ম ধর্ম অনুষ্ঠান এর জন্য পিরালীরা আমাদিগকে ভয় করে।” (উল্লিখিত: দেব, ১৩৮৭:৫০)। তাঁর পাঁচ জামাইয়ের মধ্যে চারজনই ছিলেন ঘরজামাই। যিনি ঘরজামাই হননি, সেই জানকীনাথ ঘোষাল সাময়িকভাবে সম্পত্তি হারিয়েছিলেন (দেব, ১৩৮৭)। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ব্রাহ্মরাও ছিলেন সংখ্যায় স্বল্প। ওমান জানাচ্ছেন ১৮৪৩ সালে ব্রাহ্মসমাজের সদস্য সংখ্যা ছিল ৮৩ জন। তাঁর এক উত্তরদাতার মতে ১৯০৫ সালে আদি ব্রাহ্মসমাজের মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০ জন (Campbell, n.d.) । রবীন্দ্রনাথ জনকের নিঃসঙ্গতাকে চিহ্নিত করেছেন এইভাবে : “হিন্দু সমাজের মধ্যে তিনি পরম দুর্দিনে একাকী দাঁড়াইয়াছিলেন, ব্রাহ্মসমাজে তিনি নব আশা এবং উৎসাহের অভ্যুদয়ের মুখে পুনর্বার সমস্ত ত্যাগ করিয়া একাকী দাঁড়াইলেন” (ঠাকুর ১৩৮২, ৪: ৫২৮)।
ঠাকুর পরিবারের এই দ্বৈত প্রান্তিকতার সাথে যুক্ত হয়েছিল শ্রেণিগত প্রান্তিকতা। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু জমিদার ছিলেন তাই তাঁর সামাজিক অবস্থান নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি আছে। বাংলাদেশের একজন রবীন্দ্র গবেষক সৈয়দ আকরম হোসেন তাঁর শ্রেণিগত অবস্থান এবং চৈতন্যের মধ্যে বৈপরীত্য লক্ষ করেছেন।
“রবীন্দ্রনাথ ভূমি-নির্ভর অভিজাত বংশে জন্মগ্রহণ করলেও ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক ঐতিহ্য তিনি তিনি তাঁর শোণিতপ্রবাহে বহন করেননি। --রবীন্দ্রনাথ মূলত: জমিদার, অর্থাৎ সামন্ত প্রভু ছিলেন না। তিনি ছিলেন জমিদার ছদ্মবেশে গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী এক সৃষ্টিশীল পুরুষ” (হোসেন, ১৯৮১ : ৩৫-৩৬)। রবীন্দ্রনাথকে ছদ্মবেশী secret agent ভাবার কোন প্রয়োজন নেই। জমিদার হলেও তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের প্রদত্ত ‘মাসোহারা নির্ভর’ (বন্দোপাধ্যায়, ২০১৫)। তিনি বিত্তবান ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতির মধ্যে তাঁর শৈশবের জীবনযাত্রার যে ছবি তুলে ধরেছেন তা উল্লেখযোগ্য। “আমাদের শিশুকালে ভোগবিলাসের আয়োজন ছিল না বলিলেই চলে।----আহারে আমাদের শৌখিনতার গন্ধও ছিল না। কাপড়চোপড় এতই যৎসামান্য ছিল যে এখনকার ছেলের পক্ষে তাহার তালিকা ধরিলে সন্মানহানির আশঙ্কা আছে”(ঠাকুর, ১৩৬১:২৬৮)। নীরদ চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের জীবন যাত্রায় সমকালীন জমিদারদের কোন বৈশিষ্ট্যই পরিলক্ষিত হতো না। গৃহসজ্জা, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করতো মধ্যবিত্ত বাঙ্গালি রুচি। হেমলতাকে লেখা ১৯১৩ সালের এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন:“আমার নিজের বিশেষ দিকটাতে আমি খুবই ছোট-সেখানে আমি বিষয়ী, সেখানে আমি হিসাবী, সেখানে আমি দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র এবং বিরাহিমপুরের জমিদার, সেখানে কোন লোকসানই আমার সহ্য হয় না” (দেশ, শারদীয় ১৪০০ : ৩১)।
এছাড়াও স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বুর্জোয়াদের অভিজাত শ্রেণীতে রূপান্তর ইউরোপের ইতিহাসের একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া। সমকালীন সময়ের সবচেয়ে খ্যাতিমান ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানী ইম্যানুয়েল ওয়ালারস্টিন বিষয়টিকে এভাবে তুলে ধরেছেন - স্বল্পমেয়াদে “প্রত্যেক বুর্জোয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে অভিজাত হওয়া।” (Wallerstein, 1989: 101)
অর্থনৈতিক উন্নয়নের খ্যাতিমান তাত্ত্বিক রষ্ট্রো বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রজন্মগত রূপান্তরকে চিহ্নিত করেছেন, ‘Buddenbrooks Phenomenon’ বা ‘Buddenbrooks Dynamics’ নামে। “টমাস মানের তিন প্রজন্মের উপন্যাসে প্রথম পুরুষ খুঁজেছিল অর্থ, বিত্তের মধ্যে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় প্রজন্ম খুঁজেছিল সামাজিক এবং নাগরিক মর্যাদা এবং স্বচ্ছলতা এবং পারিবারিক মর্যাদার মধ্যে জন্মগ্রহণকারী তৃতীয় প্রজন্ম আকর্ষিত হয়েছিল সঙ্গীতের জগতের দিকে” (Rostow, 1968 : 11)। দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ উপরের দুটি বক্ত্যবের সত্যতা তুলে ধরে।
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনও প্রাথমিকভাবে ছিল প্রান্তিক। ১৮৮২ সালে রবীন্দ্রনাথের বয়স একুশ। কর্মহীন জীবন, নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়া শেষ হয়েছে তেরো বছর বয়সে। তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা দেবার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ব্যারিষ্টার হলেন না তিনি। ডেভিড কফ(Kopf, 1797) আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন ব্রাহ্ম আদর্শের সাথে কত প্রচ-ভাবে সঙ্গতিহীন এই স্কুলছুট যুবক। প্রতিভাবান অগ্রজদের পাশে কী নিষ্প্রভ তিনি! ব্যক্তিজীবনেও তিনি প্রান্তিক। শুধু প্রান্তিক নন, শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছেন আউটসাইডার হিসাবে। জীবনস্মৃতির একটি ছবি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। এক মেঘলা দিনে সন্ত্রস্ত রবীন্দ্রনাথ আশ্রয়ের জন্য দৌড় দিয়েছেন অন্তপুরে, জননীর কাছে। তিনি কোন উৎকন্ঠা দেখালেন না। অভিমানী বালক রামায়ণ পড়তে বসলেন। এক সময় চোখে জল চলে এলো। জীবনস্মৃতিতে জননীর প্রথম এবং বিরল উল্লেখ। তবু ছবিটি প্রত্যাখ্যানের ছবি। উপনয়নের আগে পর্যন্ত জনকও থেকেছেন সুদূরবর্তী। বাড়ির ভিতরে সর্বত্র যেতে পারেননি। কাদম্বরী দেবী নতুন বউ হয়ে এসেছেন, কাছে ঘেষতে পারেননি, ধমক খেয়েছেন। ‘হেলাফেলার’ ‘অনাদৃত’ এইভাবেই চিহ্নিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ শৈশবের জীবনকে (চৌধুরী, ১৯৯২)। বেড়ে উঠেছেন ভৃত্যতন্ত্রের মধ্যে।
“ছিলুম স্রোতের শেওলার মতো--সংসার-প্রবাহের উপরতলে হালকাভাবে ভেসে বেড়াতুম--কোথাও শিকড় পৌঁছয়নি--যেন কারো ছিলুম না, সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত চাকরদের হাতেই থাকতে হত; কারো কাছে কিছুমাত্র আদর পাবার আশা ছিল না।” (ঠাকুর, ১৩৬১: ৪৬০)।
