বইয়ের খবর

প্রান্তের জেদী আখ্যানের দল : সৈকত রক্ষিতের 'উত্তরকথা'

রোহন রায় June 16, 2023 at 7:59 pm বইয়ের খবর

সৈকত রক্ষিত পুরুলিয়ার প্রান্তিক অংশের কণ্ঠস্বর। অনেক বছর ধরে তিনি নিষ্ঠভাবে এই অরণ্য ও আদিবাসী-অধ্যুষিত ভূখণ্ডের কথকতা করে আসছেন। এই নেই-রাজ্যের কথকতা করাটাকে ব্রতের মতো গ্রহণ করেছেন। তাঁর নিজের কথায় - “শিক্ষা-স্বাস্থ্য এবং আর্থসামাজিক ব্যবস্থার নিরিখে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণবঙ্গের এই জেলাগুলিতে শুধু অঘটনই ঘটে, আর যাবতীয় যা ঘটনা তা ঘটে তিলোত্তমা নগরীতে। এখানে খরা এবং জলাভাব হয়, ওখানে তা নিয়ে ‘সন্তোষজনক’ আলোচনা হয়। টেবিলে-টেবিলে মন্ত্রী খান কোলড্রিংকস, প্যাকেজড ওয়াটার। ওখানে পরিবেশ দূষণ নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সেমিনার হয়, কিন্তু যত স্পঞ্জ আয়রন কারখানা ঠেলে, ব্যাটন মেরে, লুদ-লাদ বসিয়ে দেওয়া হয় এখানেই। এই কোমরভাঙা জেলাগুলিতে।” সাহিত্যিক হিসেবে এই কোমরভাঙা জেলাগুলির মাটি কামড়ে পড়ে থাকাটাই আসলে একচেটিয়া আগ্রাসনের মুখে ছুঁড়ে-দেওয়া একদলা ঘৃণার থুতু। আর সেখানেই একটি বিশেষ অঞ্চলের কথাকার হয়েও তাঁর মুখ ঘুরে যায় ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত প্রান্তিক জনজাতির দিকে।

তবে সৈকত রাগী লেখক নন। রাগের জায়গা নিয়েছে তাঁর শান্ত জেদ। শুধু লেখার জন্য লেখা নয়, লেখা দিয়ে পাশে থাকার আন্তরিক প্রয়াস দেখি তাঁর লেখায়। লেখার বাইরেও সে প্রয়াসের পিছনেই খরচ হয় তাঁর দৈনন্দিনের অনেকটা। পুরুলিয়ায় সৃজন উৎসব নামে একটি কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে তিনি লোকশিল্পীদের সংগঠিত করেন। ঘনিষ্ঠমুখে এ ব্যাপারে তাঁর আন্তরিকতার কথা শুনেছি। কাজে তিনি স্থিতধী, লেখাতেও তাই। পুরুলিয়ার সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কামিয়া-শ্রমিকদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে সৈকত লেখেন তাঁর জীবনের প্রথম উপন্যাস ‘আকরিক’। সরাসরি জনজীবনের পরিচয়বিষয়ক এরকম উপন্যাস তিনি আরও লিখেছেন। যেমন, ইটভাটার খাদিয়া শ্রমিকদের নিয়ে লিখেছেন 'অক্ষৌহিনী', বাঁকুড়া জেলার হাটগ্রামের শাঁখারিদের নিয়ে 'স্তিমিত রণতূর্য', শূকরপালক সহিসদের নিয়ে হাড়িক। গল্পের মধ্যে 'শবরচরিত' (শবরদের গ্রাম ভেলাইডাঙা), 'খাদান' (খাদানশ্রমিকদের জীবনযাপন, খাদান ঘিরে গড়ে ওঠা জনজীবন), 'রাঙামাটি' (সাঁওতালদের গ্রাম রাঙামাটি ও তার জীবনপ্রণালি), 'মুখোশ' (ডুমৈরডি গ্রামের মুখোশ কারিগর ও ছৌ- শিল্পীদের জীবন), কিংবা 'খরা' (খরাপীড়িত ডাবহা গ্রামের কামিয়া সম্প্রদায়) ইত্যাদি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। কমিউনিস্ট ছক মেনে লেখক এঁদের জোর করে জিতিয়ে দেবার দায় অনুভব করেন না। যে-পরিণাম ঘটে আসছে তা-ই দেখান। সব লেখার পরিণতিতেই এই মানুষগুলোকে আমরা খাদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, বাস্তবে যেমন তারা দাঁড়িয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে সৈকত নিজের কথা খুব স্পষ্ট - “আমি মোটেই দেখিয়ে দেওয়া বা ঘটিয়ে দেওয়া বিদ্রোহের লেখক নই। ... বরঞ্চ, বিদ্রোহের বদলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরিত্ররা অসহায় আত্মসমর্পণ করছে, সনাতন ঐতিহ্যকে মেনে নিচ্ছে, অথবা সমাজে তাদের বিপ্রতীপ অবস্থানের কথা বলছে। এর যে কোনো পরিস্থিতিই, পাঠকমনে একটা সচেতনতার ভূমি তৈরি করে দেয়।” বোঝা যায়, প্রান্তিক জীবনের লেখক হিসেবে নিজস্ব রাজনীতিবোধের জমিতে কতটা দৃঢ়মূল তিনি। বোঝা যায় নবারুণের মতো তিনিও কোথাও ডিস্টার্ব করতে চান, ভাবাতে চান পাঠককে - কিন্তু একটু অন্যভাবে। পারুল থেকে প্রকাশিত সৈকত রক্ষিতের এই গল্পসংকলনের কিছু গল্প অবলম্বন করে আমরা তাঁর বিরুদ্ধতার স্বরটিকে চিনতে চেষ্টা করব। 

