তারাশঙ্করের প্রথম বই ছিল কবিতার বই
এ কথা সকলেই জানে যে অন্তরের একেবারে অন্তঃস্থল থেকে বাঙালি কবিতাপ্রবণ জাত। আবহমান কাল ধরে বিক্রমের ঘাড়ে বেতালের মতো বাঙালির ঘাড়ে চেপে আছে কবিতার ভূত। বাঙালি আসলে কবিতা লেখে - টেখে না। বাঙালির কবিতা পায়। আর পাঁচটা জৈবিক ব্যাপারস্যাপারের মতোই।
তবে অনেকেরই জানা নেই, বাংলার তাবড় কথাসাহিত্যিকদের কেউ কেউ প্রাথমিক পর্যায়ে এই পদ্য- রোগে আক্রান্ত ছিলেন। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত বই ছিল একটি কবিতার বই। ‘ললিতা তথা মানস’। বইটি, এখনকার ভাষায়, সুপারফ্লপ হয়েছিল। সেই ব্যর্থতা নিশ্চিতভাবেই বঙ্কিমকে নিজের আসল রাস্তা খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। সম্ভবত আরও কম লোকে জানেন যে আর-এক বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরও সাহিত্যজীবন শুরু হয়েছিল কবি হিসেবে। তাঁর কাব্যগ্রন্থটির নাম ‘ত্রিপত্র’। মুখ থুবড়ে পড়েছিল সেটিও।
বেঙ্গল লাইব্রেরির মতে, ১৯২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বইটি প্রকাশ পায়। ‘আমার সাহিত্যজীবন’ (প্রথম ভাগ)-এ তারাশঙ্কর এই বইয়ের প্রকাশের জন্য যাবতীয় কৃতিত্ব দিয়েছিলেন তাঁর শ্যালককে - “এই ছেলেটি (শ্যালক) আমার থেকে বছর কয়েকের ছোট ছিলেন। কিন্তু স্ত্রীর জ্যেষ্ঠ সহোদর হিসেবে এবং স্বকীয় স্বাভাবিক গুণে আমার পেট্রন হয়ে উঠলেন। এবং জোর করে আমার কবিতার খাতা নিয়ে কবিতার বই ছেপে বসলেন। লাল কালিতে ছাপা কবিতার বই। ছাপা হল কোন প্রেসে মনে নেই, তবে কয়লার ব্যবসায়ী মহলের লেটার হেড ছাপা হোত সেখানে...।” এই বইয়ের কবিতাগুলিকে তারাশঙ্কর তিন পর্বে বিন্যস্ত করেছিলেন : - পাষাণের বাণী, মর্মবাণী ও মুগ্ধবাণী। অবশ্য কবিতাগুলি ছিল খুবই সাধারণ মানের। বাংলা কবিতা সে সময় যেভাবে অসামান্য সম্ভাবনাময় পরিণতির দিকে এগোচ্ছিল, সেই তুলনায় এই বইয়ের কবিতাগুলিকে অতি তুচ্ছ বললেই চলে। তারাশঙ্করের বয়স তখন ২৮।
কবিতা লেখার ভূত অবশ্য নিতান্ত কৈশোরেই তাঁর ঘাড়ে চেপেছিল। গ্রামের নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায় প্রতি বছর পুজোর সময় কবিতা লিখে দেওয়ালে সেঁটে দিতেন। তাই দেখে তারাশঙ্কর আর তাঁর বাল্যবন্ধু লক্ষ্মীনারায়ণের ইচ্ছা হয়েছিল কবিতা লিখতে। দুজনে মিলে লিখে ফেলেছিলেন আগমনী নিয়ে একটি কবিতা। তার প্রথম দু লাইন ‘আমার সাহিত্য-জীবন’ (প্রথম ভাগ)-এ তারাশঙ্কর উল্লেখ করেছেন - “শারদীয়া পূজা যত নিকটে আইল তত সব লোকের আনন্দ বাড়িল।”
লক্ষ্মীনারায়ণের পিতামহের সাহায্যে কলকাতার ক্যালিডোনিয়ান প্রেস থেকে ছাপিয়ে আনা এই কবিতার কপি তাঁরা সপ্তমীর দিন সকালে স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে বিলি করেছিলেন। দুই কবিযশোপ্রার্থী কিশোরকে কেউ কেউ প্রশংসা করেছিলেন। তবে নিন্দুক ছিলেন অনেক বেশি। এ বিষয়ে তিনজন উৎসাহদাতার কথা তারাশঙ্কর উল্লেখ করেছেন। নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায়, অতুলশিব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়। একইসঙ্গে নাম না করে একজনের তির্যক মন্তব্যের কথাও উল্লেখ করেছেন - “হরিবাবুর ছেলেটা ইঁচড়ে পেকে গেল! চুরি করে পদ্য লিখে ছাপিয়ে বিলুচ্ছে! উচ্ছন্নে যাবে!”
যাই হোক, তারাশঙ্করের কবিতা লেখার নেশা আরও অনেক বছর চলেছিল। তারই ফলশ্রুতি ‘ত্রিপত্র’। তারাশঙ্করের নিজের বয়ান থেকে এই বই নিয়ে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও পরবর্তীকালে গবেষক শ্রী সনৎকুমার গুপ্তের সৌজন্যে অনেক বিশদ তথ্য পাওয়া গেছে। দুষ্প্রাপ্য এই বইটি সংগ্রহ করে সনৎবাবু 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকায় ১৩৭১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসের তারাশঙ্কর সংখ্যায় বইটি প্রকাশ করেন। সেখানেই তিনি জানান, গ্রন্থকার বইটি উৎসর্গ করেছিলেন শ্রী নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বইয়ের প্রকাশক ছিলেন চন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় (৮/বি লালবাজার স্ট্রিট, কলিকাতা)। মুদ্রাকর ছিলেন কানাইলাল দাস (ইকনমিকাল প্রেস, ২৩ মীরজাফর লেন, কলিকাতা)। বইয়ের দাম ছিল ছ’ আনা। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬০।
ঋণ ১) তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় / আমার সাহিত্য-জীবন (প্রথম ভাগ)। ২) তারাশঙ্কর রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)/ মিত্র ও ঘোষ।
#ফিচার #তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় #টিম সিলি পয়েন্ট #স্মরণ #জন্মবার্ষিকী