শৈশব থেকেই তাঁর আত্ম-পরিচয় তৈরি হয়ে যাচ্ছে উন্মূল আউটসাইডার হিসাবে-আউটসাইডার কিন্তু আবদ্ধ। ১৮৮১ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ বাস করেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে মোরান সাহেবের বাগান বাড়িতে এবং ১০ নম্বর সদর স্ট্রীটে। নীরদ চৌধুরী (১৯৯২) দেখিয়েছেন ঐ সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীর নাম উল্লেখ করছেন না। সদর স্ট্রীটে থাকার সময়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনে একটা কিছু ’উলট-পালট’ ঘটে যায়। নীরদ চৌধুরী অনুমান করেছেন এই ‘উলট-পালট’ এর উৎস, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের উৎস, কাদম্বরী দেবীর সাথে তাঁর প্রেম। এই সময়ের রবীন্দ্রনাথের অনুভবের সঙ্গে তিনি গোরার মধ্যে প্রেমের বর্ণনার সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে গোরাদের বাড়ির যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা, নীরদ চৌধুরী দেখিয়েছেন, সদর স্ট্রীটের বাড়ীর সাথে মিলে যায়। দ্বিতীয়বার অসমাপ্ত বিলেত যাত্রার আগে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাসায় থাকার ঠিক আগে, জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করছেন অনেকদিন পরে বোলপুরে শোনা গানটি-‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’। গোরার মধ্যে গানটি বিনয়ের প্রেমের পূর্বাভাষ তৈরি করে দেয়।
১৮৮৩ সালের ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হল পূর্ব বাংলার ঠাকুর এস্টেটের এক সাধারণ কর্মচারীর কন্যার সাথে। তখনকার দিনে এ ছিল অনেকটা সাদা-কালোর বিয়ের মতো (চৌধুরী, ১৯৯২)। চারমাস পরে বৈশাখের এক অপরাহ্নে কাদম্বরী দেবী এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে কিছু বলতে। রবীন্দ্রনাথ অন্যমনস্ক ছিলেন। কথা হয়নি। সেই রাতেই কাদম্বরী দেবী চলে গেলেন চিরকালের জন্য (সেন, ১৩৯৩)। যিনি মাস দুয়েকের জন্য বেড়াতে গেলে মনে হয়-
“চলে গেল সকলেই চলে গেল গো,
বুক শুধু ভেঙে গেল, দ’লে গেল গো।”
তবু স্মৃতি থেকে যায় চৈতন্যের প্রান্তর জুড়ে।
“আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী,
দীর্ঘ বরষ মাস।”
তাঁর মৃত্যুশোক রবীন্দ্রনাথের জীবনে কী প্রভাব তৈরি করেছিল তার বিবরণ জীবনস্মৃতির মধ্যে আছে। ধুতির উপর মোটা চাদর পরে বই কিনতে গেছেন। আহার ছিল খাপছাড়া। কিছুকাল ধরে সদ্য বিবাহিত রবীন্দ্রনাথ শয়ন করেছেন ’বৃষ্টি বাদল শীতে’ তেতালার বারান্দায়। কিছুকাল কি গ্রীষ্ম, বৃষ্টি, শরৎ, হেমন্ত, শীত অবধি প্রসারিত ছিল! কী বিবিক্ত, উন্মূল তাঁর জীবন! তবু জীবনের পর্বান্তর ঘটল। সময়ের সাথে স্তিমিত হয় শোক। দুর্বার হয়ে ওঠে সৃজনের প্রেরণা। রবীন্দ্রনাথ যে খুব সহজেই অতলস্পর্শী অন্ধকারকে অতিক্রম করে সংসারের মনোহর ’ছবি’ দেখতে পেলেন তার কারণ হিসাবে নীরদ চৌধুরী উল্লেখ করেছেন তাঁর ধর্মবিশ্বাস। কিন্তু কাদম্বরী দেবীর সাথে প্রেম যদি সত্য বলে ধরে নেয়া যায়, তাহলে তো তাঁর মৃত্যুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ মুক্তি পেলেন এক অসমাধানযোগ্য অবস্থা থেকে। তবু এই শোক কড়ি ও কোমল থেকে শেষ পর্বের কবিতা পর্যন্ত নির্মাণ করেছে অবিস্মরণীয় সব কবিতা (আইয়ুব, ১৯৭১)। তাঁর উপন্যাসে কি এর ব্যতিক্রম ঘটবে?
১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের জীবনচক্র প্রবাহিত বেদনা এবং শোকের ভিতর দিয়ে। প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ মারা গেলেন ১৮৯৯ সালে। ১৯০২ সালে ত্রিশ শেষ না করেই চলে গেলেন স্ত্রী। পরের বছর রবীন্দ্রনাথ হারালেন প্রিয় কন্যা রেণুকাকে। ১৯০৫ সালে পরলোকগত হলেন বটবৃক্ষের মতো জনক। ১৯০৭ সালে মারা গেলেন প্রিয় পুত্র শমীন্দ্রনাথ। এই ভয়াবহ বেদনার পরিবেশেই রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন ঐতিহ্যের গভীরে। শান্তিনিকেতনে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন পৌরাণিক ভুবন, ধর্মের মধ্যে খুঁজছিলেন শোকের উপশম।
জীবনস্মৃতিতে জীবনের পর্বান্তর চিহ্নিত করতে চেয়ে স্মরণ করেন কাঙালিনী কবিতার পংক্তিমালা।
“আনন্দময়ীর আগমনে
আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে--”
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চৈতন্যের দোলক ঐতিহ্যের মধ্যে স্থিরনিবদ্ধ হতে পারেনি। শোকের ভিতর দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল বিপরীত বিন্দুর দিকে।
রবীন্দ্রনাথের সামাজিক অবস্থান আমাদের অনিবার্যভাবে ফ্রান্সের পোর্ত রয়ালের জেনসনবাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। লুসিয়েন গোল্ডমান তাঁর ‘দ্য হিডেন গড’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে দেখিয়েছেন জঁ রাসিনের ট্রাজিক নাটক এবং পাস্কালের দর্শনের মধ্যে রয়েছে জেনসেনবাদীদের বিয়োগান্তক ভুবন-দৃষ্টির অনুকরণন। জেনসেনবাদী ভুবন-দৃষ্টি বিয়োগান্তক। তা নৈরাশ্যজনকভাবে পাপপূর্ণ, জগৎ এবং অনুপস্থিত ঈশ্বরের বিপরীতে ব্যক্তিকে দ্বিধা-বিভক্ত সত্তা হিসাবে চিহ্নিত করে। ঈশ্বর পৃথিবীকে পরিত্যাগ করেছেন। তবুও তিনি বিশ্বাসীর উপর পরম কর্তৃত্ব আরোপ করেন। ফলে ব্যক্তি চূড়ান্ত এবং বিয়োগান্তক নির্জনতার মধ্যে তাড়িত হয়। রাসিনের ট্রাজিক নাটকের কাঠামো জেনসেনবাদীদের বিহ্বল অবস্থাকে প্রকাশ করে। প্রকাশ করে noblesse de la robe নামে অভিহিত রাজকর্মচারীদের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা এবং ক্ষমতাহীনতাকে যা তৈরি হয়েছিল যখন রাজতন্ত্র তাদের অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। নাটকগুলোর অবভাসিত বিষয়বস্তুর মধ্যে জেনসেনবাদের সাথে কোন সম্পর্ক প্রতীয়মান হয় না। কিন্তু গভীর কাঠামোর পর্যায়ে উভয়ের রয়েছে একই রূপ - বিয়োগান্তক নায়ক একইভাবে ঈশ্বর এবং বিশ্ব থেকে সুদূর এবং প্রবলভাবে একা (Seldom, 1986 :38) । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন noblesse de la robe ও পতিত বুর্জোয়া। এ পতিত বুর্জোয়াদের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল জেনসেনবাদ। উল্লেখ্য, ক্যাথলিক ধর্মের মধ্যেই সেন্ট অগাস্টিনের ভাবনার আলোকে গড়ে উঠেছিল এই প্রতিবাদী মতবাদ। এর প্রচারক ছিলেন বেলজিয়ামের ইপার বা ইপ্রেস নগরের পাদরি কর্নেলিয়াস অটো জেনসেন। পরে এটি ছড়িয়ে পড়ে ফ্রান্স ও ইতালিতে। পারির দক্ষিণে পোর্ত রয়ালের মহিলাদের মঠে সৃষ্টি হয়েছিল জেনসেনবাদ। আন্দোলনটি দৃষ্টিগোচর হয়েছিল ১৬৪০ এর দশকে। বিরাজমান ক্যাথলিক ধর্মের বিপরীতে সেন্ট অগাষ্টিনের দর্শনের ভিত্তিতে তা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল আদিম খ্রীষ্টধর্মের একটি রূপ। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিদায় নিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন কয়েকজন চিন্তক যারা ধর্ম, দর্শন এবং সাহিত্য নিয়ে গভীর ভাবনা এবং প্রকাশনায় ব্রতী হয়েছিলেন। “সমাজে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল যে এখানে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করছে একদল লোক যারা পুণ্য, ধার্মিকতা এবং জ্ঞানে উজ্জ্বলভাবে স্বতন্ত্র। তাঁদের সংযত যুক্তিবদ্ধ এবং গভীরভাবে ঐকান্তিক লেখার সাথে ফরাসি বুর্জোয়াদের মানসিক অভ্যাসের গভীর সাদৃশ্য ছিল।” (Adam, 1972: 98-99)