সমষ্টির সংকটের পাশাপাশি তার গভীরে নিহিত ব্যক্তির নিজস্ব সংকটের মাত্রাগুলোকেও সৈকত সমান সহানুভূতির সঙ্গে দেখাতে পারেন।‘পট’ গল্পে গুহিরাম, কিংবা ‘মুখোশ’ গল্পে ভীমাকে আখ্যানের কেন্দ্রে রেখে তিনি সেই কাজটা করেছেন। এটা বড় শিল্পীর গুণ। সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত - দুভাবেই মানুষ কীভাবে কোণঠাসা হয়, কীভাবে সমাজ-নিয়তি কেড়ে নেয় তার পায়ের তলার মাটি, তার সূক্ষ্ম দিকগুলো নিপুণভাবে তুলে ধরেন তিনি। ‘খরা’ কাজ না থাকা, দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া মানুষের গল্প। “সর্বস্ব হারাবার পরও মানুষের সম্বল থাকে তার দুটো হাত। এই হাহাকারের বাজারে পয়সা দিয়ে তা-ও যখন কেউ খরিদ করতে চায় না, তখন সে কার মুখাপেক্ষী হবে?” প্রকৃতি আর মানুষ - উভয়েই যখন বৈরি, তখন বাঁচার উপায় কী? গ্রামের লোকজন শহরে যেতে মনস্থির করে। শুধু পল্টন যেতে চায় না। ভিটে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না তার। ‘চুন’ একজন স্বাধীন, সৎ ব্যপারীর স্বাধীনতা হারানোর গল্প। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে টুনু ঘোষের চুনের কারবারে ভাঁটার টান আসতে থাকে। টুনু তাল মেলাতে পারেনা। শেষ পথটুকু পরিবর্তন এগিয়ে আসে অজগরের মতো অতর্কিতে ও দ্রুতগতিতে। তারপর একদিন কাঠের চোরাকারবারি গণপতি ন্যয্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাকে নিজের অধস্তন করে নেয় - টুনু হঠাৎ আবিষ্কার করে, অসহায়ের মতো নিজের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়া ছাড়া তার সামনে কোনও পথ খোলা নেই। পরিবার যে রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ, এঙ্গেলসের সেই যুগন্ধর তত্ত্বকে মনে করিয়ে দেয় ‘আরেক আরম্ভ’ গল্পের সুমিত্তিরা (সুমিত্রা) ও তাঁর মা ডিংলি। ‘যশোমতি মুর্মু’ গল্পে যশোমতির মৃত্যুপিপাসা আসলে মৃত্যুপিপাসা নয় - বেঁচে থেকে যে সম্মান, যে বিলাসিতা কোনওদিন নাগালে পাবে না, শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সে সেটুকুকে ছুঁতে চায়। সে স্বপ্ন দেখে তার শ্রাদ্ধে অনেককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর। সেজন্য সে অল্প অল্প করে টাকা জমায়। অবশ্য যশোমতির চেয়েও করুণ লাগে ‘মাড়াইকল’-এর চেপুলালকে। নিজের ছিন্নভিন্ন বাস্তবকে মেনে নিয়েও যখন সে সুখে থাকতে পারে, তখন সুবিধাভোগী শ্রেণির মানুষ হিসেবে কিঞ্চিৎ আত্মধিক্কার জাগে। এটাই সৈকতের ট্রিটমেন্টের ধরন। লেখাগুলো সরাসরি অভিযোগের আঙুল তোলে না বলেই অনুভবের গভীর তল থেকে মুকুলিত হয়ে ওঠে আত্মধিক্কার। 

‘ছল’ গল্পে লোকাচারের আড়ালে মানুষের কুৎসিততম প্রবৃত্তি নিজের মুখব্যাদান গোপন করে রাখে। দশচক্রে ভগবানও ভূত হয়ে যান। কালিন্দীর মতো গ্রাম্য আদিবাসী নারীর ডাইনি হয়ে যাওয়া খুব আশ্চর্যের না। কোনও একমুখী ভাবনায় অন্ধ হয়ে-থাকা সমষ্টির জোর কতখানি, তা শুধু এই গল্পেই না, সৈকতবাবুর আরও গল্পের বিষয় হয়েছে। কিন্তু এই গল্পটির জোর প্লটের বিন্যাস ও পরিণতিতে। কালিন্দী যেভাবে তার পরিণতি খুঁজে নেয়, তা নিহিতার্থে পুতুলনাচের ইতিকথার যাদব পণ্ডিতের আখ্যান মনে করিয়ে দেয়। ডাইনি অপবাদে নিজের গ্রাম ত্যাগ করতে হয়েছিল ‘উৎখাতের পটভূমি’ গল্পের সিমতিকেও। যদিও সে পাশে পায় মড়েয়াকে। কালিন্দীর মতো পরিণতি বেছে নিতে হয় না তাঁকে। এই গল্পগুলিতে সৈকত দেখান, ক্ষমতা একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে কীভাবে নিজের স্বেচ্ছাচারি চরিত্রকে নিপুণ শিল্পীর কায়দায় বুনে তোলে। 

সমাজ-নিয়তির আর এক অনবদ্য আখ্যান ‘বাঁজা’। বাঁজা অপবাদ দুর্বিষহ করে তুলেছে বালিকা বাউরির জীবন। স্বামীর চক্ষুশূল, গ্রামীণ সমাজের নিয়ম অনুযায়ী পিতৃগৃহে ফিরে যাবার রাস্তাও বন্ধ। সন্তানলাভের ওষুধ দেবার নামে সাধুবাবা কী ফন্দী এঁটেছেন, তা অনুভব করেও পিছিয়ে আসতে চায় না তার অপমানিত নারীত্ব। যেটুকু দ্বিধা ভাঙা শিকলের টুকরোর মতো লেগে ছিল পায়ে, তার অন্তরাত্মা শেষমেশ সেটুকুও খুলে ফেলে। গঠনকৌশলে আশ্চর্য পরিমিতিবোধের পরিচয় দেন লেখক, আর সেখানেই ঝলসে ওঠে শিল্পী হিসেবে তাঁর মুন্সিয়ানা। ‘খেমটি’ গল্পের খেমটা নাচনেওয়ালি যমুনা ঠিক একইভাবে উপলব্ধি করে যে সে পণ্যমাত্র। সে দেখে তার দুই সম্ভাব্য ভাগীদারের কারোর চোখে প্রেম নেই, শুধুই রিরংসা। তাই সে দৌড় দেয়। ধরা পড়বে জেনেও, লুণ্ঠিতা হবে জেনেও প্রাণপণে দৌড়য়। বিবাদলিপ্ত দুই দলের থেকেই সে সমান দূরে পালাতে চায়। 