এ্যাডাম পোর্ত রয়ালের লেখকদের সহজেই বুর্জোয়া হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তাদের মানসলোক জুড়ে ছিল গভীর ধর্মীয় বোধ ও বিরোধ।
রবীন্দ্রনাথ এই বিচারে বড্ড বেশি বুর্জোয়া। রবীন্দ্রনাথ যেন দ্বারকানাথ, তবু দ্বারকানাথকে অতিক্রম করে যেতে চান - অনিত্য অর্থ নয়, স্থাপন করতে চান অনন্ত স্বদেশ, শক্তিতে, প্রেমে উজ্জ্বল। এই কল্পিত সমাজে প্রান্তিক, পরদেশী রবীন্দ্রনাথ খুঁজতে চান তাঁর আত্ম-পরিচয়। কিন্তু সহজ হয়নি এই সন্ধান। যদিও লুসিয়েন গোল্ডমান জেনসনবাদকে বিশ্লেষণ করেছেন কাঠামোবাদের পরিসরে, তা সত্ত্বেও তাঁর উপমাটি আকষর্ণীয়। পাাস্কাল বা রাসিনের লেখায় ঈশ্বর যেমন সংগুপ্ত, তেমনি গোরার মধ্যে সংগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে কি আমাদের চিনে নিতে কষ্ট হয়! গোল্ডমান যখন লিখেছেন, তখনও উত্তর-কাঠামোবাদ বা উত্তর-অধুনাবাদের ঢেউ সৃষ্টি হয়নি। পরবর্তীকালে তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর নিজস্ব তাত্ত্বিক কাঠামো জেনেটিক স্টারাকচারালিজম, থেকে গেছেন তার মধ্যেই।
কিন্তু গণিত বিজ্ঞানী পাস্কালের লেখা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে উত্তর-অধুনাবাদের সারাৎসার -
“Such is our true state….We are floating in a medium of vast extent, always drifting uncertainly, blown to and fro; whenever we think we have a fixed point to which we can cling and make fast, it shifts and leaves us behind ;if we follow it,it eludes our grasp,slips away, and flees eternally before us. Nothing stands still for us.” (Pascal, 1973:92).
পাস্কালের মতো রবীন্দ্রনাথও পথহারা। তিনিও দুলেছেন আনন্দ ও বিষাদ, এবং বিশ্বাস ও সংশয়ের মধ্যে। তিনি মেলাতে চেয়েছেন বিভিন্ন প্রান্তকে, দোলকের মতো দুলেছেন বিভিন্ন অন্তের মধ্যে। এই দোলাচল বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় ঐতিহ্য এবং আধুনিকতা, অহং এবং অপরের পরিপ্রেক্ষিতে। ঐতিহ্য বলতে রবীন্দ্রনাথ যেমন বুঝেছেন ভেবারের (Weber, 1978) মতো অন্ধ প্রথাকে যা অলঙ্ঘনীয়, তেমনি তার মধ্যে সনাক্ত করেছেন কল্যাণ ও মঙ্গলবোধ। আধুনিকতা বলতে তিনি বুঝেছেন ভেবারের মতো যুক্তিবদ্ধতা ও কর্মের মাধ্যমে ইহজগতের উপর মানুষের প্রভুত্ব স্থাপন, তেমনি তার ভয়াল আগ্রাসী রূপকে যা তাঁর সভ্যতার সংকট নিয়ে লেখার মধ্যে পরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পশ্চিমের যে সব সদর্থক বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন তা ভেবারের ধারণার কাছাকাছি যায়। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ইউরোপের অর্থে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী নন। তাই সমস্ত জীবন তিনি অপরকে খুঁজে ফিরেছেন। আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯৭৭) দেখিয়েছেন এই প্রচেষ্টার পাশাপাশি কাজ করেছে সংশয়, অমঙ্গলবোধ।
এই দোলাচল সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করেছিলেন তাঁর ভাবনার বহুতল ভবন। ‘গোরা’ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যিক উপন্যাস। এই উপন্যাসে বিধৃত রবীন্দ্রনাথের জীবন, স্বদেশ, সমাজ ও দর্শনের গভীর অভিব্যক্তি। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে উপনিবেশের প্রান্তরে গোরার আত্ম-পরিচয়ের সন্ধান, বেনেডিক্ট এ্যান্ডারসন(১৯৮৩) যাকে বলেছেন ‘স্বমানুষের কল্পিত ভুবন ’সৃষ্টি বা স্বদেশের ভাবমূর্তিকে শনাক্ত করা, নানা পথ ও পন্থার মানুষকে টেনে আনা মিলনমেলায়। গোরার পরতে পরতে একইসাথে মিশে আছে ব্যক্তির পারক্য, গভীর দেশাত্মবোধ, বিশ্ব মানবতাবোধ আরো অনেক জটিলতা, অনেক গ্রন্থিলতা।
১৮৮১ সালে জগৎ-পীড়া প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিবর্তনবাদের উল্লেখ করেন। স্পেনসারের চিন্তাকে বদলে তাঁর মধ্যে ভারতীয় বৃহৎ ঐতিহ্য ও লোকজ ঐতিহ্যকে মেলাতে চেয়েছেন জটিল বিন্যাসে। তাঁর সমাজচিন্তায় ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যকে ও তার বিভিন্ন বিশ্বকে তিনি স্থাপন করেছেন ক্রমোচ্চ বিন্যাসে। বিষয়টিকে নীচের ছকের মধ্যে ধরা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভুবন-দৃষ্টির মধ্যে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন হৃদয়কে - তাঁর ইচ্ছা, আনন্দ ও সৌন্দর্য। তার নীচে বুদ্ধি, যুক্তি, জ্ঞান ও সত্য যা মানবিক বৈশিষ্ট্য।
সবার নিচে রয়েছে প্রকৃতির জগৎ, জড় এবং প্রাণীর জগৎ। এখানে রয়েছে প্রতিযোগিতা, রয়েছে শক্তির বিস্তার। নিয়মের জগৎ-সমাজ। এখানেও রয়েছে প্রয়োজনের এলাকা, প্রতিযোগিতার পরিসর, শক্তিযোজনার অনিবার্যতা যা তৈরি করে কর্মের ক্ষেত্র-কেননা মানুষের রয়েছে অর্থনৈতিক প্রয়োজন, বেঁচে থাকার প্রয়োজন যার তাগিদে মানুষকে সৃষ্টি করতে হয় কর্মের জগৎ। প্রতিযোগিতার প্রয়োজনে মানুষকে শক্তির বিস্তার ঘটাতে হয়।
কিন্তু শুধুমাত্র প্রতিযোগিতা শক্তিকে সংহত করতে পারে না। ছক দুইয়ে আমরা দেখতে পাই, তার জন্য প্রয়োজন সহযোগিতা, নৈতিকতাবোধ। সহযোগিতা তৈরি হয় মঙ্গলবোধের ভিত্তিতে। যে সমাজ যত বেশি সহযোগিতা তৈরি করতে পারে, তত বেশি তৈরি হয় তার উন্নতি, তত বেশি ঘটে সভ্যতার বিকাশ। সাংস্কৃতিক জগৎ হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতার জগৎ--অবসরের জগৎ-তার সৌন্দর্য সাধনার জগৎ। এখানে এসে মানুষ যুক্ত হয় ঈশ্বরের জগতের সঙ্গে। এখানে এসে মানুষ অনুসন্ধান করে দিব্য বিভূতি, মিলতে চায় অসীম সত্তার সাথে — যা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চিরন্তন প্রেম-বিরহের ভুবন।
রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর অবশ্য প্রোটেস্টান্টের ঈশ্বরের মতো সুদূর, অথবা অপ্রাপ্য নয়। তিনি এক এবং অনেক, তিনি স্থিতি এবং গতি, তিনি মুক্ত এবং বাঁধন। তিনি স্বাধীন এবং পরাধীন, তিনি নিয়ম। তার সৃষ্ট জগতের প্রেমের আকর্ষণে তিনি মানুষের কাছে আসেন, প্রেমের মধ্যে মানুষ তাঁকে খুঁজে পায়। তিনি সংহত থাকেন দূরস্থিত কেন্দ্রে। তাঁর গতির মধ্যে তিনি প্রসারিত হন প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে। তবু পাস্কালের মতো রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সংগোপন সংশয় থেকে যায় তিনি কি সত্যিই প্রাপণীয়!