‘চাঁদমারি’ গল্পে মহান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক কাঠামোর কুৎসিত দিক উঠে আসে। শীতলপুর গ্রামে পুলিশ ফোর্সের শ্যুটিং প্র্যাকটিস প্রতিবছর একটা উৎসবের আকার নেয়। ক্ষুধিতদের গ্রামে পুলিশ শিবির বসে। বড় বড় কর্তাব্যক্তিদের খানাপিনা চলে। তারপর প্র্যাকটিস শেষ হয়ে গেলে বুড়ো থেকে বাচ্চা সকলে মিলে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় - গুলি কুড়োনোর প্রতিযোগিতা। কারণ বুলেটে থাকা সিসা বা পিতলের বিনিময়ে চাল বা অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যায়। সভ্য দেশের এক প্রান্তে বছরের পর বছর নির্বিবাদে চলতে থাকে এই অশ্লীল উৎসব। “কাড়ে না কেউ রা / ভালোমানুষের ছা।” 


‘জলডুবিদের কাহানিয়া’ অবশ্যই সৈকতবাবুর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির মধ্যে থাকবে। এই গল্পে লেখক শহুরে শিক্ষিত যুবক রণজিতের চোখে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত জীবন দেখান। রণজিৎ এই লালমাটির অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়, গ্রামজীবনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, আর তাই নিয়ে লিখতে চায়। উদয়পুর গ্রামের মানুষদের দেখতে দেখতে তাঁর কলকাত্তাইয়া ধ্যানধারণা ছিন্নভিন্ন হয় - ‘মনে হয় এই জব্বর অসভ্য, ঠাসা, বর্ষার কোপানো মেঘের মতো ভারি হয়ে থাকা কলকাতার জীবনকে নিরীহ গাভীর মুড় থেকে গলসি খোলার মতোই যদি সে খুলে ফেলতে পারত! ... যদি সেও এখানেই থেকে যেতে পারত? এদের নিয়েই লিখত? কে লেখে এদের কথা? অথচ এদের জীবন জলতলের মতোই ওসার! কত না বিচিত্র! চরের ওপর চরের মতো চাপা পড়া কত অশ্রু-আবেগের ঘটনায়, কত অসহায়তায়। কত না বলা কথা তাদের মাথার উপরে শত-সহস্র বছর ধরে শুধু ঘন যামিনী হয়েই থেকে গেল।’ তবে ক্রমে সে মানসিকভাবে জড়িয়ে পড়ে কাজরি নামে এক বাউরি মেয়ের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তে কাজরি রনজিতকে জানায় তার ‘কলঙ্কিত’ ইতিহাস। দু বছর আগের সেই ধর্ষণকাণ্ডকে সবাই মিলে পরিপাটি ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারণ তাতে জড়িত ছিল এক নেতার সুপুত্র। কাজরি চায় সত্য উদঘাটিত হোক। রণজিৎ কলকাতায় ফিরে এই ঘটনা নিয়ে যে গল্প লিখল তাতে কাজরির কথামতো ফাঁস করে দিল সবার পরিচয়। সত্যের একবিন্দুও বাদ দিল না। সে গল্প উদয়পুরের বাউরি সমাজে ভয়ানক এক ঢেউ তুলে দিল। তারপর যা হয় তাই হল। দোষের নিশানা ঘুরিয়ে দেওয়া হল রণজিতের দিকে। দু’ বছর আগে যারা ভিটেছাড়া হবার ভয়ে আসল সত্য গোপন করে রটিয়েছিল যে কাজরিকে “নিশিভূতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল”, তারাই কমিটি গঠন করে ব্যাপারটাকে জাতীয় অপমানের স্তরে উন্নীত করার চেষ্টা শুরু করল - “শুধুমাত্র বাবুদের বিনোদনের জন্য রাঢ়ের বিটিছ্যেলাদের নগ্ন করে সে কলকাতায় দেখাচ্ছে। গুণীজনের পুরস্কার পাচ্ছে। এটা হারগিজ চলতে পারেনা।” প্রকাশ্য সমাবেশ হল। জেলাশাসকের দপ্তরে ডেপুটেশন গেল। স্থানীয় পেটোয়া কাগজগুলোকে দিয়ে বানানো খবর লেখানো হল। কিন্তু কাজরি ততদিনে  ঘুরে দাঁড়িয়েছে, যেভাবে হিংস্র ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ায় কোণঠাসা হওয়া বেড়াল। লাইভ টেলিকাস্টে সরাসরি জানায় - “যে ছুথিয়ারা সমাজ মারাচ্ছে, ইসোব বলছে, উয়ারাই ত হামার ইজ্জৎ লিয়েছে। সরকার উয়াদের হাতে হাতকড়া পরাক।”