নিচের ছকে তলে ধরা হয়েছে সনাতনী ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দোলাচল যা স্পর্শ করে গোরার আখ্যান ও সমস্ত চরিত্রকে। এর পরিসরে সৃষ্টি হয় অহং এবং অপরের মধ্যেও বিরোধ ও মিলন যা সৃষ্টি করেছে গোরার চিরন্তন আবেদন। রবীন্দ্রনাথ ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে শুধু বিভাজনই দেখেননি, দেখেছেন ঐতিহ্যের মধ্যে গভীর মঙ্গলবোধ ও তার বিপরীতে তার মধ্যে মৃত, নেতিবাচক অন্ধকার। একইভাবে তিনি দেখেছেন ঔপনিবেশিক আধুনিকতার দ্বৈত রূপকে --শাসন ও শোষণের ভয়াল রূপ এবং প্রগতির অনিবার্য বিস্তারকে।
গোরার প্রান্তর রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতার দিকে যাত্রার আবক্র পথ। এখানে যে বিষয়টির উপর আমি গুরুত্ব আরোপ করতে চাই তা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার দিকে অগ্রসর হয়েছেন লোকজ ঐতিহ্যের ঐশ্বর্যকে ভিত্তি করে, বাউল ঐতিহ্যের ভিত্তিতে। রবীন্দ্রনাথ বাউল গান সম্পর্কে উৎসুক হয়ে উঠেন ১৮৮৩ সালে। ক্রমশ তা গভীর হয়ে তাঁর সমগ্র সত্তাকে অধিকার করেছিল” (মজুমদার, ১৯৭২:৪২৪)।
রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ লিখতে শুরু করেন সাতচল্লিশ বছর বয়সে। উপন্যাসটির কাহিনী সিস্টার নিবেদিতাকে শুনিয়েছিলেন ১৩১১ সালের ১৫-১৮ পৌষের কোন একদিন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, তিনি গোরা লিখতে শুরু করেছিলেন শিলাইদহে ১৯০৭ সালের আষাঢ়ে। ছাপা হয়েছিল প্রবাসীতে ভাদ্র ১৩১৪ থেকে ফাল্গুন ১৩১৬ সালের মধ্যে বত্রিশ কিস্তিতে। উপন্যাসের কাহিনীর বিস্তার শ্রাবণ থেকে হেমন্ত অবধি। কাহিনীর সময়কাল সিপাহী বিদ্রোহ থেকে ২২-২৩ বছর পরের কিছু সময় জুড়ে।
গোরার বীজ কাহিনী হচ্ছে কলকাতার হিন্দু ও ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের দুই পরিবারের দুই তরুণ ও তরুণীর প্রেম, বিরহ ও মিলন। তাদের বিবাহে বাধা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ভিন্নতা। উপন্যাসের নায়ক গোরা সিপাহী বিদ্রোহের সময় সন্তানসম্ভবা আইরিশ মহিলাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন ভারতের পশ্চিমে চাকুরিরত কৃষ্ণদয়াল ও তাঁর সন্তানহীনা স্ত্রী আনন্দময়ী। মহিলা সন্তান প্রসবের সময় মারা গেলে, আনন্দময়ী তাকে নিজের সন্তান হিসাবে মানুষ করেন। গোরা ও তার পিতৃ-মাতৃহীন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিনয় এম এ পাস করেও কর্মহীন। গোরা ও বিনয় প্রথমে আধুনিকতার দিকে অগ্রসর হলেও, এক পাদরির হিন্দু ধর্মের উপর আক্রমণ তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসে ঐতিহ্যবাহী হিন্দু ধর্মের দিকে। হিন্দু ধর্মের নবজাগরণের জন্য গোরা লেখালেখি ও কলকাতার কাছে ভ্রমণ শুরু করে। তার কিছু অনুসারীও জুটে যায়। উপন্যাসের শুরু একটি ছোট্ট দুর্ঘটনার ভিতর দিয়ে। ব্রাহ্ম পরেশবাবু ও তার কন্যা সুচরিতার গাড়ি বিনয়ের বাসার সামনে অন্য একটি শকটের আঘাতে উল্টিয়ে গেলে বিনয় তাদের বাসায় নিয়ে পরেশবাবুর পরিচর্যা করে। এই দুর্ঘটনার ভিতর দিয়ে পরিচয় ঘটে শৈশবের দুই বন্ধু পরিবারের। পরিচয় হয় বিনয় ও গোরার সাথে পরেশবাবুর দুই কন্যা সুচরিতা ও ললিতার। গোরা-সুচরিতা ও বিনয়-ললিতার প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুই ধর্মের ভিন্নতা ও বিরোধ। জনপদ ভ্রমণের এক পর্যায়ে গোরা পরিচিত হয় চর-ঘোষপুরে নীলকর সাহেব ও পুলিশের গ্রামবাসীর উপর ভয়াবহ নির্যাতনের সাথে। গোরা যাবার পর আরো গ্রেফতার হয় ৪৭ গ্রামবাসী। তাদের জামিনে মুক্ত করার জন্য কলকাতায় আসার সময় গোরা জড়িয়ে পড়ে ছাত্র ও পাহারাদারদের লড়াইয়ে। গোরার একমাস কারাদণ্ড হয়। জেল থেকে বেরিয়ে গোরা প্রায়শ্চিত্ত করতে উদ্যত হয়। তার পালিত পিতা এতে বাধা দেন। প্রায়শ্চিত্তের দিনে কৃষ্ণদয়াল অসুস্থ হয়ে পড়েন ও গোরাকে জানিয়ে দেন তার জন্মরহস্য। গোরা -সুচরিতা ও বিনয়-ললিতার মিলনে বাধা দূর হয়।
‘গোরা’-র মধ্যে প্রবেশ করলে যে প্রশ্নটি অনিবার্যভাবে তৈরি হয়ে যায় তা হচ্ছে ‘গোরা’-র নায়ক আইরিশ কেন। প্রশ্নটির এক ধরনের উত্তর হচ্ছে এত বড় মাপের চরিত্র বাঙালি হলে তা বাস্তবোচিত হত না। গোরা বাংলা সাহিত্যের প্রবলতম চরিত্র (মজুমদার, ১৩৮৯)। ফলে চরিত্রটির বাস্তব উৎস সম্পর্কে ঔৎসুক্য এবং জবাব তৈরি হয়েছে। প্রথাগত জবাব হচ্ছে গোরা চরিত্র নির্মিত হয়েছে সিস্টার নিবেদিতা এবং ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের আদলে। নেপাল মজুমদার তালিকাটিকে প্রসারিত করেছেন বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথকে অন্তর্ভুক্ত করে। সিস্টার নিবেদিতার সাথে গোরা চরিত্রের দূরত্ব বিরাট। ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপনের সময় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের প্রভাব প্রবল হলেও, ১৯০৪ সালে ১৬ই ডিসেম্বর প্রকাশিত সন্ধ্যা পত্রিকায় তিনি ক্রমাগত যে ‘বিভীষিকা পন্থার’ উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন তা রবীন্দ্রনাথের ভাবনার ঠিক বিপরীত। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর এতবড় প্রচণ্ড পরিবর্তন আমার কল্পনার অতীত ছিল” (পাল ১৩৯৫: ৩৮৩)। ফলে ব্রহ্মবান্ধব যে গোরা চরিত্রের অনুপ্রেরণা নয় তা ধরে নেওয়া যায়।
এই প্রবন্ধের একটি প্রধান প্রস্তাব হচ্ছে ‘গোরা’-র নায়ক রবীন্দ্রনাথ নিজে। প্রস্তাবটির পক্ষে প্রমাণ পরোক্ষ এবং সূক্ষ্ম, কিন্তু শক্তিশালী। গোরার কাহিনী স্থাপিত হয়েছে ১৮৭৯-৮০ সালের কাছাকাছি সময়। সুশোভন সরকার (১৯৭০) দেখিয়েছেন ১৮৮২-৮৫ কালপর্বে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রাজনারায়ণ বসুর প্রভাব বলয়ের মধ্যে, গভীরভাবে আকর্ষিত হয়েছিলেন ঐতিহ্যের প্রতি। ১৮৮৪ সালে তিনি সম্পাদক হলেন আদি ব্রাহ্ম সমাজের। ১৮৮২ সালে একজন পাদরি রেভারেন্ড হেস্টি হিন্দু পৌত্তলিকতার উপর আক্রমণ বঙ্কিমের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল এবং তিনি দ্য স্টেইটসম্যান পত্রিকায় তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন (RayChaudhury, 1988) । এই আক্রমণ রবীন্দ্রনাথের মনেও যে একই রকম প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল তা সঙ্গতভাবেই অনুমান করে নেওয়া যায়। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি আকর্ষিত, ঐতিহ্যবিরোধী গোরা যে ঐতিহ্যের মধ্যে সম্পূর্ণ প্রবেশ করলো তার পেছনে একই রকম ঘটনা কাজ করেছিল।