আর এখানেই নিছক স্থানিক থাকেন না সৈকতবাবু। দেশ-কাল পেরিয়ে চিরকালীন নিপীড়িত মানুষের গলায় কথা বলে ওঠে তাঁর রচনা। এবং রচনাকে সুখপাঠ্য করে তোলার কোনও তাঁর চেষ্টা খুঁজে পাওয়া যায় না। সৈকতের ন্যারেটিভে আখ্যানের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় প্রতিবেশ। প্রতিবেশকে ফুটিয়ে তুলতে তিনি অনেক শব্দ খরচ করেন। যে মানুষদের নিয়ে তিনি লেখেন, তাদের নিপীড়নের উৎসমূলে রয়েছে বিরাট ব্যপ্ত এক আর্থ-সামাজিক চালচিত্র। প্রতিটি লেখায় কুশলীভাবে সেই চালচিত্রের ব্যাখ্যা ও টীকাভাষ্য রেখে দেন তিনি। কুশীলবদের শ্রেণিচরিত্র ভোলার অবকাশ দেন না কোথাও। আর এখানেই তিনি প্রান্তজীবনের কথকদের মধ্যে বিশিষ্ট। বিষয়ের কথা যদি বাদ দিই, এই ন্যারেটিভ নিজেও নিঃসন্দেহে পাঠককে দূরে ঠেলবে। সৈকতের লেখার সৌন্দর্য বিষয়ের প্রতি তাঁর সহানুভূতি এবং আশ্চর্য পরিমিতিবোধে। এক-একটি লেখা শেষ করার পর সেটা ধরা পড়ে। 

 আরও পড়ুন : কলাবতীদের কিসসা : ভারতীয় মহিলা-ক্রিকেটের অগ্নিপরীক্ষার গল্প / বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য 

যে-অঞ্চল সৈকতবাবুর সাহিত্যের ক্ষেত্রভূমি, তা ঝাড়খণ্ডী উপভাষা ও কুরমালি ভাষা অধ্যুষিত। ফলে তাঁর শব্দভাণ্ডারে সেই অঞ্চলের শব্দাবলীর ছড়াছড়ি তো রয়েইছে, উপরন্তু অনেক জায়গায় তাঁর সাধারণ ন্যারেটিভেও এই ভাষাকাঠামোর প্রভাব স্পষ্ট, যা মান্য চলিতের থেকে বেশ খানিকটা দূরবর্তী করে দিয়েছে তাঁর কথনভঙ্গিকে। কিছু দুরধিগম্য জায়গায় লেখক নিজেই কিছু কিছু শব্দের টীকা দিয়ে দেন। লেখার মাঝখানে, গল্পের গতি ব্যহত করে শব্দার্থ উল্লেখ করেছেন, এমনও ঘটেছে। 

সৈকত ইতিমধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার পেয়েছেন। আরও কয়েকটি পাবেন বলে আশা করা যায়। তখন কিছু কৌতূহলী পাঠকের নজর ঘুরবে তাঁর দিকে। কিন্তু তাঁর লেখার গুণেই, এমন দিন সম্ভবত আসবে না যখন তাঁর জন্য হামলে পড়বে পাঠকের দল। বৃহত্তর পাঠকের কাছে প্রিয় হবার মতো কোনও উপাদান তাঁর লেখায় নেই।

আরও পড়ুন : অগাধ জীবনের কথকতা : প্রতিভা সরকারের 'সদাবাহার' / রোহন রায় 

তবে কিনা, বিস্ফোরণ কখন ঘটবে এবং কীভাবে, সেটা জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে - এরকম একটা ভবিষ্যৎবাণীও করেছিলেন সৈকতবাবুর থেকে বয়সে সামান্য বড়, অধুনাপ্রয়াত আর-এক লেখক। ভাবীকাল তখন কোন কোন লেখা অবহেলার পুরু ধুলো ঘেঁটে খুঁজে বের করবে, আর কোন কোন লেখা ছুঁড়ে ফেলে দেবে আগুনে - সেটা এখনই বলা মুশকিল। 

...................

#বই রিভিউ #Book Review #সৈকত রক্ষিত #উত্তরকথা #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

25

Unique Visitors

215797