“ঘটনাক্রমে এই সময়ে একজন ইংরেজ মিশনারী কোন সংবাদপত্রে হিন্দু শাস্ত্র ও সমাজকে আক্রমণ করিয়া দেশের লোককে তর্কযুদ্ধে আহবান করিলেন সংবাদপত্রে গোরা লড়াই শুরু করিল।”
উপন্যাস শুরু হয় শ্রাবণের সকালে বিনয়ের শোনা লালনের বিখ্যাত বাউল গান--
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়…”
উল্লেখযোগ্য, রবীন্দ্রনাথ খাঁচার ভিতর অচিন পাখির প্রসঙ্গটি মোট সাত জায়গায় উল্লেখ করেছেন, কিন্তু প্রথম উল্লেখ গোরার মধ্যে। শেষ উল্লেখ ‘শেষ সপ্তক’-এ ১৯৩৫ সালে (মজুমদার, ১৯৭২)। রবীন্দ্রনাথ খুব স্পষ্টভাবে অনুভব করেছিলেন অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য প্রয়োজন ছিল লোকজ সংশ্লেষণী ঐতিহ্যের। বৃহৎ ঐতিহ্য থেকে মুক্ত হবার জন্য তিনি বেছে নিলেন বাউল ঐতিহ্যকে এবং এই ঐতিহ্যকে ধারণ করে অগ্রসর হলেন আধুনিকতার দিকে।
অচিন পাখির উপমা ‘গোরা’-র সারাৎসার তুলে ধরে। ‘গোরা’-র সমস্ত কাহিনী ও চরিত্র যুক্ত সনাতনী ঐতিহ্য ও ঔপনিবেশিক আধুনিকতার রক্তাক্ত ক্রান্তিকালের সাথে। উপমাটি বিশেষভাবে যুক্ত করা যায় আইরিশ গোরার সাথে। নামটি রবীন্দ্রনাথের আবাল্য পরিচিত। প্রথম যে স্কুল ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন তা গৌরমোহন আঢ্য স্থাপন করেছিলেন গোরাচাঁদ বসাকের বাড়ীতে। গোরার নায়িকা রাধা। দুটি নামের মধ্যে প্রসারিত ‘র’ অক্ষরটি কি আমাদের তাদের স্রষ্টার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না? বেকেটের উপন্যাসের নায়কের নামের প্রথম অক্ষরে ‘এম’ (M)-এর প্রাধান্য যা Molloy, Malone, Murphy, Mahood নামগুলোর মধ্যে দেখা যায় । বেকেটের উপন্যাসে (বেকেট এসকে অনেকটা এমএর মতো করে লিখতেন) যে আত্মজৈবনিক ছাপ তৈরি করে দেয় তা কি এক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায় না(Leventhal, 1965)? গোরার জন্মসাল যদি ১৮৫৭ ধরা যায় তাহলে রবীন্দ্রনাথের চাইতে গোরা চার বছরের বড়। রবীন্দ্রনাথও প্রথমদিকে প্রবলভাবে যুক্ত ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যা গোরা লেখার পটভূমি হিসাবে কাজ করেছে।
‘গোরা’ নামটি আমাদের আরও মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে। শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক। ‘গোরা’-র অর্থ ইউরোপীয় বা ইউরোপীয় সৈন্য। ‘গোরা’ অর্থে চৈতন্যদেবকে বোঝানো যায়। রবীন্দ্রনাথ সচেতনভাবেই দুটি অর্থই ব্যবহার করেছেন।
দ্বিতীয় অর্থটি ব্যক্ত হয়েছে হরিমোহিনীর প্রতিক্রিয়ায়।
“হরিমোহিনী কহিলেন,-- তুমিই গৌর। গৌরই বটে। ঐ-যে কীর্তনের গান শুনেছি--
চাঁদের অমিয়া- সনে চন্দন বাঁটিয়া গো
কে মাজিল গোরার দেহখানি--”
রাধা বদলে যায় সুচরিতায়। ‘গোরা’ কি তাহলে পৌরানিক যুগলের প্রেম-মিলনের কাহিনী! অথবা প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলনকথা! ‘গোরা’-র অন্যতম প্রেজ্জ্বল চরিত্র আনন্দময়ী শব্দটির অন্য অর্থ দেবী দুর্গা। তিনিই আবার হিন্দু ধর্মের সব নিয়ম-আচারের উর্ধ্বে। গোরার মধ্যে অত্যাচারী সাহেবের কথা যেমন আছে, তেমনি স্টিমারে সাহেবের ক্ষমা চাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। ‘গোরা’-র গভীরে ছড়িয়ে আছে নানা সংকেত।
উন্মূল, প্রান্তিক রবীন্দ্রনাথ শক্তি খুঁজেছেন। শক্তির জন্য পশ্চিমকে প্রয়োজন। কিন্তু শক্তি চূড়ান্ত নয়, প্রেমই পরম সত্য। তাই প্রয়োজন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলন। প্রেমের মধ্যে তিনি সার্থক করতে পারছেন নিজের অপূর্ণ জীবনকে, ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ স্বদেশকে। স্বদেশ কেবলই পূর্ণ হতে পারে নানা সভ্যতার সাথে আদান-প্রদান ও সমীকরণের ভিতর দিয়ে। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে খাঁচার প্রসঙ্গে গেলে।
গোরার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ স্থাপন করেছেন দুটি খাঁচা - দুটি কারাগার। ঔপনিবেশিক সমাজের কেন্দ্রে তিনি স্থাপন করেছেন ঐতিহ্যের কারাগার - কৃষ্ণদয়ালের সাধনাশ্রম। অন্যটি উপনেবেশের কারাগার--বাস্তব কারাগার যেখানে গোরাকে প্রবেশ করতে হয়। যে কারাগারের স্বরূপ আমরা দেখতে পাই চর-ঘোষপুরে। ঔপনিবেশিকতার, সাম্রাজ্যবাদের করাল প্রকাশ প্রান্তে। গোরার প্রথম প্রবেশ কিন্তু ঐতিহ্যের কারাগারে, যাকে সে জনক বলে জানে তাঁর কারাগারে। জীবনচক্রের প্রথম পর্যায়ে গোরা ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট। কিন্তু ইংরেজ মিশনারীদের হিন্দু ধর্মের উপর আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে গোরা প্রবেশ করে ঐতিহ্যের কারাগারে।
সুচরিতার ভাষায়, গোরার মধ্যে “বড়ো বেশি রকম হিঁদুয়ানি” কপালে “তিলকের দ্বারা গোরা বড় অক্ষরে লিখিয়া রাখিয়াছে যে তোমাদের হইতে আমি পৃথক”। তবু গোরার কারাগার কৃষ্ণদয়ালের কারাগার থেকে ভিন্ন। গোরা তার ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্যে, তার স্বদেশের পরিসরে অনুসন্ধান করতে বের হয় আত্মপরিচয়ের - স্বদেশের স্বরূপের। গোরা আবিষ্কার করে স্বদেশের সংস্কৃতির মধ্যে অন্ধ রীতি, সমাজের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা। গোরা অনুভব করে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রবলতা সমাজের মধ্যে যোজন করা প্রয়োজন যাতে করে স্বদেশ শক্তিমান হয়ে উঠতে পারে সহযোগিতার মাধ্যমে, কেননা সহযোগিতার পথ ধরেই সভ্যতার বিকাশ ঘটে।
আনন্দময়ীর মধ্যে আমরা স্পষ্ট উচ্চারণ দেখতে পাই মঙ্গলময় ঐতিহ্যের। সমস্ত টানাপোড়েনের মধ্যেও বিনয় ও ললিতা সাড়া দেয় হৃদয়ের ডাকে। গোরার মধ্যেও কাজ করে বুদ্ধি এবং হৃদয়ের দোলাচল। হরিমোহিনী যে হৃদয়বিদারক সনাতনী ঐতিহ্যের জগৎ বা ম্যাজিস্ট্রেট ব্রাউনেলা সাহেব যে ভয়াল ঔপনিবেশিক শাসনকে তুলে ধরেন তার মধ্যে কাজ করে প্রয়োজন, প্রতিযোগিতা ও শক্তি। সনাতনী ঐতিহ্যের ছাপ চেনা যায় কৈলাসের মধ্যে। উপনিবেশের ছাপ তৈরি করে দেয় মহিমকে। হরিমোহিনী তুলে ধরে ভূতলের নির্মম বাস্তবতা। চর-ঘোষপুরে পাওয়া যায় বেদনাগাঢ় জনজীবন। প্রতিটি চরিত্রই উপনিবেশের ঘাত-প্রতিঘাতকে ও বিরাজমান সমাজকে গভীর বিশ্বস্ততায় প্রতিফলিত করে। প্রতিবিম্বিত হয় সমাজের নানা স্তর, নানা মত ও নানা দ্বন্দ্ব।
আগের ছকের তুলনা করলে দেখা যাবে গোরার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একই ভুবনদৃষ্টি প্রকাশ করছেন। উপরে ঐতিহ্য-নিষিক্ত আধুনিকতা। প্রেম প্রবল কাঠামো। রবীন্দ্রনাথের কাম্য প্রেম এবং জ্ঞানে পরিশীলিত শক্তি। মার্কস ভারতবর্ষের যে উজ্জীবনের কথা বলেছিলেন তারই অনন্য মহাকাব্যিক প্রকাশ গোরার শব্দনীলিমায়, বর্ণনার পরতে পরতে। রবীন্দ্রনাথ ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসছেন। কিন্তু আধুনিকতাকে পুরোপুরি গ্রহণ করছেন না। তিনি গ্রহণ করছেন না পশ্চিমের আধুনিকতা। এমনকী ব্রাহ্ম আধুনিকতাও। তিনি তৈরি করছেন কাউন্টার-ডিসকোর্স। তৈরি করছেন উত্তর-আধুনাবাদ। আধুনিকতাকে তিনি দেখেছেন সাম্রাজ্যবাদের প্রকাশ হিসাবে। দেখেছেন ভেবার যেমনটি বলেছিলেন ‘লোহার খাঁচা’ হিসাবে। তিনি তাই আধুনিকতাকে মেলাচ্ছেন ঐতিহ্যের পরিসরে, যেখানে ঐতিহ্যই প্রবল।
খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি ব্যাপার হচ্ছে উপন্যাসে গোরার প্রবেশ। গোরা কি সত্যিই বলিষ্ঠ চরিত্র, যেমনটি বলা হয়ে থাকে? রবীন্দ্রনাথ গোরাকে ছবির মতো নির্মাণ করেছেন -কখনও বিনয়ের মাধ্যমে, কখনও সুচরিতার মাধ্যমে গোরাকে ভূষিত করেছেন অলংকারের পর অলংকারে। গোরার শক্তি অনেকটাই আরোপিত। এই বিশাল উপন্যাসে গোরার সত্যিকারের বলিষ্ঠতার পরিচয় তিন জায়গায়। প্রথমবার ত্রিবেণীতে-- স্টিমারে একজন ইংরেজ যাত্রীকে ধিক্কার দেওয়ার মধ্যে। দ্বিতীয়বার তার শক্তির পরিচয় পাই ম্যাজিস্ট্রেট ব্রাউন্লোর কাছে চর -ঘোষপুরের ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর মধ্যে। তৃতীয় উদাহরণটি বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য। গোরাকে জেলে যেতে হলো কলকাতায় রিজার্ভ ট্যাঙ্কের পাহারাওয়ালাদের লাথি ও ঘুষি মারার জন্য। সাম্রাজ্যবাদ যেখানে নগ্ন, শোষণ এবং নিষ্পেষণ যেখানে প্রবল, যেখান থেকে ৪৭ জন গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করা হলো, সেই চর-ঘোষপুরে কিন্তু প্রতিবাদী গোরাকে পওয়া গেল না। গোরা তাদের জামিনের ব্যবস্থা করতে আসার পথে ছাত্র-পাহারাওয়ালাদের লড়াইয়ে আকস্মিকভাবে জড়িয়ে পড়লো। যেন রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজন ছিল গোরাকে জেলে ঢোকানো। উপায়ের ব্যাপারটি তার কাছে মূখ্য ছিল না। যেমন আপতিক গোরার জন্ম, তেমনি আপতিক গোরার জেলে যাওয়া। একইভাবে আপতিক গোরার প্রায়শ্চিত্ত বা কৃষ্ণদয়ালের অকস্মাৎ সামান্য রক্তক্ষরণ যা অনিবার্য করে তোলে গোরার জন্মরহস্য উন্মোচন!
কাঠামোবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে গোরার সমস্ত বিশ্লেষণ অন্তিমে কিন্তু ভেঙ্গে পড়ে। যে রবীন্দ্রনাথ উপমার পর উপমা ব্যবহার করেছেন গোরার মধ্যে শক্তিযোজনার জন্য, তাকে তিনি অবশেষে সম্পূর্ণ শক্তিহীন করে ফেললেন। বাস্তব সাম্রাজ্যবাদী কারাগার থেকে বেরোনোর সাথে সাথে গোরা মুক্ত হয়ে গেল সমস্ত খাঁচা থেকে। প্রায় পরিচয়হীন এই নায়ক যার স্বজন নেই, স্বদেশ নেই, স্বধর্ম নেই। অন্তিমে গোরা অচিন পাখি। রবীন্দ্রনাথ যেন বিনির্মাণের খেলা খেলেন এখানে। সব বিনির্মাণের মধ্যে কাজ করে কাঠামো। এখানেও কাঠামো কাজ করে, রূপান্তরিত হয় কাঠামো। স্টুয়ার্ট হল সমকালীন সময়ে আত্ম-পরিচিতির যে ছবি তুলে ধরেছেন তা যেন সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য গোরার জন্য।
It accepts that identities are never unified and, in late modern times, increasingly fragmented and fractured; never singular but multiply constructed across different, often intersecting and antagonistic, discourses, practices and positions. They are subject to a radical historicization, and are constantly in the process of change and transformation (Hall, 2003:4).
গোরা সত্যিকার অর্থে যাযাবর, যেমন রবীন্দ্রনাথও তাঁর আত্ম-পরিচিতি খুঁজেছেন দেশ-দেশান্তরে। তাঁর পূর্বপুরুষ ঘুরেছেন স্থান থেকে স্থানান্তরে।
এখন কোনও কোনও বিশ্লেষক মনে করছেন উত্তর-আধুনিকতায় যে খণ্ডীভবন ও বহুমুখী তাৎপর্যের কথা বলা হয় তা এমনকি প্রাক-রোমান্টিক যুগেও লক্ষ করা যায়। স্টিভেন বেস্ট ও ডগলাস কেলনার লিখেছেন, দ্যলুজ ও গিতারিজ এর মতো উত্তর-অধুনাবাদী তাত্ত্বিক প্রাক-আধুনিক জীবনধারার কোন কোন দিককে তাঁদের তত্ত্বের বৈশিষ্ঠ্য হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এর একটি হচ্ছে যাযাবর জীবন। এই অর্থে গোরা উত্তর-অধুনাবাদকে মূর্ত করে তোলে। “The postmodern nomad attempts to free itself from all roots, bonds, and identities, and thereby resists the state and all normalizing powers” (Best and Kellner, 1991 :103).
রবীন্দ্রনাথও তাঁর কবিতায় ব্যক্ত করেছেন একই বাসনা। “ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন”(ঠাকুর, ১৮৬১:৪৩১)। ‘মানসী’-র ‘দুরন্ত আশা’ কবিতাটির জীবনস্মৃতি প্রসঙ্গে উল্লেখ রবীন্দ্রনাথের কাছে এই বাসনার গুরুত্ব তুলে ধরে। বদ্রিলাও উত্তর-অধুনাবাদকে দেখেছেন ভগ্নাংশ বা খণ্ডের সাথে খেলা হিসাবে।
“It has destroyed itself. It has deconstructed its entire universe. So all that are left are pieces. All that remains to be done is to play with the pieces. Playing with the pieces—that is postmodern” (Best and Kellner, 1991:128).
গোরার মধ্যে দেখা যায় বিচ্ছিন্ন, বিবিক্ত মানুষের শোভাযাত্রা। উপন্যাসের তিনটি প্রধান চরিত্র গোরা, বিনয় ও সুচরিতা পিতৃ-মাতৃহীন, বলতে গেলে পরিজনহীন। পরেশবাবু ভয়ংকরভাবে নির্জন। কৃষ্ণদয়াল বন্দী তাঁর উপসনাকক্ষে। হাসান আজিজুল হকের (১৯৮১) কথায়, আনন্দময়ীর মতো চরিত্র সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আর একটিও নেই যিনি সমাজ, ধর্ম ও নিয়মের ঊর্ধ্বে শুধুমাত্র জননী। কিন্তু আনন্দময়ী সন্তানহীনা - অসম্ভব একাকী। গোরা কর্মহীন পরিব্রাজক। গোরার একটি প্রধান কাজ ছিল সকালে বেরিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘোরা এবং রাতে ফিরে আসা। বিনয়-ললিতার বিয়েতে যখন গোরা যোগ দিতে অস্বীকার করে তখন গোরার মনে হয়, “আমার মানচিত্রটাতে কেবল আমিই একলা এসে ঠেকব।” গোরা তাঁর জন্মরহস্য জানার পর অনুভব করে, “তাহার মা নাই, বাপ নাই,দেশ নাই, জাতি নাই, নাম নাই, গোত্র নাই, দেবতা নাই। তাহার সমস্তই একটি কেবল ‘না’। - এই দিকচিহ্নহীন অদ্ভুত শূন্যের মধ্যে গোরা নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল।” বিনয়ের মধ্যেও ক্রমাগত কাজ করে শূন্যতা। বিনয়-ললিতার সম্পর্কের টানাপোড়েনের এক পর্যায়ে বিনয়ের মনে হয়, “এই বিশ্বব্যাপী শুষ্কতায় শূন্যতায় সে নিজেই আশ্চর্য হইয়া গেল। একটা হৃদয়হীন নিরুত্তর শূন্যের কাছে বার বার প্রশ্ন করিতে লাগিল।” অন্যত্র, সুচরিতার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার মনে হয়, “সে যেন চারি দিক হইতেই ধাক্কা খাইয়া একটা আশ্রয়হীন শূন্যের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল।”
বিরাজমান সমাজের কর্মহীন, প্রান্তিক মানুষ-ব্রাত্যজন-এদের নিয়েই রবীন্দ্রনাথের ’কল্পিত সমাজ’-নেশন। তাদের যাত্রা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নয়। নেশন স্থাপনের জন্য প্রয়োজন অন্তর্গত রূপান্তর, নির্জন, গণ্ডিবদ্ধ মানুষের গ্রন্থিবদ্ধতা। গোরার মধ্যে আউটসাইডার, পরদেশী রবীন্দ্রনাথ ঘরে ফিরছেন। হিন্দু ঐতিহ্যের মধ্যে ফিরছেন, ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে। আবার অন্তিমে ভেঙ্গে ফেলছেন সেই ঘরকে। ভেঙ্গে ফেলছেন সব ঘরকেই। ভেঙ্গে ফেলছেন ্ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে। সরোজ বন্দোপাধ্যায় তাঁর অনবদ্য বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, “ পূরবীর আকাশের সর্বত্র এক অপরূপ শূন্যতার বোধ।” কাব্যগ্রন্থে শূন্য শব্দটির ব্যবহার ৩৪ বার (বন্দোপাধ্যায়,১৯৮৪)। গোরার তলদেশে কাজ করে একই রকম শূন্যতা। গোরার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেন পাস্কালের মতো স্থিতিহীন এক ভুবন যেখানে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে জগত-সংসার, যেমনটি ঘটে উত্তর-অধুনাবাদে। স্যামুয়েল বেকেটের ‘দ্য আননেমেবল’-এর মধ্যে যেমন খুঁজে পাওয়া যায় পাস্কালের প্রভাব - ভাষার কোন কাঠামো নেই (Mélanie (2009), তেমনি রবীন্দ্রনাথের ঔপনিবেশিক আধুনিকতার পরিসরে ব্যক্তি আত্ম-পরিচিতিহীন, স্বরূপহীন।
গোরার শেষ মিলনাত্মক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে সমাপ্তি কল্পনা করেছিলেন তাতে মিলন ছিল না। আত্ম-পরিচিতি প্রকাশ পাবার পর গোরা হয়ে পড়েছিল ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’। তখন কী করণীয় তা জানতে চেয়ে সুচরিতার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই গোরা বেরিয়ে গিয়েছিল পথে--পরিচয়হীন, পথহীন যাযাবর (চৌধুরী,১৯৮৪)। এ কি শুধু সিস্টার নিবেদিতার অনুরোধেই বদল! নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না কিভাবে শেষ হবে তাঁর মহাসৃষ্টি! তিনি তো সব সময় দুলেছেন রূপ-অরূপের, সৃষ্টি-প্রলয়ের জীবনব্যাপী দ্বন্দ্বে। ‘গোরা’ লেখার পরে ২০১৫ সালেও রবীন্দ্রনাথকে আচ্ছন্ন করেছিল অন্তর্ঘাতী বিষাদ, আত্মহননের অভিপ্রায় যা নোবেল পুরস্কারও স্তিমিত করতে পারেনি ( বন্দোপাধ্যায়, ২০১৫ )। এই অজ্ঞেয়, অমোঘ শূন্যতা, পারক্য আরো প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর চিত্রশিল্পে (Ray, 1987)।
এই প্রবন্ধের পরিসরে গোরার কোন বিশদ আলোচনা করা হয়নি। উপন্যাসটি নিয়ে বিবরণধর্মী বা বিশ্লেণধর্মী আলোচনার অভাব নেই। খুব সংক্ষেপে আমি দেখাতে চেয়েছি ঔপনিবেশিকতাবাদ কিভাবে শ্রেণীকে নির্মাণ করে, কিভাবে ব্যক্তিজীবনকে স্পর্শ করে, কিভাবে লেখককে অধিকার করে থাকে, কীভাবে তার সাহিত্যকে লালিত করে। ঔপনিবেশিকতবাদ দীর্ণ করে শ্রেণীকে, গোষ্ঠী জীবনকে, তাড়িত করে ব্যক্তিকে, ব্যক্তি চৈতন্যকে। উপনিবেশের মানুষের যাত্রা প্রকৃত আত্ম-পরিচয়ের সন্ধানে, সমাজের পরিসরে, সংস্কৃতির পরিসরে। রবীন্দ্রনাথ শিল্পী হিসেবে বিকাশের সুযোগ লাভের আগে থেকেই এক দীর্ণ শ্রেণীর প্রতিভূ - প্রান্তিক বুর্জোয়া তিনি। জীবনের প্রথম পঁচিশ বছরে অসফল তিনি, কর্মহীন তিনি। এই নিষ্ফল জীবনেও প্রেমের অনন্ত আভা নামে। ব্যক্তিজীবনের রক্তপাত, উপনিবেশের টানাপোড়েনের মধ্যে তবু স্থির তিনি প্রেমের প্রতি। রবীন্দ্রনাথ ছবির মতো নিজেকে প্রকাশ করেন গোরার মধ্যে, প্রকাশ করেন দ্বৈত সত্তার দ্বন্দ্ব - তিনি পশ্চিমের সন্তান, তিনি পুবের সন্তান। যথার্থই তিনি আত্ম-পরিচিতিহীন। জীবনের রক্তাক্ত জমিনের উপর দিয়ে সফর শেষ করে গোরা নিজেকে আবিস্কার করে অন্তহীন/অসীম শূন্যতায়। ব্রাহ্ম চৈতন্য ঠিক যেন পোর্ত রয়ালের জেনসেনবাদের মতো-- সমস্ত বিশ্বাসের মধ্যেও থেকে যায় জ্বলন্ত সংশয়, অচেনা অন্ধকার, অপ্রাপ্তির শূন্যতা। গাঢ় হয়ে ওঠে উত্তর-অধুনাবাদের প্রতীতি। গোরার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেন কাউন্টার-ডিসকোর্স যা ভেঙ্গে ফেলে সমস্ত স্থিতি, সমস্ত স্থির আত্ম-পরিচিতি, সমস্ত স্থান-কালের ভুগোল। উপন্যাসের শেষে গোরাকে পা ফেলতে হয় অচেনা প্রান্তরে একা, অপরিচিত, ‘নামহীন গোত্রহীন’ ও পথহীন। গোরার কাব্যিক নির্মোকের মধ্যে অবিনাশী হয়ে থাকেন আত্মবিনাশী রবীন্দ্রনাথ(চৌধুরী, ১৯৯২)। পাস্কাল, নীৎসে এবং রবীন্দ্রনাথ যেন বাঁধা একই শূন্যতার সূত্রে।
Whither are we moving? Away from all suns? Are we not plunging continually? Backward, sideward, forward, in all directions? Is there still any up or down? Are we not straying as through infinite nothing? Do we not feel the breath of empty space? Has it not become colder? Is the night not continually closing in on us? (Nietzsche, 1974: 181).
১৩০৯ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন গান,
“শূন্য হাতে ফিরি হে নাথ, পথে পথে--ফিরি দ্বারে দ্বারে
....
কত পথ আছে বাকি, যাব চলি ভিক্ষা রাখি,”
তবু কি হিরন্ময় আভায় রবীন্দ্রনাথ গোরার মধ্যে রেখে যান, জাঁ পল সার্ত্ররের আত্মস্মৃতির শব্দযুগল ধার করে বলা যায়, ‘অনন্ত’ এর পথের ‘সাঁকো’! তা যেমন সত্য সাতচল্লিশের দেশভাগের রক্তপথ বা ‘সেপ্টেম্বর অন যেশোর রোড’ প্রসঙ্গে তেমনি তা সত্য হয়ে থাকবে কাল-কালান্তরের ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সমাজ নিয়ে সমস্ত বিরোধ-মিলনের বেদনাবিদ্ধ পথের মধ্যে।
....................................
উল্লেখপঞ্জি
আইয়ুব, আবু সয়ীদ (১৯৭৭), আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, কলিকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং।
চৌধুরী, নীরদচন্দ্র (১৯৯২), আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, কলিকাতাঃ মিত্র ও ঘোষ।
চৌধুরী, ভূদেব(১৯৮৪) রবীন্দ্র উপন্যাস: ইতিহাসের প্রেক্ষিতে, কলিকাতাঃ দে’জ।
দেব, চিত্রা, (১৩৮৭), ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহল, কলিকাতাঃ আনন্দ পাবলিশার্স।
পাল, প্রশান্ত কুমার (১৩৯৫), রবিজীবনী, পঞ্চম খণ্ড , কলিকাতা ঃ আনন্দ পাবলিশার্স।
বন্দোপাধ্যায়, রঞ্জন(২০১৫), ঠাকুরবাড়ির গোপনকথা,কলকাতা: সাহিত্যম।
বন্দোপাধ্যায়,সরোজ (১৯৮৪), আলো-আঁধারের সেতু: রবীন্দ্র চিত্রকল্প, কলিকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং।
মজুমদার, নেপাল (১৯৮৩), ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ, ১ম খণ্ড , কলিকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং।
মজুমদার, পম্পা (১৯৭২), রবীন্দ্র সংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস, কলিকাতাঃ জিজ্ঞাসা।
মার্কস, কার্ল এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (১৯৭১), ঔপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে, মস্কোঃ প্রগতি।
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ( )গোরা, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস সমগ্র ঢাকাঃ নওরোজ।
----মহর্ষির জন্মোৎসব, রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, কলিকাতাঃ বিশ্বভারতী।
--(১৩৬১), জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্র রচনাবলী, সপ্তদশ খণ্ড, কলিকাতা, বিশ্বভারতী।
--(১৩৭৪), রবীন্দ্র রচনাবলী, ত্রয়োদশ খণ্ড, কলিকাতা: বিশ্বভারতী।
---(১৪০০)‘হেমলতা দেবীকে লেখা’, শারদীয় দেশ।
সেন, সুকুমার (১৩৯৩), রবীন্দ্র শিল্পে প্রেমচৈতন্য ও বৈষ্ণব ভাবনা, কলিকাতাঃ আনন্দ
হক, হাসান আজিজুল (১৯৮১), কথা সাহিত্যের কথকতা, ঢাকাঃ জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী।
হোসেন, সৈয়দ আকরাম (১৯৮১), রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসঃ চেতনালোক ও শিল্পরূপ, ঢাকাঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Adam, Antoine (1972). Grandeur and Illusion: French Literature and Society-1600-1715. Harmondsworth: Penguin.
Anderson, Bendict (1983). Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism. London: Verso.
Best, Steven and Kellner, Douglas (1991). Postmodern Theory. London: Macmillan.
Bignall, Simone and Patton, Paul, eds. (2010). Deleuze and the Postcolonial. Edinburgh: Edinburgh University Press.
Bulhun, Hussein Abdilashi (1977). “Reactive Identification and Formation of an African Intelligentsia.” International Social Science Journal, vol xxix, No 1:149-166.
Chatterjee, Partha (1986). Nationalist Thought and the Colonial World: A Derivative Discourse? London: Zed.
Durkheim, E (1954). The Elementary Forms of Religious Life. London: Allen and Unwin.
Fanon, Frantz (1970). The Wretched of the Earth. Harmondsworth: Penguin.
Foehn, Mélanie (2009). “`Is that the word?’ Samuel Beckett and the Port-Royal Philosophy of Language” Études Irlandaises https://doi.org/10.4000/etudesirlandaises.2634
Goldmann, Lucien (1964). The Hidden God: A Study of Tragic Vision in the Pensees of Pascal and the Tragedies of Racine. London: Routledge.
Goldmann, Lucien (1978). Towards a Sociology of the Novel. London Tavistock.
Hall, Stuart (2003). “Introduction: Who Needs ‘Identity’?” In Stuart Hall and Paul Du Guy (eds.) Questions of Cultural Identity. London: Sage, 1-17.
Kling, B. B (1976). Partner in Empire: Dwarkanath Tagore and the Age of Enterprise in Eastern India. Berkeley: University of California.
Kopf, David (1979). The Brahmo Samaj and the Shaping of the Modern Indian Mind. Princeton: Princeton University.
Leventhal, A.J. (1965). The Becket Hero. In Martin Esslin (ed.) Samuel Beckett: A Collection of Critical Essays. Englewood cliffs: Prentice-Hall.
Nietzche, Friedrich (1974). The Gay Science. With a Prelude in Rhymes and an Appendix in Songs. (Translated, with Commentary by Walter Kaufmann). New York: Random House.
Nisber, Robert (1972). The Sociologial Tradition. London: Heinemann.
Oman, J.Campbell (n.d.). The Brahmans, Theists and Muslims of India. London: T. Fisher Unwin.
Pascal, Belize (1973, trans. A.J. Krailsheimer). Pensées. Penguin: London.
Ray, Sibnarayan (1987). Rabindranath Tagore: Three Essays. Calcutta: Renaissance Institute.
Raychaudhuri, Tapan (1988). Europe Reconsicered: Perceptions of the West in Nineteenth Century Bengal. Delhi: Oxford.
Rostow, W.W. (1960). The Stages of Economic Growth: A Non-communist Manifesto. Cambridge: Cambridge University.
Said, Edward W. (1993). Culture and Imperialism. New York: Alfred A. Knopf.
Sarkar, Sushobhan (1970). Bengal Renaissance and Other Essays. New Delhi: Peoples Publishing House.
Sartre, Jean Paul (1981). The Words. New York: Vintage.
Selden, Raman. (1986). A Readers Guide to Contemporary Literary Theory. Brighton: Harvester Press.
Wallerstein, Immanuel (1989). “The Bourgeois (ie) as a Concept and Reality.” New left Left Review. 167.
Weber, Max (1978). Economy and Society. Berkeley: University of California.
.........................
*প্রবন্ধটি ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি: গোরার রবীন্দ্রনাথ’ নামে ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের ’নিবন্ধমালা’য় প্রকাশিত হয়। এই লেখাটি কিছুটা অদলবদল করে এবং উত্তর-আধুনিকতার বিষয়টি যুক্ত করে এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। প্রবন্ধটি ভিন্ন তাৎপর্য বহন করছে। তাই এটিকে নতুন প্রবন্ধ হিসাবে ভাবা যায়।
** লেখক বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাম্মানিক অধ্যাপক